ব্যষ্টি জীবনে ও সমাজজীবনে আধ্যাত্মিকতার পরশমণি ছাড়া মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিকাদি কোন সমস্যারই সুষ্ঠু সমাধান হতে পারে না৷ কারণ---‘‘জীবন ও কর্মের সত্য বনেদ হল আধ্যাত্মিক, যা কেবল যোগ লভ্য৷ জাতীয় সেবাকে ফলপ্রসু করতে হলে আধ্যাত্মিক আলোকপ্রাপ্তি অত্যাবশ্যক৷ ঋষি অরবিন্দ৷
ধর্মমতের ভিত্তিতে দ্বিজাতি-তত্ত্ব হচ্ছে মানুষ নামধারী শোষকদের মস্তিষ্ক প্রসূত৷ নাগরিক-বিভাজনী তত্ত্বে, মানুষে মানুষে বিভেদকামী সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু তত্ত্ব, আদিবাসী উপজাতি-বর্ণজাতি তত্ত্ব, উঁচু জাতি নীচু জাতি তত্ত্ব, আর আর্যামি হচ্ছে শোষক-সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থান্ধ সৃষ্টি ও অখণ্ড মানবজাতির অস্তিত্বের ও সামূহিক স্বার্থের বিরুদ্ধে সুগভীর চক্রান্ত৷ কারণটা ওপেন সিক্রেট৷ যথার্থ তথা আধ্যাত্মিক জীবনবোধের অভাব৷ কেননা মানুষের উৎপত্তির উৎস ও তার গতির পরিসমাপ্তি একই৷ একই সত্তা থেকে সৃষ্ট হয়ে একই সত্তায় মিলে যাওয়া প্রাকৃতিক নিয়ম৷ তাই পৃথিবীর যত মানুষ তাদের সবার মৌলিক উপাদান হল চৈতন্য সত্তা৷ সবাই অমৃতস্য পুত্রাঃ৷ বর্তমান জগতের স্মরণীয়-বরণীয় মুনিগণ (চিন্তাবিদরা) মোটামুটি একমত যে আজকের পৃথিবীর জ্বলন্ত সমস্যা (বার্ণিং ইসু) হচ্ছে ‘দারিদ্র্য, গরীবী৷ গরিবীর মূল কারণ দুটো৷ এক, ধনোৎপাদন অসন্তোষজনক, দুই, ধনবন্টন ন্যায়সঙ্গত নয়৷ এজন্যে দরকার উৎপাদন ও বন্টন সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান৷ এজন্যে দুটো ধারণার ওপর জোর দেয়া দরকার৷ যেমন ১) সর্বাধিক উপযোগ বা প্রগতিশীল উপযোগ (ম্যাক্সিমাম্ ইউটিলাইজেশন), ও ২) যুক্তি সঙ্গত বন্টন৷
এই দুই ভাবনা কার্যকর হলে অনিবার্যভাবেই দুটো সুফল নিশ্চিত হবে৷ প্রথম কথা হচ্ছে--- মানুষের নূ্যনতম চাহিদা পূর্ত্তি নিশ্চিত হবে, দ্বিতীয় কথা হল মানুষের হাতে ক্রয়ক্ষমতা আসবে, ও উত্তরোত্তর তার বৃদ্ধির পথও খুলে যাবে৷ এই সম্যক ভাবনা থেকে এসে যাচ্ছে যে প্রগতিশীল অর্থনীতির মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে দুটি৷ এক সব মানুষকে ক্রয়ক্ষমতা দেয়া ও ক্রয়ক্ষমতাকে সময়ের মূল্যস্তরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ক্রমশঃ বাড়িয়ে যাওয়া, আর দুই, প্রতিটি মানুষের নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্ত্তির নিশ্চিততা দেয়া, বলা বাহুল্য, প্রগতিশীল উপযোগ ভাবনা বাস্তবের মাটিতে ফলপ্রসূ হয় আদর্শ বন্টন ব্যবস্থার রূপায়নে---যা তিনটি স্তরে বিন্যস্ত হওয়া দরকার৷ যথা---এক মানুষের নূ্যনতম চাহিদা পূরণের গ্যারান্টি থাকবে হবে৷ দুই, বৈচিত্র্যের দিকে লক্ষ্য রেখে বিশেষ বিশেষ গুণীদের সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা থাকবে হবে৷ তিন, মানুষের (উপভোক্তার) উপভোগের সর্বনিম্ন মানকে ক্রমাগত ঊর্ধমুখী করে তোলার চেষ্টা থাকতে হবে৷ আর এটা করতে হবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ব্যবস্থা করে দিতে৷ বস্তুত, সমাজ থেকে গরিবী হঠাতে গেলে শতকরা একশত ভাগ কর্মসংস্থানের দ্বারা মানুষকে ক্রয়ক্ষমতা দিতে হবে৷ আর ক্রয়ক্ষমতা যথার্থই দিতে গেলে প্রথমে দরকার শৌখিন দ্রব্যকে গুরুত্ব না দিয়ে জীবন ধারণের অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সর্বাধিক উৎপাদন৷ এটা করতে পারলে যা ফলবে তা হচ্ছে---(১) উৎপাদন ও ভোগের মধ্যে (বা চাহিদা ও যোগানের মধ্যে) সমতা আসবে, ও (২) জনসাধারণের প্রয়োজন পূর্ত্তির নিশ্চিততাও আসবে৷ (সূত্র কঃপ্রাঃ ---শ্রী পি.আর.সরকার)
গরিবী হঠাতে সন্তোষজনক ধনোৎপাদন ও ন্যায়সঙ্গত বন্টন ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার৷ কিন্তু দিশাটা কী? প্রথমে আসা যাক সন্তোষজনক ধনোৎপাদনের কথায়৷ ধনোৎপাদনের কথা উঠলেই কয়েকটা প্রশ্ণ সামনে এসে যায়৷ যেমন--- কিসের জন্যে উৎপাদন? কাদের জন্যে উৎপাদন? উৎপাদনের ব্যবস্থাপক কারা? আর এর মধ্যে শ্রমিক মালিকের ভূমিকা---সম্পর্ক ও দায়বদ্ধতা ও স্বার্থের রসায়ন অনিবার্যভাবেই এসে যায়৷ আর এর উত্তর সন্ধানে কয়েকটা প্রসঙ্গের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার হয়ে পড়ে---
১.প্রকল্পিত এলাকার মানুষের সামূহিক প্রয়োজন ও সময়ের নূ্যনতম নিত্যপ্রয়োজন, ও ২. স্থায়ী নিত্য চাহিদা ও সাময়িক চাহিদা, ৩. উৎপাদনের সম্ভাবতা ও মূলধন - কাঁচামাল-বাজার-যোগাযোগ ব্যবস্থা-শক্তি ইত্যাদি প্রাথমিক শর্তাবলী৷ ৪. মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, ৫. ভোগের উপযোগী ও সম্ভাব্য ভোগ্যোপযোগী বস্তু সম্পর্কে ধারণা ও ব্যবস্থাপনা৷ আর মাথায় রাখতে হবে--- ১) উৎপাদন বাড়াতে হবে৷ ২) বাজারে যোগান অব্যাহত রাখতে হবে৷ ৩) বাজারদর স্থিতিশীল রাখতে হবে৷ ৪) ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে৷---আবার নিজেদের উন্নতির জন্যে কল্যাণমুখী আদর্শ উৎপাদন ব্যবস্থা গড়তে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষদের তিনটি গুণাবলীর অধিকারী হওয়াটাও জরুরী৷ যথা-ক. সামগ্রিক উন্নতির জন্য মানুষের মধ্যে উন্নতির জন্যে জিদ চাই, অদম্য আগ্রহ চাই৷ খ) নিজেদের মধ্যে একতা চাই৷ অটুট ঐক্য চাই৷ গ) কাউকে ঠকাবো না--- এই মনোভাব তো চাই-ই৷ ঘ) আর চাই সর্বানুসূ্যত অর্থনৈতিক ভাবনার অনুসরণ ও অনুশীলন৷ কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন ব্যবস্থা তখনই গড়ে উঠতে পারে যখন যথাযোগ্য সঙ্গ দেবে যুক্তিসঙ্গত বন্টন ব্যবস্থা৷ আর তা গড়তে গেলে সমবায় পদ্ধতি ভিন্ন গত্যন্তরে নেই৷ কেননা সমাজে এ পর্যন্ত যত প্রথা প্রচলিত আছে তা সবই প্রায় সর্র্বেচ্চ মুনাফামুখী, মানুষের সর্বোচ্চ কল্যাণমুখী নয়৷ (ক্রমশঃ)
- Log in to post comments