ক্ষুদার্থ ভারতে জোর-জবরদস্তিমূলক নীতির বদল ও এর যথার্থ সমাধান

লেখক
শ্রী রঞ্জিত বিশ্বাস

ভাত দেবার মুরোদ নাই কিল মারার গোঁসাই’---ঠিক এমনই নিদারুণ শাসন ব্যবস্থা চলছে বর্তমান ভারতে৷ একদিকে কর্মচারীদের ছাঁটাই, কর্মসংস্থান বন্ধ, সারা বিশ্বের মধ্যে বেকারত্বের দিক থেকে ভারতের শীর্ষ স্থান লাভ৷ ক্ষুধার্ত ভারত হিসেবে সারা বিশ্বের মধ্যে ১০২ নম্বরে স্থান পাওয়া এবং সর্বোপরি বর্তমানে যে ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক মন্দা ভারতে নেমে এসেছে সেই দিশাহীন পরিস্থিতিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে যে জবরদস্তিমূলক নীতির ফরমান ভারত সরকার চালু করছে তা এই দেশের অন্তিম যাত্রাকেই ত্বরান্বিত করছে তাতে কোন ধরণের সন্দেহ নেই৷

এক দেশ এক ভাষা, এক খাবার এসব করতে করতে এখন এক দেশ, এক সন্তান নীতিতে উত্তীর্ণ হওয়াটা কীসের ইঙ্গিত বহন করছে৷ এই বিষয়ে লক্ষণীয় যে, এ বছর ১৫ই আগষ্ট লালকেল্লার বর্তমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীজী দেশপ্রেমের এক অদ্ভুত সংজ্ঞা শেখালেন৷ দেশপ্রেমের আর এক নাম নাকি জন্মনিয়ন্ত্রণ তথা ছোট পরিবার৷ অর্থাৎ জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরোক্ষভাবে দেশদ্রোহী! আর ঠিক এই অনুপ্রেরণায় উৎসাহিত হয়ে দেশের মধ্যে প্রথম অসম বিজেপি সরকার এক অদ্ভুত জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতি চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থাৎ যাদের দুটোর বেশী সন্তান হবে তাদের আর কোন সরকারী চাকরী মিলবে না৷

অসম সরকারের এই সিদ্ধান্ত আগামী ২০২১ সাল থেকে কার্যকরী হচ্ছে৷ মানে দুইয়ের বেশী সন্তান হলেই তা শাস্তি যোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হচ্ছে৷ চাকরী পেতে হলে জোর পূর্বক জন্মনিয়ন্ত্রণ করুন৷ আসলে এটা যে বর্তমান অসমে তথা পুরো আর্থিক মন্দা গ্রাস করেছে ও বেকারত্বের আগুনে দেশ জ্বলছে সেই জ্বলন্ত অবস্থাটাকে ঢাকার জন্যেই এই ধরণের উদ্ভট সিদ্ধান্ত৷ এমতাবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ণ হ’ল তাহলে কি জনবিস্ফোরণের এই দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণের কোন দরকার নেই৷ যদি বলা হয় আছে তবে এই জোর খাটিয়ে এক সন্তান, দুই সন্তান নীতি, গর্ভ নিরোধক বড়ি, অস্ত্রপচার ও জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে প্রচলিত ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার মত ধবংসাত্মক নীতির দ্বারা কখনোই নয়৷ এতে বরং হিতে বিপরীত হচ্ছে ও হবে৷

সম্প্রতি স্বাস্থ্য অর্থনীতি ও ইণ্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ হেল্থ ম্যানেজমেণ্ট রিসার্চ-এর প্রাক্তন শিক্ষক বরুন কাঞ্জিলাল এই সম্পর্কিত তাঁর এক বিশেষ প্রবন্ধে স্পষ্টই বলেছেন যে ঘাড়ে ধরে জন্মত্রিয়ন্ত্রণের তিনি ঘোর বিরোধী৷ এ প্রসঙ্গে সরকারের যুক্তি হচ্ছে যেভাবে দেশে দিন দিন জনবিস্ফোরণ হচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে দেশে সার্বিক সমস্যা দেখা দেবে৷ তাই জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতি গ্রহণ! আচ্ছা অসম সরকার তথা ভারত সরকার যাদেরকে আদর্শ ভেবে অনুসরণ করে এই জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা কি ভুলে গেছে যে এই রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ দ্বারা চালিত কমিউনিষ্ট শাসিত চীন সরকার এক সন্তান নীতির যে শাস্তিমূলক ফরমান জারী করেছিল তারা এখন সেই জবরদস্তিমূলক ধবংসাত্মক নীতি থেকে সরে এসেছেন৷ বলা বাহুল্য একটা স্ববিরোধী দৃশ্যের কথা তুলে ধরা যাক৷ গত কয়েক বছর আগেও তো দেখা গেল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আর এস এস সহ অনেক হিন্দুত্ববাদী সংঘটন ও তার মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে সদর্পে বলেছিলেন যে জনসংখ্যা বাড়াতে হিন্দুদের বেশী করে সন্তানের জন্ম দেওয়া দরকার৷ যদিও তাদের নিশানা ছিল সংখ্যালঘুরা৷ তাই জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত এসব ধবংসাত্মক নীতি থেকে দূরে এসে সরকার ও জনগণকে গভীর চিন্তাভাবনা ও সার্বিক কল্যাণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত৷

এবার আসা যাক মোদ্দা কথায়৷ স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর ভারবর্ষের অনেক অবনইত হয়েছে৷ ধর্মের দিক থেকে আচার-আচরণের দিক থেকে স্বাস্থ্যের দিক থেকে অন্তরের ভাবের দিক থেকে সব দিক থেকে অবনতি হয়েছে৷ ভারতের প্রাকৃতিক সম্পদ অপার৷ কিন্তু এই প্রাকৃতি সম্পদের সদ্ব্যবহার করা তো দূরের কথা বরং তা নষ্ট করা হচ্ছে, শুধু তাই নয়, এই বিনাশকে উৎপাদন বলে প্রচার করা হচ্ছে৷ পশু হত্যাকে বলা হচ্ছে খাদ্য (মাংস) উৎপাদন৷ গর্ভপাতের মত মহাপাপকে এবং মানুষের উৎপাদক শক্তির বিনাশকে বলা হয় পরিবার কল্যাণ৷ নারী জাতির উচ্ছৃঙ্খলাতে মর্যাদার বিনাশকে বলা হয় নারী মুক্তি৷ লেখক সন্ন্যাসী স্বামী রামসুখ দাস তাঁর ‘দেশের বর্তমান অবস্থা ও তার পরিণাম’ গ্রন্থে এই সত্য কথা তুলে ধরেছেন৷ তিনি স্পষ্ট ভাষায় আরও বলেন কোন জীবকে হত্যা করা যেমন মানুষের অধিকার বহির্ভুত কাজ তেমনই কোন জীবের জন্মরোধ করাও মানুষের অধিকার বহির্ভুত, একটি ভয়ানক পাপকর্ম৷ জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে উক্ত লেখক আর অনেক ক্ষুরধার যুক্তি দিয়ে বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেছেন যা গভীর অধ্যয়ন ও চিন্তার দাবী রাখে৷ এবার আসা যাক এই জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত যে রাষ্ট্রীয় সমস্যা তার যথার্থ সমাধানে যা বিশ্বচর্চিত বিশ্বখ্যাত মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের ভাষায় সরকার ও সকল দেশবাসী তথা বিশ্ববাসীর কাছে প্রকাশ করছি৷ সাধারণতঃ দেখা যায় যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো বিশেষ করে যারা পুষ্টিকর খাদ্য খান বংশবৃদ্ধি হয় না৷ তাদের বংশবৃদ্ধির হার আশ্চর্যজনকভাবে কমে যায়৷ মা ষষ্ঠীর কৃপা গরীবের ঘরে৷ আর্থিক স্বচ্ছলতার দরুণ কয়েকটি বিশেষ বর্গের ঘরে সন্তানের সংখ্যা খুব কম হয়ে থাকে৷ আার তাই পোষ্যপুত্র তারাই গ্রহণ করেন৷ সংখ্যা বৃদ্ধি হয় তাদেরই ঘরে যারা যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টিকর খাদ্য পায় না৷ বর্তমান পৃথিবীতে যে সব দেশের আর্থিক অবস্থা বেশ উন্নত তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অত্যন্ত কম৷ কখনও দেখা যায় কোন কোন দেশের দশ বছর পরেকার আদম সুমারীতে জনসংখ্যা বড়েইনি৷ বা হয়ত কিছুটা কমেছে৷ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিতে জনসংখ্যা আজ না বাড়ায় একটি সমস্যা৷ সে সব দেশের সংখ্যাবৃদ্ধির জন্যে বিশেষ আর্থিক ভাতার ব্যবস্থা করেও হয়তো সমাধান হচ্ছে না৷ কোন কোন দেশে যে হারে জনসংখ্যা কমে চলেছে তাতে হয়তো এক পুরুষ পরে বড়ো-বুড়িদেরই ভীড় থাকবে৷ শিশুর কল-কোলাহল আর শোণা যাবে না৷ তাই যারা দেশের জনসংখ্যা কমাতে চায় তাদের উচিত পরিবার পরিকল্পনার নামে অর্থব্যয় না করে দেশের গরীব জনসাধারণকে পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়াবার ব্যবস্থা করা৷ তাহলে আপনা থেকে জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার কমে যাবে৷ প্রকৃতি বিরোধী ভাবে শরীরের ওপর কোনও অস্ত্রপ্রচার না করে জনসাধাারণকে পেট ভরে পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়াবার ব্যবস্থা করা উচিত৷ এটাই পরিবার পরিকল্পনার সাধু তথা সৎ প্রয়োগ হবে৷ আর ঠিক এমনটাই স্বীকার করে সম্প্রতি স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও ইণ্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ হেল্থ ম্যানেজমেণ্ট রিসার্চ-এর প্রাক্তন শিক্ষক বরুণ কাঞ্জিলাল তাঁর এক বিশেষ প্রবন্ধে বলেছেন ক্রমহ্রাসমান শিশুর মৃত্যুর হার, যার সঙ্গে জন্মহার অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত৷ যে সমাজে একটি শিশুর জন্মের পরে বেঁচে থাকাটা অনিশ্চিত সেখানে মা-বাবা সঙ্গত কারণেই বেশী সংখ্যক সন্তান উৎপাদন করতে চাইবে যাতে বংশরক্ষা সুনিশ্চিত হয়৷ শিশু মৃত্যু কমে গেলে অনিশ্চিয়তা ও বেশী উৎপাদনের চাপটাও কমে যায়৷ তিনি আরও স্পষ্টভাবে বলেছেন, যাদের ঘরে মা ষষ্টীর কৃপা বেশী সেই গরীব পরিবারগুলোর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, গর্ভনিরোধক সামাজিক নিরাপত্তা এবং শ্রমের বাজারে ঢোকার রাস্তাটার আরও সুগম করলে তারা নিজেরাই দেশপ্রেম তথা ছোট পরিবারের রাস্তা বেছে নেবেন৷