লিচু ভারতে এসেছিল সম্ভবতঃ বৌদ্ধযুগে৷ ভারত ও চীন উভয়েরই দেশজ ফল হচ্ছে অংশুফলম৷ ফলটির অনেক নামের মধ্যে একটি নাম হচ্ছে অংশুফল্৷ এই আঁশফল গাছের পাতা দেখতে লিচু পাতার মত নয়–কিছুটা গোলাকার.......লিচুর চেয়ে একট ছোটও৷ গাছ কিন্তু লিচু গাছের চেয়ে অনেক বড় হয়.....বট, পাকুড়, অশ্বত্থের মত হয়ে যায় বীজ লিচুর চেয়ে কিছুটা ছোট কিছুটা চ্যাপ্ঢা হয়৷ ফল মিষ্টি হলেও তাতে উৎকট ঝাঁঝ ও গন্ধ থাকে৷ ছোটরা ভালবেসে খেলেও বড়রা পছন্দ করেন না৷ এই আঁশফল বাংলার একটি সাবেকি ফল–ব্যাঞ্জালাইটিস বর্গীয়৷ চীন এই আঁশফল নিয়ে চর্চা বা গবেষণা করে তৈরী করেছিল লিচু৷ বর্তমান পৃথিবীতে চীনের লিচুই সবচেয়ে বড় আকারের, অধিক রসযুক্ত ও সুস্বাদু৷ চীন থেকে ধীরে ধীরে লিচুর বিভিন্ন প্রজাতি ভারতে এসেছিল৷ চীনের যে বৃহদাকার লিচু ইংরেজ যুগের গোড়ার দিকে ভারতে এসেছিল তার আকার কিছুটা ছোট হলেও স্বাদে–গন্ধে তা এমন কিছু নিন্দের নয়৷ মুজঃফরপুরের এই লিচু শাহীলিচু নামে প্রসিদ্ধ৷ অন্য লিচুর তুলনায় এর ফলন কম হলেও আকারে বর্ণে গন্ধে শ্রেষ্ঠত্ব এরই৷ তারা কর্ষককে পয়সাও দেয় বেশী৷ আমি তো পূর্বেই তোমাদের বলেছি যে প্রাচীন চীনে দু’জন ফলতত্ত্ববিদ ছিলেন৷ একজনের নাম মিঃ পি–সি৷ অন্য জনের নাম মিঃ লি–চি৷ আঁশফল নিয়ে চর্চা করে পি–সি যে নূতন ফলটি উদ্ভাবন করলেন তাঁর নামে ফলটির নাম হল পীচ৷ আজকাল ফলটি পীচ নামেই পরিচিত৷ শ্রীযুক্ত লি–চি যে নূতন ফলটির উদ্ভাবন করলেন তাঁরই নামে ফলটির নাম হল লিচু৷ শ্রীযুক্ত লি–চি ছিলেন চু’ বংশের সন্তান৷ তাঁর পিতার নাম ছিল ফি–চু৷ স্বাভাবিক নিয়মেই পিতার নাম যদি হয় ফি–চু পুত্রের নাম লি–চু হওয়াই সঙ্গত৷ উমেশ বাঁড়ুজ্জ্যের ছেলে দেবেশ বাঁড়ুজ্জ্যে হওয়াটাই স্বাভাবিক.... দেবেশ বসু হওয়াটাই অস্বাভাবিক৷ তাই পূর্ব ভারত ও দক্ষিণ চীনের মানুষ ভদ্রলোককে লি–চি না বলে লি–চু বলেন৷ ফলটিও তাই পূর্বভারতে লিচু নামেই পরিচিত–‘লিচি’ নয়৷ সমতলের পলল মৃত্তিকা, উষ্ণ ও মাঝারি ধরণের আর্দ্র আবহাওয়াই লিচুর প্রিয়৷ পশ্চিম ভারতে কঠোর আবহাওয়ায় লিচু ভালভাবে জন্মায় না কারণ সেখানকার আবহাওয়ায় আর্দ্রতা কম–শুষ্ক্তা বেশী৷ আবার অসম, পূর্ব–বাংলা ও উত্তর বাংলায় লিচু ভাল জন্মাবে না কারণ তাতে আর্দ্রতা খুবই বেশী৷ লিচুর প্রিয় ভূমি উত্তর প্রদেশ, উত্তর বিহার ও গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ৷ তোমাদের ইতোপূর্বেই বলেছি–লিচুর নামের সঙ্গে ছয়টি ‘পুর’ অচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত রয়েছে৷ উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলের সাহারাণপুর, উত্তর বিহারের হাজীপুর, মুজঃফরপুর ও সমস্তিপুর ও পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গীপুর ও বারুইপুর৷ অনেক চর্চা বা কালচার করে অনেক গুণকোষের সমন্বয় ঘটিয়ে তৈরী করা হয়েছিল বলে এর একটি নাম ‘কোষফলম্’৷ দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার ‘র্যামবুটান’ ফলটির সঙ্গে এর নিকট সম্পর্ক রয়েছে.....সম্পর্ক রয়েছে শ্যামদেশের তাল–কাঁটালের সঙ্গেও৷ লিচু–ফলের মধু অগ্ণিমান্দ্যের ঔষধ৷ লিচু ফলের গা ফেটে পড়া রসের মধু স্নায়বিক বিকারের ঔষধ৷
বাংলায় ‘লিচু’ লিখতে গেলে ‘লি’ দিয়ে লিখতে হবে৷ দক্ষিণ বাংলার উচ্চারণে ফলটিকে ‘নিচু’ বলা হয়–মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলী, ২৪ পরগণা ও খুলনা জেলার সাবেকী কথ্য ভাষায় ফলটি নিচু নামেই পরিচিত৷ রামমোহন, দ্বারকানাথ ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর–এঁরা সবাই ফলটিকে ‘নিচু’ বলে লিখে গেছেন৷ গ্রাম্য মেয়েদের মধ্যে নিচুবালা নাম আজও দুষ্প্রাপ্য নয়৷ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজের বাড়ীর ভাষাতে যদিও ‘নিচু’–ই বলতেন কিন্তু বর্ণপরিচয়ে লিখেছেন ‘লিচু’ বলে৷ তবে ভুল করে ৯–তে লিচু বলেছেন৷ ৯ অক্ষরটির আসল উচ্চারণ ল্রি (ন্ব্জ)৷ ফলটির উচ্চারণ তো আর ল্রিচু (ন্ব্জন্তুব্ভ) নয়৷
সাধারণতঃ চার ধরণের লিচু পাওয়া যায়–দেশী লিচু, লঙ্গিয়া লিচু (লবঙ্গ লিচু), চীনী লিচু ও শাহী লিচু৷ এ ছাড়া গোলাপী লিচু ভারতে ছিল ও আছে যার গন্ধ গোলাপ ফুলের মত৷ নির্বীজ লিচুও আছে যার গাছ কেবল কলম করেই তৈরী করা যায়৷ বীজ যখন নেই তখন বীজের গাছ হবে কী করে (শব্দ চয়নিকা, ৯/২২)