মানব জীবনে বিজ্ঞান ও ধর্ম

লেখক
সৌমত্র পাল

মানব জীবনের সুষ্ঠু বিকাশে বিজ্ঞান ও ধর্ম এর প্রভাব একান্ত অপরিহার্য৷ তাই ধর্মমানুষের নিজস্ব বিষয় ও বিজ্ঞানের সাথে এর কোন সংযোগ নাই’--- এরূপ ধারণা শুধু যে ত্রুটিপূর্ণ তাই নয় বরং ধর্ম ও বিজ্ঞানকে পৃথক করলে মানব জীবন ও সমাজ জীবন উভয়ই চরম সংকটে এসে উপনীত হয়৷ প্রকৃত পক্ষে বিজ্ঞান ও ধর্ম আন্তসম্পর্ক যুক্তInter linked) একের অগ্রগতি অপরকে বাদ দিয়ে কখনোই হতে পারে না৷ উপমা সহযোগে বলতে পারি যে এরা যেন একদেশে দুটি অভিন্ন অঙ্গ বিশেষ--- মস্তিষ্ক ও হৃদয়৷ মস্তিষ্ককে যদি  বিজ্ঞান তথা বিশেষ জ্ঞানের প্রতীকহিসাবে ভাবা যায় তবে হৃদয়কে অবশ্যই ধমতথা বিবেক’  নৈতিকতারপ্রতীক হিসাবে গণ্য করতে হবে৷ কোন মানুষের মস্তিষ্ক উন্নত (বিকশিত) হলে আমরা তাঁকে সাধারণতঃ জ্ঞানী বলে থাকি, কিন্তু তার হৃদয় যদি অনুন্নত(অবিকশিত) হয়, তবে তার সেই জ্ঞান নিজের এবং অপরের কল্যাণে..... সমাজের মঙ্গলে গ্রহণ উপযোগী হয় না৷  একইভাবে কারোও হৃদয় উন্নত হলেও মস্তিষ্ক যদি অনুন্নত হয় তবে সেই মানুষও উপযুক্ত জ্ঞান(পরিকল্পনা) এর অভাবে দিশাহীন হয়ে যাবে৷ মানব জীবনের বিকাশে তাই মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের সুষ্ঠু মেলবন্ধন প্রয়োজন---প্রয়োজন জ্ঞানের সাথে নৈতিকতার অপূর্ব সমন্বয় ও সমভাবে সমাজজীবনের বিজ্ঞান ও ধর্মের  মনিকাঞ্চন যোগ প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিৎ৷ তবেই মানবজীবন ও সমাজ জীবনের সর্র্বঙ্গীন বিকাশ সাধিত হবে৷

ধর্মসমন্ধে অনেক বিদ্বৎজনের  মধ্যে একটা নাসিকাকুঞ্চনের প্রবণতা রয়েছে৷ তাঁরা প্রায়ই ভুলে যান যে ধর্মের আসলভিত্তি Base) হল বিজ্ঞান৷ অনেকের আবার ধর্ম সম্পর্কে অনেক অযৌক্তিক ধারণাও রয়েছে৷ কিন্তু ধর্মের প্রকৃত ভিত্তিই যে বিজ্ঞান--- এই সত্য প্রায়ই আমরা ভুলে যাই৷ এর পরিনাম সমাজজীবনে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে৷

ধর্মহীণ(নৈতিকতাহীন) বিজ্ঞান সাধনা মানুষকে পশুর স্তরে নামিয়ে আনে, তার মূল্যবোধকে নষ্ট করে সমাজকে অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যায়৷ অন্যদিকে বিজ্ঞান বিবর্জিত ধর্মসাধনা মানব মনে অন্ধবিশ্বাসের জন্ম দেয়৷ নানান অন্ধবিশ্বাস থেকেই মানুষের মনে গভীর বিভেদের প্রাচীর তৈরী হয়৷ জাতিগত এবং সম্প্রদায়গত বিভেদ আজ মানব জাতিকে পবিত্র বিশ্বভাতৃত্বের আদর্শকেUniversal Brotherhood) ভূলিয়ে দিয়েছে পরস্পরকে ভাতৃঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত করে তৈরী করেছে মানুষে মানুষে বিভাজন বিনষ্ট হয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি৷ বারংবার রক্তনদীর ধারায় স্নান করে বিস্ময়ে যেন হতবাক অসহায় ধরিত্রী৷ কবি তাইতো আক্ষেপের সুরে বলেছেন:

মানুষ মানুষ হারায়ে হঁুস

কোথায় চলেছো তুমি

আকাশ বাতাস বিষিয়ে দিয়ে

নরক করে মর্ত্যভূমি৷

বিজ্ঞান সাধনাকে সমাজের সকলের সার্বিক মঙ্গলে.... কল্যাণে নিয়োজিত করতে গেলে সবার আগে অন্তরে নৈতিকতা Morality) প্রতিষ্ঠা করা চাই দৃঢ়ভাবে ৷ নীতিকাকে বলব ? নীতি তাকেই বলব যার মধ্যে কল্যাণের ভাব যা মনকে কল্যাণের দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম--- ক্ষেমার্থে নয়নং ইত্যর্থে নীতি’’৷ একমাত্র ধর্ম মানব মনকে কল্যাণমুখী করে নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত করে৷ মনের প্রসুক্ত সুকোমল সুকুমার অনুভূতিগুলি সযত্নে লালিত পালিত করে মানবতার প্রকৃত উদ্ধোধন করে৷ মানব মনে নৈতিকতাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে মনকে কল্যাণমুখী করে তোলে এবং একই সঙ্গে অন্তরের প্রসুপ্ত সুকোমল সুকুমার অনুভূতিগুলিকে সযত্নে লালিত পালিত করে মানবতাকে জাগ্রত করে৷ এই নৈতিকতাই প্রকৃতপক্ষে সমাজ ও সভ্যতার ধারক ও বাহক৷ আর এই নৈতিকতার  স্থলন হলেই সভ্যতার পতন অনিবার্য৷

.....সমাজে দানা বাঁধে নানান অবক্ষয়৷ আধুনিক সভ্যতায় যেখানে মানুষের পান্ডিত্য যশ ও অর্থ সম্পত্তি প্রভৃতি মানুষের শরীর প্রধান মাপকাঠি, সেখানে নৈতিকতা সম্পর্কে আনন্দমূর্ত্তিজীর একটি সতর্কতা যথেষ্টই তাৎপর্যপূর্ণ৷ তিনি বলেছেন:---

‘‘সভ্যতার এই যুগসন্ধিক্ষণে ব্যষ্টিজীবনের সাধুতার (নৈতিকতা) প্রয়োজনই সবচেয়ে বেশী৷ আমাদের সবসময়েই সতর্ক থাকতে হবে যেন ক্ষুদ্র স্বার্থের কালিমায় এই পরম মানবীয় সম্পদটি ঢাকা না পড়ে যায়৷ সাধুতা যদি না বাঁচল সভ্যতাও বাঁচবে না---ব্যর্থ হয়ে যাবে  মানুষ জাতের সুদীর্ঘ  সাধনা---ব্যর্থ হয়ে যাবে বৈদ্যগ্দ্যের সমস্ত অবদান৷ জীবনে যা কাজেই লাগল না তেমন পঁুথিজোড়া বিদ্যার দাম এক কানা কড়িও নয়৷’’৷৷

                তাই  মানুষের ব্যষ্টিজীবন ও সমাজ জীবনের সার্বিক প্রগতির (প্রগতি কথার অর্থ প্রকৃষ্ট রূপেন গতি ইত্যর্থে প্রগতি)- বিজ্ঞান ও ধর্মের সুসমম্বয় Happy blending) একান্তেই অপরিহার্য৷  একের অস্তিত্ব অপরটির উপর কতখানি নির্ভরশীল তা বিশ্ববরেন্য বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কথাতেই স্পষ্ট:

‘Religion without science is blind and   science without religion is lame’’

এই ‘‘ধর্ম’’ কালমার্কসেরTheory  অনুযায়ী অহফিনের নেশাকিংবা ভাববাদী স্বপ্ণবিলাস অথবা ধনতন্ত্রেরcapitalism) এর শোষণতন্ত্র নয়৷ ধর্মআসলে উচ্চস্তরের বিজ্ঞান এক সমুন্নত দেহ মনোবিজ্ঞানBio-psychology)---  অর্র্থৎ যে বিজ্ঞানসম্মত  অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষের দেহ ও মনের যথার্থ বিকাশ ঘটে তাকেই ধর্ম (মানব ধর্ম)৷ দেহের যথার্থ বিকাশ বলতে শরীরের সুসংহত গঠনবৃদ্ধি সামর্থ্য ব্যাধীহীনতা প্রভৃতিকে বোঝায়৷ আর মনের বিকাশ বলতে মনের সম্প্রসারনকে বোঝায়৷ মন কীভাবে সম্প্রসারিত হয়৷ তা একটু আলোচনা করা যাক৷ (সম্যক রূপে প্রসারিত ---complete Extension of mind ’ হয় তা একটু আলোচনা করা যাক৷ মনের ধর্মই  হল ‘ As  you (mind) think so you  (mind) become ’’ অর্র্থৎ  মন যেমন ভাবনা নেবে তেমনই অবস্থা প্রাপ্ত হয়ে যাবে৷ জগৎ তথা জাগতিক সম্পদ যশ অর্থ ক্ষমতা প্রভৃতি হল আপেক্ষিক ও সসীম৷ তাই জাগতিক বস্তু ভাবনার মাধ্যমে মনের পরিধি ক্রমান্বয়ে সসীম অবস্থা প্রাপ্ত হয় অর্র্থৎ  মনের wave length  কমে গিয়ে মন সঙ্কুচিত (ছোট ) হয়ে যায়৷ এই অবস্থা মনে অজস্রwave  জাল সৃষ্টি হয়ে  বলে  মন অস্থির ও অশান্ত থাকে৷ সংকুচিত মনে শান্তি কোথায়? অন্যদিকে অসীমএর ভাবনার দ্বারা মনের wave length বেড়ে গিয়ে ক্রমাম্বয়ে মন অসীমতত্ব প্রাপ্ত হয়৷ মন অসীমInfinite) এ রূপান্তরিত হলে মনে তরঙ্গ জাল বা অস্থিরতা থাকে না৷ মন হয়ে ওঠে পরম শান্ত৷ ধর্মসাধনা মানব মনকে  অসীমের ভাবনাThought of Infinite) নিতে সাহায্য করে যা ক্রমাম্বয়ে মানবমনের সম্প্রসারন (Enlargement of Human  mind) ঘটায়৷

এখন প্রশ্ণ হল অসীম বলতে আমরা কী বুঝি? আনন্দমার্গ দর্শণে অসীম বলতে একমাত্র চৈতন্য ব্রহ্ম কেই বোঝানো হয়েছে আর বাকি বস্তু জগতের সবকিছুই সসীমআপেক্ষিক (নশ্বর)৷ মনে রাখতে হবে সসীম বস্তু জগতের মাঝে এই অসীম সত্তা (চৈতন্য)  তার কিছুটা অংশ ব্যক্ত (স্ফূর্তঃ) করলেও, সবটা করেননি.... এর বাইরেও তিনি ব্যক্ত আছেন সীমাহীনভাবে,অন্তহীনভাবে৷ তিনি কখনোই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্তা নন... তিনি সর্বদাই অবাক মানসগোচর সত্তা বিশেষ৷ বস্তু জগৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তথা ইন্দ্রিয় দ্বারা  উপলদ্ধ হলেও, চৈতন্য সর্বদা ইন্দ্রিয়ের কাছে অগম্য তা কেবল অগ্রবুদ্ধির দ্বারা মনে উপলদ্ধ৷    (ক্রমশঃ)