পৃথিবী ঘুরে চলেছে একই অক্ষরেখার ওপর৷ এক একটি একই দ্রাঘিমা প্রতিদিন সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে এগিয়ে চলেছে৷ এই চলমানতায় ঋতুবৈচিত্র্য আসে বটে, তবে তা ঘুরে ফিরে প্রতিবছর একইভাবে আসে বলে মানুষ ভুলে যায় পৃথিবীর এই চলমানতা সামনে না পেছনে না কি একইভাবে একঘেয়েমিভাবে ঘুরে চলেছে৷ বোধের এই দূরতিগম্যতাই মানুষের মানসিক শোষণের কারণ৷
বৈচিত্র্যের মধ্যে অগ্রগামীতার সুর শুনতে পান কম মানুষই৷ বেশিরভাগ মানুষ তাকিয়ে থাকেন পেছনের দিকে৷ আর সেইটাই শাসক শোষকের পুঁজি, এই পেছনের দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষগুলো৷
আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষবাষ্প ঢুকে গেছে৷ শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি সর্বত্র একদল মানুষ দূষণ ছড়াচ্ছে৷ আর এক দল মানুষ সেই দূষণের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন৷ যারা দূষণ ছড়াচ্ছে তারা অপরাধী, ধর্ষক, শোষক৷ যারা বিষোদগার করছেন ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীর মতো মঞ্চে, টিভিতে তারাও শোষকের ক্রীড়নক৷ যখন যার পক্ষ হয়ে যান তখন তার পক্ষ হয়ে কথা বলেন৷ এদের কথা শুনে বোঝবার উপায় নেই, আসল সত্যটা কী এঁদের কাছে ধর্ম সত্য, অধর্ম সত্য৷ ধর্মমত সত্য, হাতের মঙ্গলসূত্র সত্য৷ সভ্যতা সত্য, অসভ্যতা সত্য৷ নগ্ণতা সত্য, পোষাক সত্য৷
মানুষ বিভ্রান্ত৷ সিনেমা, থিয়েটার, টিভি সিরিয়াল, গল্প, কবিতা, সবেতেই এখন এই অ–সংস্কৃতির বাতাবরণ৷ রাজনৈতিক মঞ্চে নেতা নয় পাড়ার দাদাগিরি করা গুণ্ডা, মাস্তানদের ঠাঁই৷ অর্থনীতি সোণার হরিণের মত রামকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে বন থেকে বনান্তরে–মায়াবনে৷ ঘরের লক্ষ্মী, সীতা চুরি হয়ে যাচ্ছে দুষ্ট রাবণের হাতে৷
কোথায় বিরোধ বিরোধ কোথাও নেই৷ সবাই যন্ত্রের মতো ছুটছে৷ কেন প্রশ্ণ করা পাপ৷ পরকাল বেহেস্ত মিলবে না৷ দোজক মিলবে সবাই চুপ৷ চুপ করে নিজেকে ঢ়েকে রেখেছেন জোব্বা টুপি আর নামাবলীতে৷
এ সবই মানস অর্থনৈতিক শোষণের ছলকলা৷ আজ আর কেউ দেশ দখল করে শাসন শোষণ করে না৷ আজ শাসন শোষণের নব নব ছলাকলা তৈরী হয়ে গেছে বিজ্ঞাপনী বিপনীর মতো৷ এ থেকে বেরোবার পথ মানুষের জানা নেই৷
একই অক্ষরেখার ওপর পৃথিবী ঘুরছে৷ প্রতিদিন একই নিয়মে সূর্য উঠছে, সূর্য ডুবছে৷ পরিবর্তনটা কিসের কবুতরের শাদা পাখার মতো শাড়ির আঁচল উড়িয়ে পথের ধুলো ওড়ালেও মানুষের মন থেকে শোষণের নাগপাশ ছিন্ন হয় না৷ বরং ভিন্ন কলেবরে ভিন্ন নামে নেমে আসে শোষণ ত্রাসন৷ মুক্তির দিশা তো কারও হাতে নেই৷
শোষণবাদের বিরুদ্ধে মানুষ একসময় মার্কসবাদের ফানুস উড়িয়েছিল৷ যে বেলুন চুপসে গেছে লেনিনগ্রাদের লাল পতাকার মতো৷ পুজিবাদ কোনো একক রাষ্ট্র শক্তি নয়৷ পুঁজিবাদ একটি ছায়া শক্তি৷ সবদেশে, সবকালে তার একটিই রূপ, সে শোষক৷ দেবতারা বাহনে ভর করে আসেন৷ শোষকেরাও বাহন খোঁজেন, কখন কোথায় কোন বাহনে চড়ে ওড়াবেন শোষণের বিজয় রথ৷ মানুষ বোঝে না৷ না বুঝে শ্লোগান দেয় ভেঙ্গে দাও, গুড়িয়ে দাও৷ আসলে ভাঙ্গে নিজেকেই৷ আয়নায় যে রূপ দেখে সে তো আসল আমি নয়৷
আসল আমির খোঁজ করতে হবে৷ ভাড়াটে গুণ্ডামি নয়, ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী নয়, জানতে হবে সত্যিকারের সমাজ সংরচনা৷ মগজের কোষে কোষে মানব বোম বেঁধে যে শোষকেরা অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলন করছেন, তাদের বীণের তালে নাচলে চলবে না৷ শোষণ এখন মানসিক স্তর থেকে হচ্ছে৷ সাধারণ অর্থনীতি, বাণিজ্য অর্থনীতি এখন গণ অর্থনীতির পথ বেয়ে মানস অর্থনীতিতে পৌঁছে গেছে৷ ছাত্রের সিলেবাসে মানস অর্থনীতি নেই৷ স্কুল কলেজে পড়ানো হয় না৷ কেউ কেউ জানলেও অনেকেই জানেন না৷ মানস–র্থনীতি কি যুগের প্রয়োজনে মানুষের এখন তা জানতে হবে৷ জেনে বুঝে ঠেকাতে হবে মানস–র্থনৈতিক শোষণের ছলা–কলা৷ প্রাউট প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব এই মানস–র্থনৈতিক শোষণের কথা বলা হয়েছে৷ বলা হয়েছে সমাধানের পথও৷ মানুষকে তা জানতে হবে৷ মানতে হবে৷ নইলে প্রতিদিন একই অক্ষরেখার ওপর পৃথিবী ঘুরবে৷ একই দ্রাঘিমা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করবে৷ ঋতু বৈচিত্র্য ঘটবে৷ পরিবর্তন কিছু আসবে না৷
- Log in to post comments