মানুষের সমাজের খোঁজে!

লেখক
একষি

আজকের দুনিয়া ‘ইজম’্‌-এর (বাদ-এর বা মতবাদের) চোরাবালিতে পড়ে হাঁসফাঁস করছে৷ যতই ছট্‌ফট্‌ করে ততই তলিয়ে যায়৷ কত যে ‘বাদ’ (ইজম্‌)! আর কোথায় যে তার  শেষ তা বলা মুশকিল৷ --- জড়বাদ, ভাববাদ, পুঁজিবাদ, সাম্যবাদ, ভোগবাদ, মানবতাবাদ, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতীয়তাবাদ, থেরবাদ, মুর্র্দবাদ ইত্যাদি আরো কত ‘বাদ’৷ মতবাদের এই হুলাহুলি হুড়োহুড়ির মধ্যে বিশ শতকের পাঁচের দশকের মাঝামাঝি ‘সমাজ’ কথাটি চিন্তার জগতে তথা মানুষের সামাজিক - অর্থনৈতিক - রাজনৈতিক -সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ভাবনায় নোতুন মাত্রা যোগ করেছে৷ সমাজ বলতে বোঝায়--- ‘সমানম্‌ এজতে’ অর্থাৎ যেখানে সকলে একই কর্মবন্ধনে, সম্মিলিতভাবে এগিয়ে চলেছে৷ দার্শনিক দৃষ্টিতে সমাজ হল সম মানস তরঙ্গের অভিব্যক্তি আর কেউ আগে এগিয়ে যাবে না--- আবার কেউ পিছিয়েও পড়ে থাকবে না---সবাইকে নিয়ে এক সঙ্গে এগিয়ে চলার মানসিক প্রবণতা৷ ফিরে দেখতে গেলে কথাটা হচ্ছে---‘ন্যাজল’ প্রাণীদের ন্যাজটা কেড়ে নিলে তাদের টিকে থাকাটাই অসম্ভব হয়ে পড়ে৷ কিন্তু ‘বাদ’-অন্ত বিষয়গুলোতে লেজের মত জুড়ে থাকা ‘বাদ’ কেড়ে নিলে কোন বিপর্যয় ঘটে না, যদিও অবস্থা গতিকে সীমিত পরিসরে হলে তার একটা বৈবহারিক বা প্রয়োজন মত গ্রহণযোগ্যতা আছে৷ তবে ‘গোবরে পদ্মফুল’-এর মত, দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ- এর ‘বাদ কুলে’ ‘খল-নুড়ি’র মত অধ্যায় বাদ ও বিশ্বৈকতাবাদ  এক নিঃসঙ্গ ব্যতিক্রম, জাতে ও ধাতে ভিন গোত্রের, যেন ভিন্‌গ্রহের৷ জীব বিজ্ঞানের পরিভাষায় বাদতন্ত্রে এই দুই-এর ‘জীন’টাই আলাদা৷

তবে বলতে নেই, --- আজকের দিনে অনেক ইজম্‌ (‘বাদ্‌’ বা মত বা তত্ত্ব বা মতবাদ) থাকলেও দুনিয়া কাঁপিয়েছে ও কাঁপাচ্ছে ‘জাতীয়তাবাদ’ বা ‘জাতিরাষ্ট্র’ ব্যবস্থা৷ তবে অনেকে হয়ত বলবেন--- তা কী করে হয়! জাতীয়তাবাদ কেন? এখন তো আন্তর্জাতিকতাবাদের  যুগ তথা বিশ্বায়নের যুগ৷ নানা দোষে আচ্ছন্ন হওয়ায় জাতীয়তাবাদকে মানুষ পিছনে ফেলে এসেছে৷ বলাবাহুল্য, এটাই একটা হাজার-বিরাশির ধাপ্পা, পালিশ করা ধোঁকা৷ জাতীয়তাবাদকে স্বীকার করে নিয়েই আন্তর্জাতিকতাবাদের জন্ম৷ শুনতে ভাল লাগলেও আন্তর্জাতিকতাবাদ জাতীয়তাবাদের দোষেই দুষ্ট৷ গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ইত্যাদি সবারই মূলে সেই জাতিবাদ, আর গালভরা কথাগুলো মুখোশ মাত্র৷ বরং বলা যায়--- জাতীয়তাবাদের আড়ালের স্বভাবটা, আকর্ষণ বা সংবেদটা হচ্ছে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা৷ তবে তা কোথাও উগ্র, কোথাও নাগরালী হলেও সবেরই অর্থনৈতিক বন্ধনটা কেন্দ্রীত, পুঁজিবাদী কোথাও লাগামটা ব্যষ্টি বা গোষ্ঠী পুঁজিবাদের হাতে, কোথাও রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের৷ সোজাসাপটা বললে কথাটা দাঁড়ায়---অনেক কিছুর মূলে নাটের গুরু ওই জাতীয়তাবাদ-‘নেশনষ্টেট’৷ মোটামুটি অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বিশ্বে যা যা ঘটেছে, ঘটছে তা পিছন থেকে জাতীয়তাবাদের পেলা ও ঠেলে দেয়া বল হিসেবে কাজ করেছে৷ দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধ, আন্তঃরাষ্ট্রিক ব্যবস্থার ভাবনায় আসা ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক’-অর্থনৈতিক ও সামরিক বোঝাপড়া, ইয়ূরোপ -আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকা ও ইয়ূরেশিয়া দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ উত্তরকালে সোভিয়েত রাশিয়ার আগ্রাসন-দাদাগিরি, সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পরবর্তীকালে বিশ্ব জুড়ে আমেরিকার একছত্র মাতববরি-বিশ্বায়নের খুড়োর কলের কলকাঠি, বর্তমানে দেশে দেশে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তথাকথিত সাম্যবাদী মহাচীনের তথ্য-প্রযুক্তির সঙ্গে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ইত্যাদির আস্তিনের ভেতর লুকানো সেই জাতীয়তাবাদ৷ আর তার ভেতরে মেরে-কেটে, ছলে-বলে কৌশলে নিজের জাতিকে সবার ওপরে আনা ও সর্র্বেচ্চ শ্রীবৃদ্ধির মরণপণ প্রয়াস৷ ফলটা অনিবার্যভাবে জাতিসত্তার (নেশনহুড) সংঘাত, অবদমন পীড়ন আর আগ্রাসন৷ তাইতো উৎকট ‘দারিদ্র্য’ এ ধুঁকছে৷ তবে এক কথায় জাতীয়তাবাদকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিতে হলে তার সম্যক পরিচয়টা দরকার৷ বস্তুতঃ, জাতি (নেশন্‌) থেকেই এসেছে জাতীয়তাবাদ কথাটি৷ সাধারণভাবে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন জাতি হল---ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রীয় জনগোষ্ঠী৷ এঁরা আর একটি রাষ্ট্রীয় জনগোষ্ঠী থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধ সচেতন থাকেন৷ এই জাতিচেতনার (নেশন্‌হুড) উদ্ভব হয় একটা বিশেষ ভৌগোলিক-প্রাকৃতিক সীমানা ও একই প্রশাসনিক-অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে, এক ঐতিহাসিক স্মৃতি বা সামাজিক ঐতিহ্য ও সর্বস্তরে যোগাযোগের এক ভাষা ও সামাজিক সাংস্কৃতিক বন্ধনে৷ এই বন্ধনের কাজটা করে ওপরে বলা যে কোন এক বা একাধিক শর্ত বা বিষয়ে বিরুদ্ধ বা আহত বা উদ্দীপ্ত আবেগকে (এন্টিসেন্টিমেন্টকে) ভর করে৷ কাজেই জাতি বা নেশন্‌ হতে গেলে একই গোষ্ঠীভুক্ত মানুষের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য-বন্ধন বড় কথা৷ ভাবাবেগ বা এন্টিসেন্টিমেন্ট উবে গেলে অন্যান্য শর্তগুলো বজায় থাকলেও এক জাতি এক প্রাণ ‘নেশন’-এর অস্তিত্ব আর থাকে না৷ ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে যে এই কারণে ভারতবর্ষ বহুবার নেশনলেশ্‌ হয়েছে৷ গ্রীক অধিপতি আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের সময় তাঁকে প্রতিরোধ করতে ভারত নেশন হিসেবে লড়েনি, লড়াই করেছে বা বশ্যতা শিকার করেছে খণ্ড খণ্ড রাজ্য পরিচয়ে৷ একই ঘটনা ঘটেছে ভারতবর্ষে আর্য, হুন, মঙ্গল মুঘল, শক---এমনকি ব্রিটিশের সাম্রাজ্য বিস্তারে কালেও৷ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, সমুদ্র গুপ্ত, বিক্রমাদিত্য, অশোক, আকবরের পরবর্তীকালে ব্রিটিশ ভারতে এন্টিব্রিটিশ সেন্টিমেন্ট নানা বিভেদ-পার্থক্যকে ভুলিয়ে ভারতকে একটা নেশন হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল৷ স্বাধীনোত্তর ভারতে কোন শক্তিশালী এন্টিসেন্টিমেন্ট না থাকায় সেই নেশনহুডকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনগুলোকে জিজ্ঞাসার মুখে দাড় করিয়ে দিয়েছে৷ তাহলে বাস্তবে ব্যাপারটা দাঁড়াল---‘নেশন ইজ্‌ নাথিং বাট্‌ এ সেন্টিমেন্ট (শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার)৷ তবে বিষয়টা হান্স কোন, রেনান বলতে চেয়েছেন---দুটি প্রধান অপরিহার্য উপাদানে জাতি গড়ে ওঠে৷ একটি হল কোন রাষ্ট্রের সীমানায় অন্তর্ভুক্ত জনগোষ্ঠীর সাধারণ অতীত ও তার পরম্পরা যাকে এক কথায় বলা যায় সামাজিক ঐতিহ্য৷ আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে---প্রতিবেশী জনগোষ্ঠীর তুলনায় বেশী শক্তিশালী হয়ে টিকে থাকার উদ্দেশ্যে বর্তমান ঐক্যের আকাঙ্ক্ষা৷ পরোক্ষে তো সেই বিরুদ্ধ-ভাবাবেগ বা এন্টিসেন্টিমেন্ট-এরই অনিবার্য ভূমিকাই থাকছে৷ যা হোক, এই দুই উপাদান দুটোই সম্ভবত আঠারো শতক থেকে মধ্যযুগীয় সর্বজনীন সাম্রাজ্যের বিপরীতে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রকে দাঁড় করাতে পেরেছিল বলে তাঁরা মনে করেন৷ তাই ইউরোপীয় সমাজ ভাবনায় আঠারো শতকের আগে ‘নেশন’ বা জাতি’র কোন জায়গায় ছিল বলে মনে হয় না৷ প্রাক আঠারো শতক পর্বে রাষ্ট্রের বৈধতা রাজ কর্তৃত্বের যৌক্তিকতা দিয়েই ঠিক হত, নেশনহুড বা জাতিত্বের বিচারে নয়৷ অষ্টাদশ শতক থেকে এই নেশনহুডই জাতীয়তাবাদের নিয়ামক হয়ে ওঠে, আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল শিকড়টা এখানেই৷ তবে একটা ‘কিন্তু’ থেকেই যাচ্ছে৷ প্রাগৈতিহাসিক তথা ঐতিহাসিক কাল থেকেই ইউরোপ-এশিয়া-লাতিন আমেরিকা-আফ্রিকার নগর রাষ্ট্র তথা ছোট দেশ বা রাষ্ট্রগুলোও, ভারতের ষোড়শ জনপদের ভিত্তিই ছিল জাতি বা জাতিসত্তা৷ আধুনিক ‘জাতিরাষ্ট্র’ ব্যবস্থায়ও জাতি (জাতিসত্তা-এথনিসিটি) বহাল তবিয়তে রয়েছে৷

                                                                    (ক্রমশঃ)