মাতৃসমা

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

 

শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার

বাংলাভাষায় শুধু ‘ণ’ (নঁ) নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও চন্দ্রৰিন্দুর ব্যবহার খুবই সীমিত তথা পরিমিত৷ জনসাধারণের মধ্যে চন্দ্রৰিন্দুর ব্যবহার কম থাকায় মানুষের থেকে ভূতের তফাৎ ৰোঝাবার জন্যে ভূতের মুখে বেশী চন্দ্রৰিন্দুযুক্ত ভাষা ব্যৰহার করা হয়৷ তফাৎ ৰোঝাবার জন্যে এত বেশী চন্দ্রৰিন্দুর ব্যবহার করা হয় যা অস্বাভাবিক......যা ঠিক ফরাসী ভাষায় উল্টো৷ ফরাসী ভাষায় চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহারে অতি প্রাবল্য৷

সেদিন কথা হচ্ছিল ৰাঁশৰেড়ের ৰাঁকাচাঁদ ৰাঁড়ুজ্জের (‘ৰ্যানার্জী শব্দটা অশুদ্ধ৷ ‘বন্দোপাধ্যায় অথবা ‘বাঁড়ুজ্জে’ বলতে হবে৷) সঙ্গে৷ সে একবার কাঁসার ৰঁড়শি কেনবার জন্যে চাঁপদানি গেছল৷ রাস্তায় পড়ল পেল্লায় একটা মাঠ.......কাছেপিঠে কোন গাঁ–গঞ্জ নেই.....চারদিক খাঁ খাঁ করছে৷ সন্ধ্যে হয়ে আসছে৷ তার গায়ে কাঁটা দিল৷ তার পরে এল গোরুটির (গৌরহাটি) জঙ্গল৷ কয়েক পা এগিয়ে সে দেখলে একটি প্রকাণ্ড আঁৰ গাছ৷ সে দেখলে কাছেই গঙ্গা–সেখানে কুমীর আর জঙ্গলে রয়েছে কুঁদো বাঘ৷ তাই সে গাছটায় চড়ে উঠে পড়ল একেবারে মগডালে৷ ভয়ের কাঁপুনি তার তখনও থামেনি৷ এদিকে দেখতে দেখতে রাত হয়ে গেল৷ হঠাৎ দেখলে তার কয়েক পা নীচেই একটা  মোটা ডালের ওপর বসে ময়দা মাখছে একজন মহিলা৷ মহিলা তাকে শুধোলে–‘‘তুমি কেঁ গোঁ, এঁই রাঁত বিঁরেতে মঁগডাঁলে উঠে বঁসেছ হাঁওয়া খেঁতে? আঁাঁমাদের  এঁখানে পাঁর্ক–টাঁর্ক নেঁই বঁটে কিঁন্তু বেঁড়াবার মঁত ৰড় ৰড় ভাঁগাড় তোঁ আঁাঁছে৷ সেঁখানে হাঁওয়া খেঁতে গেঁলে নাঁ কেঁন গাঁ’’?

ৰাঁকাচাঁদ বললে–‘‘আমি হাওয়া খেতে বেরোইনি–যাচ্ছি চাঁপদানি’’৷

মহিলা জিজ্ঞেস করলে–‘‘তুঁমি কিঁ আঁৰগাছটাঁকে চাঁপদানি ভেঁবেছ’’?

ৰাঁকাচাঁদ বললে–‘‘তা নয়, আমি গাছে উঠেছি কুঁদো ৰাঘের ভয়ে’’৷

মহিলা বললে–‘‘তাঁ বেঁশ, তাঁ বেঁশ৷ তাঁহলে তুঁমি আঁমার অঁতিথি৷ তোঁমার খাঁওয়া–দাঁওয়া হঁয়েছে? তোঁমার গঁলার আঁওয়াজ শুঁনেই মঁনে হঁচ্ছে তোঁমার জঁল তেঁষ্টা পেঁয়েছে’’৷

ৰাঁকাচাঁদ দেখলে মহিলার মাথায় টকটকে সিঁদুর. তাই সে তাকে দিদি না বলে ৰউদি বললে৷ সে বললে, –‘‘হ্যাঁ, বউদি, তেষ্টা পেয়েছে’’৷

মহিলা তখন তার লম্বা হাত বাড়িয়ে দিয়ে দু’ক্রোশ দুরের গঙ্গা থেকে এক ঘটি জল এনে তাঁকে দিয়ে বললে–‘নাও ঠাঁকুরপোঁ, খাঁও’’৷

ৰাঁকাচাঁদের তেষ্টা তখন মাথায় উঠেছে৷ তার মনে প্রশ্ণ জাগল এ মানুষ না পেত্নী৷ ৰাকাচাঁদ বললে–‘‘তুমি কে বউদি, তোমার পরিচয় দেবে’’?

মহিলা বললে–‘‘গঁভীর রাঁতে আঁমার পঁরিচয় জেঁনো নাঁ ঠাঁকুরপোঁ, তাঁতে তোঁমার সুঁবিধে হঁবে৷ সঁকাল ৰেলায় সঁূয্যি উঁঠলে তোঁমাকে আঁমার পঁরিচয় দিেঁয় গাঁছের আঁাঁড়ালে নুঁকিয়ে যাঁবো৷’’

ৰাঁকাচাঁদের হাত–পা থরথর করছে, ৰুক ধড়ফড় করছে৷ এ কোথায় এলুম রে বাবা’’

–‘‘বাঘের ভয়ে চড়লুম গাছে,

    ভূত বলে পেলুম কাছে’’৷

মহিলা বললে–‘‘তাঁড়াতাঁড়ি হাঁত মুঁখ ধুঁয়ে নাঁও৷ বেঁশী কিঁছু রাঁধতে পাঁরিনি৷ কঁটা নুঁচি আঁাঁর আঁাঁলুর দঁম খেঁয়ে নাও৷ জাঁন তো আঁাঁমাদের হুঁগলী জেঁলার আঁলু ডাঁকসাইটে৷ আঁাঁমার বাঁপের বাঁড়ী, মাঁমার বাঁড়ী, শ্বঁশুর বাঁড়ী–তিঁনই হুঁগলী জেঁলায়’’৷

খেয়ে প্রাণটাকে একটু শীতল করে নিয়ে ভয় একটু কমিয়ে দিয়ে ৰাঁকাচাঁদ বললে–‘‘ৰউদি, ঘুম আসছে না, আমাকে একটা গল্প বল’’৷

ৰউদি বললে–‘‘আমার শ্বশুর বাড়ী এখান থেকে পশ্চিম দিকে ৰলারামবাটী গ্রামে, আমার ৰাপের  বাড়ী বদ্যিবাটী (বৈদ্যবাটি), মামার বাড়ী শিবরামবাটী, পিসীর ৰাড়ী জনাই আর মাসীর বাড়ী ভাণ্ডারহাটী৷ আমার বিয়ে হয়েছিল তিন বছর বয়সে৷ ৰিয়ের সময় আমি আমার দিদিমার কোলে শুয়ে শুয়ে চুকচুক করে দুধ খাচ্ছিলাম৷ ৰরের ৰয়স ছিল সাতাশি৷ সে ছিল কুলীন ৰামুন–কাব্য–ব্যাকরণ–সাংখ্৷ বিয়ের পরে এয়োরা যখন শাঁখ বাজাচ্ছিল সেই শাঁখের আবাজে আমার ৰরের ৰুক ধড়ফড় করে ওঠে৷ তাতেই সে হার্টফেল করে মারা যায়৷ আমি দিদিমার কোলে শুয়ে শুয়েই বিধবা হলুম৷ ৰামুনের মেয়ে, দু’বার তো বিয়ে হবে না৷ দিদিমা কেবল আমার গালে ঠাস করে চড় মেরে বললে–পোড়ারমুখী, তুই কেন বামুনের ঘরে জন্মেছিলি? তাইতে এমন ৰেঘোরে মরতে হচ্চে আমার ভাশুরদের ৰয়স তখন বিরানব্বই৷ দেওরেরা সবাই তখন ঘাটের ওপরে৷ তারা বলা বলি করছিল–এ পোড়ারমুখীটাকে যদি ৰাঁচতে দেওয়া হয় তা হলে সে সম্পত্তি তো ভোগদখল করবেই, বেচতে কিনতে পারুক না পারুক৷ তাই এ হতচ্ছাড়িকে স্বামীর সঙ্গে চিতায় পুড়িয়ে সতী* (*সাধাণতঃ সেই অন্ধকার যুগে নারীরা তিনটি অবস্থায় সহমরণের হাত থেকে রেহাই পেত–(১) যে নারী গর্ভবতী অবস্থায় থাকত, (২) যে নারীর দুগ্ধ পোষ্য শিশু থাকত, (৩) যে নারী স্বামীর মৃত্যুকালে নিজের পিত্রালয়ে থাকত ও পিতামাতা কন্যার প্রতি মমতাবশতঃ তাকে অনুমৃতা হতে দিতেন না৷ মহাভারত অনুযায়ী পাণ্ডুর মৃত্যুর পর তাঁর পত্নীমাদ্রী অনুমৃতা হয়েছিলেন৷ কুন্তী তাঁর নিজের তিনপুত্র যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুনের সঙ্গে মাদ্রীর দুই পুত্র নকুল ও সহদেবেরও লালন পালনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন৷

 (যে সকল জনগোষ্ঠীতে বিধবাবিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল না সতীদাহ প্রথা তাদের মধ্যেই চলত৷) করে দেওয়া হোক৷ পোড়ামুখী স্বর্গে গিয়ে অনন্ত কাল মাছ–ভাত খাক্ গে৷ তারা আমার স্বামীর সঙ্গে আমাকেও  পুড়িয়ে মারলে৷ আমি আগুনের জ্বালায় চীৎকার করে চিতা থেকে লাফিয়ে পালাবার চেষ্টা করেছিলুম৷ ভাশুর–দেওররা আমাকে ৰাঁশে করে চেপে ধরে আগুনে পুড়িয়ে মারলে৷ আমার হাত–পাগুলো তারা আগেই ৰেঁধে দিয়েছিল৷ যেখানটায় আমাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল লোকে অনেকখানি সিঁদুর ঢ়েলে দিলে, বললে–সতীর স্থান৷ আহাহাহা কী পূণ্যিবতী মেয়ে ছিল গা তিন বছর বয়সে হাসতে  হাসতে সতী হয়েছিল এখনও সেই জায়গাটায় গ্রামের মেয়েরা সিঁদুর ছুঁইয়ে সেই সিঁদুর সিঁথেয় পরে৷ বলে–আমিও যেন ওই রকম সতী হতে পারি৷ কিন্তু জান ঠাকুরপো, তারা কেউই স্বামী মরে গেলে আজকাল আর সতী হয় না৷ বরং স্বামীর পকেট থেকে চাবিগাছাটা বের করে নিজের আঁচলে ৰেঁধে ফেলে৷ তা ঠাকুর–পো, মুখ ফসকে তোমাকে প্রাণের কথা বলেই ফেললুম৷ সেই থেকে আমি পেত্নী হয়ে এই আঁাঁৰগাছটায় রয়েছি আর ঠিক করেছি কোন শিক্ষিত বিচারশীল ছেলেকে দেখলেই তাকে আমার দুঃখের কথা বলব৷ আর বলব, সমাজের যে মাতবৰর গুলো সমাজ রক্ষার নামে পৈশাচিকতা করে গেছে ও আজও করে যাচ্ছে তাদের মধ্যে যেন আক্কেল জাগিয়ে দেওয়া হয়’’৷

পেত্নী–বউদির গল্প শুনতে শুনতে ভোর হয়ে গেল৷ ৰাঁকাচাঁদ গাছ থেকে নেবে পড়ল৷ 

সে বললে–‘‘পেত্নী–ৰউদি, তোমার নামটা কী জানতে পারি’’?

পেত্নী–ৰউদি বললে–‘‘আঁমি তোঁমার ৰঁউদি, এঁইটাই পঁরিচয়৷ নাঁম বঁলে আঁর কেঁলেঙ্কারী বাঁড়াব না’’৷

পেত্নী ৰাঁকাচাঁদকে শুধোলে–‘‘ঠাঁকুর–পো, বঁড়শি কি’নে ঘঁরে ফিরতে তোঁমার অ’নেক দেঁরী হঁয়ে যাঁবে৷ জঁলখাবার কিঁ খেঁয়ে যাঁবে?’’

ৰাঁকাচাঁদ বললে–‘‘কাল রাত্রে পেট ভরে খেয়েছি৷ এত ভোরে তো খিদে পায় নি৷ কী করে খাই বল’’

পেত্নী বললে–‘‘তঁবে তুঁমি এঁকটু বঁস৷ আঁমি এঁকটু জলখাঁবার তঁৈরী কঁরে টিফিঁন কেঁরিঁয়ারে ভঁরে দিঁচ্ছি, সঙ্গেঁ নিঁয়ে যাঁও৷ আঁর নিঁয়ে যাঁও সঁঙ্গে এঁক ফ্লাঁক্স দুঁধ৷ তেঁষ্টা পেঁলে খেঁও৷ জাঁন তোঁ এঁখানকার জঁল ঠিঁক ভাঁল নয়’’৷

ৰাঁকাচাঁদ বললে–‘‘ৰউদি, তোমাকে একটু প্রণাম করি দাঁড়াও’’৷ প্রণাম করতে গিয়ে সে ৰউদির পায়ের পাতা খুঁজে পাচ্ছে না৷ সে আরও দেখলে তার সামনের দিকে রয়েছে গোড়ালি’’৷

পেত্নী বললে–‘‘ঠাঁকুরপো, তুঁমি ভুঁলে গেঁলে আঁমি যেঁ পেঁত্নী৷ সঁতী হঁয়ে স্বঁর্গে যাঁইনি– ঁপঘাতে মঁরে পেঁত্নী হঁয়েছি৷ ঠাঁকুর–পোঁ, তুঁমি মাঁনুষ৷ তুঁমি পেঁত্নীকে প্রণাঁম কঁরতে যাঁবে কোঁন দুঁঃখে জাঁন তোঁ, ভূঁত–পেঁত্নীদের গোঁড়ালি থাঁকে সামঁনের দিঁকে৷ আঁর পাঁয়ের পাঁতা থাঁকে পেঁছন দিঁকে’’৷

‘‘তাদের সুমুখ দিকে গুড়মুড়ো* (*গুড় অর্থাৎ গোড় অর্থাৎ পা৷ মুড়ো অর্থাৎ মাথা অর্থাৎ পায়ের যা মাথা তাই গুড়মুড়ো৷ বর্ত্তমানে শহুরে ৰাংলায় আমরা ‘গোড়ালি’ শব্দই বেশী বলে থাকি) আর পেছন দিকে পা৷’’

পেত্নীকে প্রণাম করবার জন্যে ৰাঁকাচাঁদ তার পেছনের দিকে গেল৷ পেত্নী অনেক কাকুতিমিনতি করে বললে–‘‘ঠাঁকুরপো, তুঁমি শিঁক্ষিত ভঁদ্দরনোক৷ আঁমি আঁৰ গাঁছের পেঁত্নী৷ তুঁমি আঁমাকে পেঁন্নাম কঁরবে কেঁন? দোঁহাই ঠাঁকুরপো, দোঁহাই ঠাঁকুরপো, আঁমাকে পেঁন্নাম কঁরো নাঁ’’৷

ৰাঁকাচাঁদ কোন কথা না শুনে পেছন দিকে গিয়ে পেত্নী–ৰউদির পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে ৰললে– ‘‘তোমাকে পেন্নাম করে আমার পৃথিবীতে আসা সার্থক হ’ল৷ আশীর্ববাদ কর, তোমার কথাগুলো যেন আমার চিরকাল মনে থাকে’’৷

ৰাঁকাচাঁদ এই কথাগুলো আমাকে বলবার সময় অঝোরে কেঁদে ছিল৷