নোটবন্দীর বর্ষপূর্ত্তি ও অন্যান্য আর্থিক গতিপ্রকৃতি

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

দেখতে দেখতে নোটবন্দীর এক বছর পূর্ণ হলো৷  এই একবছরে গঙ্গা-যমুনা দিয়ে  বয়ে গেছে বহু জল--- দেশের বুকে রয়ে গেছে  কত না ঘটনা প্রবাহের স্মৃতি চিহ্ণ৷ তবুও নোটবন্দী নিয়ে বিতর্ক থামেনি - ভালমন্দের চুল চেরা বিশ্লেষণ এখনও সমানে চলেছে৷  একদিকে কেন্দ্রীয় সরকার ও শাসকদল নোটবন্দীর জয়গানে মূখর---  কালো টাকা ধবংস, জাল টাকার বিনাশ, জঙ্গীকার্যকলাপের পায়ে বেড়ি  পড়ানো,  কালোবাজারি ফাটকাবাজীর অবসানে ও সুদূর ভবিষ্যতে আপামর দেশবাসীর সার্বিক উন্নতি বিধানের স্বপ্ণালুতায় মোহাবিষ্ট৷ অন্যদিকে বিরোধী দলগুলির পক্ষ থেকে দেশবাসীর কষ্ট, যন্ত্রণা, নগদের অভাবে কর্মনাশা, সর্বনাশা নোটবন্দীর কুফলগুলির বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ ও নোটবন্দীর বর্ষপূর্তিকে ‘‘কালোদিন’’  হিসেবে ঘোষণা৷  এই দুইয়ের মাঝে সাধারণ দেশবাসী এক অনিশ্চয়তার দোলাচল অবস্থায় অনাগত ভবিষ্যতের পানে তাকিয়ে রয়েছে৷

রাজনৈতিক দলমতের কূটকচালির মধ্যে প্রবেশ না করেও  সাধারণ নাগরিক হিসেবে এই এক বছরে দেশবাসী যে সকল অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে তাকে তো এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়৷  ভোরের ন্ধকার থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত ব্যাঙ্ক-পোষ্টফিসের শাখায় শাখায় দীর্ঘলাইন , প্রয়োজনের সময় সদুপায়ে  উপার্জিত  ও সঞ্চিত অর্থ না পেয়ে চরম দুর্ভোগ এমনকি  মৃত্যুবরণও ,অর্থের অভাবে ব্যবসাপত্র, ছোট ছোট কুটির শিল্পের সর্বনাশ, কর্মহীন মানুষজনের সপরিবারে অনাহারে , অর্র্ধহারে দিনযাপন---ইত্যাদি দুর্বিষহ পরিস্থিতিকে তো মানুষ কিছুতেই ভুলতে পারবে না৷  শুধু  তাই নয়, সব মিলিয়ে দেশে তখন সার্বিক মন্দার পরিবেশ পরিদৃশ্যমান ছিল যার কুপ্রভাব পড়েছে দেশীয় সম্পদবৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতায়৷ পরবর্তীকালে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করে রিজার্ভব্যাঙ্কের প্রতিবেদনে জানানো হয়ে যে এরফলে  সম্পদ বৃদ্ধির হার প্রায় ২ শতাংশ কমে গেছে৷

সরকারের ঘোষিত বক্তব্য অনুসরণ করে দেশবাসী নোটবন্দীর সব কষ্ট সহ্য করে ছিল এই ভেবে যে  কালো টাকা উদ্ধার বা ধবংস ও জাল নোটের রমরমা বন্ধ হলে দেশের উন্নতি হবে৷  কিন্তু পরবর্তী সময় রিজার্ভব্যাঙ্কের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, বাজারে প্রচলিত প্রায় সব বাতিল ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট (প্রায় ৯৮ শতাংশ) সরকারের ঘরে জমা পড়েছে৷ নোটবাতিলের পরও বহু জাল নোট ধরা পড়েছে, এখনও নূতন ২০০০ ও  অন্যান্য অঙ্কের জাল নোট ধরা পড়ছে৷  সুতরাং উপর্যুক্ত দুটি উদ্দেশ্যের কোনটিই সাধিত হয় নি--- শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের হয়রানি ও দুর্র্ভেগই সার হয়েছে৷  নোটবন্দীর যে বিষয়টি সবচেয়ে চমকপ্রদ তা হ’ল , ৮ই নভেম্বর ,২০১৬ সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর ৫০০ ও ১০০০  টাকার নোট বাতিল ঘোষণার সময় যে সময়সীমা, বিধিনির্দেশ ও  উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছিল--- তার কয়েকদিন পর থেকেই  প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন নির্দেশিকা প্রকাশ করে  অজস্রবার নির্দেশনামা পরিবর্তন করা হয়েছে৷  ফলে দেশের মানুষ নিত্যনতুন ভোগান্তির শিকার হচ্ছিলেন৷  এর পরিণামে সেইসময় অসুস্থ, বিদেশে অবস্থিত মানুষ জন আজও দুর্র্ভেগ পোহাচ্ছেন  ও  সুপ্রিমকোর্টে এই সংক্রান্ত মামলার এখনও নিষ্পত্তি হয় নি৷ এই সমস্ত বিষয়গুলি অনুধাবন করলে  বোঝা যায যে নোটবাতিলের সিদ্ধান্ত যথেষ্ট চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা না করেই একটি রাজনৈতিক চমক হিসেবেই ঘোষিত হয়েছিল আর সাধারণ মানুষ চরম সংকটময় পরিস্থিতিতে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন৷

এই একবছর কালের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের আরেকটি সিদ্ধান্তের সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়েছে জনজীবনে৷ ২০১৭ এর জুলাই মাস থেকে সারা দেশে জি.এস.টি নামক ‘‘এক দেশ এক কর ’’ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে৷ জি.এস.টি চালুর প্রথমদিন থেকেই  সাধারণ ব্যবসায়ী ও দেশবাসীর মধ্যে কর হার ও তার প্রয়োগ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরণের বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে৷ এরফলে সবচেয়ে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছেন রোগী ও তাঁদের আত্মীয়স্বজন৷ দীর্ঘদিন বহু ঔষধ ছিল অমিল৷  কারণ জি.এস.টি র বিভিন্ন হারের জন্য উৎপাদন ও সরবরাহের জটিলতা বহাল ছিল৷ এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনলাইনে জি.এস.টি  রিটার্ন ফাইলের জটিল নিয়ম কানুন৷  এই পদ্ধতির সাথে সড়গড় হতে ব্যবসায়ীদের এখনও যথেষ্ট সময় প্রয়োজন৷  ইতোপূর্বে বিভিন্ন পণ্যের জি.এস.টির হার কয়েকবার পরিবর্ত্তিত হয়েছে আর এই  পরিবর্তনের সঙ্গে  তাল মিলিয়ে তাৎক্ষণিক ভাবে সফটওয়ার তৈরী না হওয়ায় ব্যবসায়ীরা পড়ছেন ফাঁপড়ে ৷ বিশেষজ্ঞদের মতে এই ব্যবস্থা তাড়াহুড়োয় না চালু করে আরও  প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল--- সরকার ও ব্যবসায়ী উভয়পক্ষেই ৷ এই অব্যবস্থার ফলে ক্ষতি গ্রস্ত হচ্ছে , ব্যবসায়ী, সরকার ও সাধারণ মানুষ সকলেই৷ জি.এস.টির  প্রভাবে প্রায় সব জিনিসের দাম ঊধর্বমুখী৷ সংবাদে প্রকাশ -গুজরাটের সুরাটের হাজার হাজার তাঁতি তাঁদের তাঁত বিক্রি করে দিয়ে কর্মহীন ও অন্নহীন হয়েছেন৷  এই চিত্র শুধু সুরাটেরই নয় - সারা দেশেই একই অবস্থা৷

নোটবন্দীর আগে পরে আরেকটি বিষয় গোদের উপর বিষফোঁড়ার সৃষ্টি করেছে৷ আগে বাজারে খুচরা পয়সা (১,২,৫, টাকার কয়েন) অপ্রতুল থাকার ফলে বাজার-হাট ,দোকান-পাট, বাস-অটো সবেতেই ক্রেতা -বিক্রেতার খটামটি লেগে  থাকত- এমনকি  মারপিট, রক্তারক্তি, থানা-পুলিশ , আইন-আদালতও হয়েছে৷  নোটবন্দীর সময় গৃহস্থের ভাঁড়ে, কৌটোয়, ব্যাঙ্কের কোষাগারে যত খুচরো ছিল সব বাজারে এসেছে৷  এখন বাজারে নোটের সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার পর এই খুচরো কয়েন গুলি বিপরীত সমস্যার সৃষ্টি করেছে৷  ব্যবসায়ী, দোকানদার,  বাসের কন্ডাকটারদের কাছে ব্যাগভর্তি কয়েন আর এই কয়েনের আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে গণ্ডগোল এমন পর্র্যয়ে পৌঁছচ্ছে যে  এ বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা জনিত সমস্যা দেখা দিচ্ছে৷ অথচ ব্যাঙ্ক বা রিজার্ভব্যাঙ্ক উদ্বৃত্ত কয়েন জমা না নেওয়ায় রাস্তাঘাটে, বাজার হাটে উটকো ঝামেলা চলছে৷  সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্ত্তৃপক্ষের  এ বিষয়ে অবশ্যই দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন ৷

আরেকটি বিষয় খুবই প্রাসঙ্গিক--- বর্তমানে দেখা যাচ্ছে ব্যাঙ্ক-পোস্টফিসের জমা অর্থে সুদের হার ক্রমশঃ নিম্নগামী৷ মেয়াদী জমা,  পি.পি.এফ, ই. পি. এফ, এন.এস.সি ইত্যাদি স্বপ্লসঞ্চয় প্রকল্পে ক্রমান্বয়ে সুদ কমে যাচ্ছে৷  ফলে সাধারণ মানুষ , বিশেষতঃ অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ নাগরিকদের  আয় কমেই চলেছে৷ অপরদিকে জিনিসপত্রের দাম সর্বদাই ঊধর্বমুখী৷ এই জোড়া চাপের পরিণামে তাদের দৈনন্দিন সংসার খরচ চালাতে নাভিঃশ্বাস উঠছে৷ সরকারী চাকুরীরত  বা পেনশনভোগীরাকিছুট সুরাহা পান মহার্ঘ্য ভাতার মাধ্যমে৷ কিন্তু যাদের সে সুযোগ নেই ও শুধুমাত্র সঞ্চিত অর্থের সুদের আয়ে সংসার খরচ নির্বাহ করতে  হয়, ত াদের সম্বন্ধে সরকারকে আরো সচেতন , জনদরদী, বাস্তবমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে প্রতিটি নাগরিক সুষ্ঠু ও সৎভাবে জীবনযাপন করতে পারে৷ তাই সরকারের পক্ষে তাৎক্ষণিক চমকসৃষ্টির পথ পরিহার করে জনগণের কল্যাণকামী প্রকল্পগুলি রচনা ও রূপায়ণের দ্বারা সকলের জন্য অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা প্রভৃতি মৌলিক প্রয়োজন পূর্ত্তির  সঠিক ব্যবস্থা করতে হবে--- আর তখনই গণতন্ত্রের প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধিত হবে৷

নচেৎ গণতন্ত্রের মূল কাঠামো ‘‘জনগণ’’ নির্র্বচনের বাক্সে নাগরিক অধিকার প্রয়োগ করে  শেষ চমক দিয়ে চমকসৃষ্টিকারী নেতৃবৃন্দকে  সমঝে দেবার নীরব অথচ কার্যকরী ধমক লাগাতে বাধ্য হবে৷