প্রাউট–প্রবক্তা প্রভাতরঞ্জনের সাহিত্য চেতনা

লেখক
ডঃ গোবিন্দ সরকার, প্রাক্তন অধ্যাপক, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিক মহাবিদ্যালয়

পূর্ব প্রকাশিতের পর

পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি আজ পরস্পর কাছে এসে গেছে৷ একটা নতুন মানব সংসৃক্তি গডে উঠেছে৷ এটা খুব ভালো লক্ষণ৷ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির ফলে আন্তর্জাতিক সাহিত্য গডে উঠেছে৷ সেখানে দেশ–বিদেশের গণ্ডী উবে যেতে থাকে৷ যেখানে প্রাদেশিকতা স্বাজাত্যবোধের আবেগ বর্জিত এক সার্বজনীন মানব চেতনা পরিলক্ষিত হয়৷ আনন্দমূর্তি বর্ণিত ‘নব্য মানবতাবাদ তত্ত্ব রূপায়িত হয়৷

আনন্দমূর্তির মতে সাহিত্যিকের আলোচ্য বিষয় বা উপজীব্য কী হবে তার ‘গতি প্রকৃতি’ তিনি নির্দেশ করে দিয়েছেন৷ ‘‘কল্পনার নেশা নিয়ে থাকলে চলবে না, ঠিক বাস্তব জগতের ব্যর্থতার কথা শুনিয়ে হতাশার গান গেয়ে মানুষকে নৈরাশ্যবাদের পথে নিয়ে যাওয়া চলবে না৷’’ প্রকাশই কবিত্ব৷ শিল্পী সাহিত্যককে সর্বাত্মক বিকাশ সাধন করতে হবে৷ আর এই বিকাশের মূল   অভিপ্সা সমাজের সর্বাত্মক বিকাশ৷ সমাজ কোনদিকে চলেছে তা লক্ষ্য রাখতে হবে৷ সাহিত্যে নীতিবোধ, চিরন্তন মূল্যবোধ প্রভৃতি সর্বকালীন  ভাবনা চিন্তা চেতনা রূপায়িত করা উচিত বলে মত পোষণ করেন–‘‘নীতির দৃতা যার নেই, পায়ের তলার মাটি যার মজবুত নয়, সে অন্যকে তার স্নিগ্ধ ছায়ায় আনন্দ দেবে কি করে?’’ সাহিত্যিক মানুষকে আলোর পথে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব বহন করবেন–

‘‘নিয়ে চলো

আলোর ঝর্ণাধারার পানে৷৷

আঁধারের ব্যথা আর সয়না প্রাণে৷৷

ঘুমের ঘোর ভাঙানোর গানে গানে৷৷’’

সাহিত্যিকের একটা অন্তর্দৃষ্টি থাকবে, যার অভাবে সৃষ্টি ব্যর্থ হয়ে যায়৷ সেই দৃষ্টির সাহায্যে তিনি মানুষের মনের ক্ষুধা মেটাতে সামর্থ হন৷ বাস্তব জগতের অভিজ্ঞতা পথ চলার পাথেয় বা জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয় সেই অভিজ্ঞতার অভাবে দেবীর আদর্শে মানবীকে না গডে নটীর আদর্শে দেবী মূর্তি গডে ফেলবেন৷ সাহিত্য সমাজের দর্পণ৷ তাঁকে হতে হবে সমাজের প্রতিভূ৷ মানসিক ও সাংসৃক্তিক গতিধারার সমন্বয়ে সাহিত্য গডে উঠবে৷ ‘‘তাদের প্রাণধর্মের সঙ্গে নিবিড সংযোগ রেখে পা ফেলতে হবে৷’’ সাহিত্যে শুধু ইতিহাস, বা বর্তমানের তথ্য সমৃদ্ধ হবে না ভবিষ্যতের সাহিত্যিকের কাছে একটা মূল্যবহন করবে৷ দেশ–কাল–পাত্রকে নিয়ে সাহিত্যিকের কারবার৷

সাহিত্যের ভাষা কি হবে? পণ্ডিতদের মধ্যে সেই বিতর্কের শেষ নেই৷ এ প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানচ্ঞের একটা মন্তব্য অপ্রাসঙ্গিক হবে না–/স্বাভাবিক ঙ্মচলিতক্ষ যে ভাষায় মনের ভাব আমরা প্রকাশ করি, যে ভাষায় ক্রোধ দুঃখ ভালোবাসা ইত্যাদি জানাই, তার চেয়ে উপযুক্ত ভাষা হতে পারে না ও ভাষার যেমন জোর যেমন জোর, যেমন অল্পের মধ্যে অনেক, যেমন যে–দিকে ফেরাও সে–দিকে ফেরে, তেমন করলে তৈরি–ভাষা  কোনো কালে হবে না৷*

বাংলা ভাষা প্রবন্ধে স্বামীজী চলিত ভাষার অনুকূলে জোর সওয়াল করেন৷

আনন্দমূর্তিজীর মত /সাহিত্যিককেও যতদূর সম্ভব তাঁর মাতৃভাষাতেই তা রচনা করতে হবে৷*

সাহিত্যিক পূর্বাপর সম্বন্ধ রেখে   নিজের আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করেন৷ তাঁর ‘চাই প্রজ্ঞার প্রাখর্য, বিবেচনার সতর্কতা ও দরদী মনের মধুর স্পর্শ তিনি তাঁর প্রজ্ঞার আলোক বর্তিকা হাতে নিয়ে অন্যকে পথের নিশানা দেখাবেন৷ আনন্দমূর্তিজী সাহিত্যের ভাষা অহেতুক জটিল করার পক্ষপাতী নন, যথা সম্ভব সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় বক্তব্য পরিষৃক্ত করবেন বলে অভিমত জ্ঞাপন করেন৷ যুগ পরিবর্তনে মানুষের রুচি বদলায়৷ যুগের বিচারে কোনো সাহিত্য আজ কদর্যও বলে চিহ্ণিত হয়৷ বডু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তন কাব্যকে আজ আমরা অশ্লীলতার ছাপ মেরে দিই৷ কোনার্ক মচ্ঞিরের ভাস্ক্র্যকে শ্লীলতা বর্ণিত বলে লেবেল সেঁটে দিয়ে থাকি৷ এতে শিল্পীর দোষ কোথায়? তাতো যুগের সৃষ্টি৷ যুগের চিন্তা ভাবনার ছাপ সেখানে থাকা তো স্বাভাবিক৷ /সভ্যতার উন্ন্দেষের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের শিল্পী মন যেমন যেমন বিকশিত হয়ে উঠেছে, তেমনি তেমনি সে নিজেকে শিল্প মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছে৷”মনীষী আনন্দমূর্ত্তিজীর অভিমত–/মনীষার সঙ্কল্প বিকল্পের মধ্যদিয়ে যে প্রতিভা যুগ থেকে যুগান্তরের দিকে এগিয়ে চলেছে তা মানব সম্পদের চরিতার্থতার বাণী বহন করে চলেছে৷” যুগের ঘাত–প্রতিঘাত ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লডাই করে মনীষার উদ্বোধন ঘটে৷ স্বভাবের ধারা প্রবাহকে ফোটাতে চাই অন্তর্দৃষ্টি, কলমের জোর ও বুকের পাটা৷ সাহিত্যিক জডতাকে প্রশ্রয় দেবেন না৷ সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিকূলতার মধ্যে লডাই করবেন৷ সামাজিক কুসংস্কার, প্রচলিত ধর্মমতের জডতাপূর্ণ আবেষ্টনী, রাজনৈতিক মতবাদের চাপ, সাম্প্রদায়িকতা, প্রাদেশিকতা, জাতীয়তার মিথ্যা অভিমান তথা সংকীর্ণ রাষ্ট্রিক আদর্শের ধাক্কায় তার স্বাধীন চিন্তার স্ফুরণ হতে পারে না৷* সাহিত্যিককে বজ্রনির্ঘোষে নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে হবে৷ সাহিত্য ও শিল্প সাধনা মানব সেবায় নিয়োজিত৷ সাধারণ জীবনের স্থূলতার মধ্যেও যে সূক্ষ্ম রসাভাসটুকু আছে নিজের বক্তব্যের মধ্যে সেটি সুকৌশলে মানুষের চোখে ধরিয়ে দিতে হবে–মনে তার রঙের পরশ লাগিয়ে দিতে হবে৷

মানুষ তার ভাবের অবাধ বিকাশ চায়৷ সাধারণত সহজভাবে সে নিজেকে প্রকাশ করতে প্রয়াসী হয়৷ আনন্দমার্গের স্রষ্টা আনন্দমূর্তিজী আনন্দ বর্জিত সাহিত্যকে সাহিত্য বলতে নারাজ–সাহিত্যে আর সব গুণ থাকা সত্ত্বেও যদি তা  আনচ্ঞের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে তাকে সাহিত্য বলে মেনে নিতে একটু দ্বিধা বোধ করি৷*