প্রাউটের পথেই প্রকৃত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব

লেখক
প্রবীর সরকার

পৃথিবীর বুকে বহু মনীষী এসেছেন৷ তাঁদের মহান বাণীকে বিকৃত করে খণ্ড ক্ষুদ্র ব্যষ্টি স্বার্থ চরিতার্থ করতে কিছু চালাক লোক নিজেদের সংকীর্ণ মতবাদকে তাঁদের বাণী হিসাবে চালিয়ে চলেছে৷ সেই কারণে নানা মতবাদে আজ পৃথিবী ভারাক্রান্ত হয়ে এক ভয়ংকর জ্বলন্ত অগ্ণিকুণ্ডের আকার ধারণ করেছে৷ সব কিছু যেন জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে৷ এই অগ্ণিগর্ভ অবস্থায় যিনি এলেন ও সমগ্র বিশ্বের মানুষ সহ জীবজন্তু, গাছপালাকে নোতুন করে অভয় বাণী দিয়ে গেলেন ও কিভাবে তারা সকলে সার্থকভাবে বিকশিত হবে তার পথ দেখিয়ে গেলেন তিনিই হলেন মহাসম্ভূতি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ওরফে পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার৷ তিনি ঘোষণা করলেন যে পৃথিবীর বুকে মানব সমাজ এক ও অবিভাজ্য৷ সকল মানুষ ভাই ভাই৷ তাদের আর অন্য কোন পরিচয় নেই৷ সৃষ্টির ধর্মই হ’ল বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য৷ সেই বৈচিত্র্যকে স্বীকার করেই মানুষকে আঞ্চলিকতার শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়ে বিশ্বৈকতার লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে৷ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসাবে মানুষকে দৈহিক মানসিক ও আধ্যাত্মিক এই ত্রয়ীর উন্নয়নে সন্তুলন ঘটিয়ে নব্যমানবতার চিন্তাধারাকে সার্থক করে সকলকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে৷ কারণ এগিয়ে চলাই হলো জীবনের ধর্ম৷ কেউ কাউকেও দমন পীড়ন করতে পারবে না.৷ ‘বাঁচ আর বাঁচতে দাও’ হোক জীবনের একমাত্র আদর্শ৷ বর্ত্তমান বিশ্বে সবচেয়ে যেটার অভাব তা হ’ল সৎ নীতিবাদী আদর্শবান মানুষ৷ পরমারাধ্য মার্গগুরু তথা প্রাউট–প্রবক্তা সেই নীতিবাদী সৎ মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে আবির্ভূত হয়ে আজীবন মানব কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করে গেছেন৷ আনন্দমার্গের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হ’ল ‘আত্মমোক্ষার্থৎ জগদ্ধিতায় চ’–মানুষকে আধ্যাত্মিক জীব হিসাবে আত্মমোক্ষের সন্ধান করতে হবে আর জগৎ কল্যাণে ব্রতী হতে হবে৷ কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে চিরকাল যা হয়ে এসেছে আজও কিন্তু তাই হচ্ছে৷ কিছু বিপথগামী স্বার্থান্বেষী ব্যষ্টি আদর্শচূ্যত হয়ে ব্যষ্টিস্বার্থ সিদ্ধিতে মগ্ণ হয়ে সমাজের ক্ষতিসাধন করে চলেছে৷ মহান আদর্শকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করছে৷ তিনি জগতের সার্বিক কল্যাণে একাধারে যে ৩৬০০ পূর্ণাঙ্গ দর্শন দিয়েছেন তাতে সব কিছুরই সমন্বয় সাধিত হয়ে বিশ্ব কল্যাণের পথকে সার্থক করে তুলতে সক্ষম বলেই আজ বিবেচিত হচ্ছে৷

আমরা অতীতের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখেছি যে সমগ্র মানব জাতির ধর্ম এক ও অবিভাজ্য৷ কিন্তু সেই ধর্মকে পাশ কাটিয়ে মানুষ বাহ্যিক কিছু আঞ্চলিক অনুষ্ঠান উৎসব ক্রিয়াকর্মকে মুখ্য করে ধর্মের মোড়কে চালিয়ে যাচ্ছে সুপ্রাচীনকাল হতে কিছু তথাকথিত ধর্মব্যবসায়ীর নির্দেশ মোতাবেক৷ তারা সরল মানুষের মনে ভয় জাগ্রত করে জাগতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভক্তির উদ্রেক ঘটানোর চেষ্টা করে৷ এর ফলে আজ যুক্তিবাদী মানুষ সেই সব অনুষ্ঠানের অসারতা উপলব্ধি করেই প্রকৃত অধ্যাত্ম দর্শনের পথে এগিয়ে চলেছে৷ আর মানুষের তৈরী সামাজিক ভেদাভেদকেও স্বীকার করে না৷ তাই জাতপাতের অন্ধবিশ্বাস থেকে মানুষের সমাজ ধীরে ধীরে মুক্ত হচ্ছে৷

মানুষ নারী–পুরুষ নির্বিশেষে যত উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হবে প্রকৃত ধর্ম সম্বন্ধে সচেতন হবে ও আত্মিক সাধনার দ্বারা পারমাত্মিক সত্তার দিকে এগোবে ততই মানুষ সংকীর্ণতা মুক্ত হবে ও মানবিক মূল্যবোধ সম্বন্ধে সচেতন হয়ে বিশ্বভ্রাতৃত্বের অস্তিত্ব উপলব্ধি করবে৷ তখনই মানুষ অনুভব করবে ভূমাকে লাভ করাতেই সুখ অন্য কিছুতেই নয় ও অমৃতের পুত্রগণকে সেটাই শুণতে ও মেনে চলতে হবে৷

বাস্তবে কিন্তু দেখা যায় নিছক ভোগ সর্বস্ব দৈহিক সুখের জন্য মানুষ ইহ জগতের স্থূলবস্তুকে কুক্ষিগত করতে ছল–বল–কৌশলে বুদ্ধির জোরে অন্যকে বঞ্চিত করে শোষণ করে সম্পদ সঞ্চয় করে চলেছে৷ তাই যে নীতি অদ্যাবধি চলে আসছে তাহলো ‘জোর যার মুলুক তার’৷ বীর ভোগ্যা বসুন্ধরা৷ তারই ফলে এই ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহের সৃষ্টি হয় সেটা সেই ভয়ংকর শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়ার ফল৷ কিন্তু এর পর যারা শাসন ক্ষমতা দখল করল তারা সমাজকে শোষক ও শোষিত শ্রেণীতে ভাগ করে ঘৃণা, হিংসা, বিদ্বেষকে হাতিয়ার করে সমাজকে আরো অশান্ত করে তোলে৷ বিংশ শতাব্দী পৃথিবীর ইতিহাসে এক স্মরণীয় শতাব্দী৷ এই শতাব্দীতে পৃথিবীতে দেখা দেয় পরপর দুটি মহাযুদ্ধ৷ প্রথম মহাযুদ্ধের কিছু পরে তথাকথিত শ্রমিক শ্রেণীর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে রাশিয়াতে কমিউনিষ্ট শাসনের সূত্রপাত৷ সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শাসনের ধীরে ধীরে অবসান হয় বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পঞ্চম দশকের মধ্যভাগ হতে৷ এছাড়া দুটো মহাযুদ্ধে যে ভয়ংকর মানব সভ্যতার ক্ষতি হয় তার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে বিশ্বের বুকে জন্ম হয় ইউ এন ও–এর৷ মানুষ অনুভব করে বিশ্বের বুকে একটি সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রয়োজন৷ অন্য রাষ্ট্রগুলি তারই অধীনে চলবে৷ যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী হবে৷ কিন্তু তাতেও কোন ফল হ’ল না৷ এই পরিপ্রক্ষিতে বিশ্বের মানব সমাজের ও অন্যান্য জীবজন্তু, গাছপালার রক্ষার সংকল্প নিয়ে আনন্দমার্গ তথা নব্যমানবতাবাদ তথা ‘প্রাউট’ দশনের আবির্ভাব৷ ১৯৫৫ সালে ভারতের বুকে এই আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও আর্থিক সংঘটনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রদ্ধেয় প্রভাতরঞ্জন সরকার যিনি একাধারে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী নামে খ্যাত–তিনিই উপরিউক্ত আদর্শের প্রবক্তা৷

আজ আর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কিংবা জড়বাদী তথাকথিত সাম্যবাদী শক্তি বিশ্বের বুকে ভয়ংকর ধ্বংস সাধন করতে পারবে না কারণ বিশ্বের বুকে অধ্যাত্মবাদে প্রতিষ্ঠিত প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব বিশ্বের বুকে কড়া নাড়ছে৷ এই একবিংশ শতাব্দী হ’ল গণ অর্থনীতির যুগ৷ সার্বিক শোষণমুক্তির আন্দোলনে সমগ্র বিশ্ব আজ মুখরিত৷

তাই বর্তমান বিশ্বে যম নিয়মে প্রতিষ্ঠিত আধ্যাত্মিকতায় উদ্বুদ্ধ মানবতাবাদী প্রাউটিষ্টদের সার্বিক শোষণমুক্তির আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে৷ কারণ মানবসমাজ তথা পৃথিবীর অন্যান্য সৃষ্ট জীবজন্তু, গাছপালাকে রক্ষার ও তাদের বিকাশ ঘটানোর বিষয়টা যদি সকলে আন্তরিকতার সঙ্গে চিন্তা ভাবনা না করে তাহলে ভয়ংকর বিপর্যয় দেখা দেবে অদূর ভবিষ্যতে৷ আজ পৃথিবীতে সবচেয়ে যার দারুণ অভাব তা হলো সৎনীতিবাদী মানুষ৷ মার্গগুরু তাই মানুষ গড়ার কঠিন দায়িত্ব গ্রহণ করেন৷ সারা পৃথিবীতে তিনি তাই তাঁর সংঘটনকে ছড়িয়ে দেন নয়টি সেক্টারে যাতে মানুষ আধ্যাত্মিক অনুশীলন করে সৎ নীতিবাদী হয়ে জগৎকল্যাণে ব্রতী হয়৷ আরপ্রত্যেক মানুষ যাতে অন্ন–বস্ত্র–শিক্ষা–চি ও বাসস্থান পায় তার জন্যে প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব (প্রাউট) নামে আর্থিক তথা সামাজিক দর্শন দিয়েছেন যার মাধ্যমে মানুষ গণ অর্থনীতিকে বাস্তবায়িত করে প্রতিটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াবার সুযোগ পায়৷ নিত্য প্রয়োজনীয় উৎপাদন ও বণ্টনে যেন ন্যায়সঙ্গত সামঞ্জস্য বর্তমান থাকে৷ কৃষি ও শিল্পের ক্ষেত্রে যেন ভারসাম্য বজায় থাকে৷ ভোগ্যবস্তু উৎপাদনে ব্লক ভিত্তিক সমবায় আন্দোলনকে অগ্রাধিকার দিয়ে ব্যাপক ভাবে কর্মক্ষম নরনারীকে রুজিরোজগারের সুযোগ দান করে কর্মদ্যোগ বড়িয়ে বেকার সমস্যার অভিশাপ হতে পৃথিবীকে মুক্ত করতে হবে৷ কৃষি ও শিল্পে কর্ষক ও শ্রমিককে মালিকানার অংশীদার করে তাদের কর্মদ্যোগকে বাড়িয়ে তুলে উৎপাদনে বিপ্লব আনতে হবে৷ তবেই ব্যষ্টি বা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার শোষণ হতে সমাজ রক্ষা পাবে ও মানুষেরসমাজ এগিয়ে যাবে৷ বণ্টনের ক্ষেত্রেও সেই সমবায়ের মাধ্যমে ক্রয়বিক্রয়ের ব্যবস্থাকে চালু করতে হবে৷ সকলকে নিয়ে বাঁচবো, এক সঙ্গে চলবো৷ এই মানসিকতাকে জাগ্রত করতে দরকার সদিচ্ছা ও হূদয়ের ব্যাপ্তি৷ প্রাউটিষ্টরা প্রাউটের সেই মহান দায়িত্ব পালনে ব্রতী হয়েছে৷ এটাই সমস্যা সংকুল বিশ্বকে প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাবে অদূর ভবিষ্যতে৷ তাই সময় নষ্ট না করে সকল নীতিবাদীদের প্রাউটের পতাকাতলে সমবেত হয়ে বিশ্বকল্যাণে ঝাঁপিয়ে পড়তেই হবে৷