প্রাউটের আর্থিক ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য বিশ্বের যে সম্পদ আছে তা কখনই মুষ্টিমেয় কিছু পুঁজিপতিদের হাতে কুক্ষিগত হতে দেওয়া যাবে না৷ প্রয়োজনাতিরিক্ত অবাধ সঞ্চয় প্রাউট সমর্থন করে না৷ প্রাউট পুঁজিবাদের অবাধ সঞ্চয়নীতিকে সমর্থন করে না, আবার কম্যুনিজমের পথে সম্পদের রাষ্ট্রীয়করণকেও সমর্থন করে না৷ এ বিষয়ে প্রাউটের সুস্পষ্ট নীতি আছে৷ সামাজিক, অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা থাকবে৷ কিন্তু জোরে সংখ্যাগরিষ্ঠকে বঞ্চিত করে স্বল্প সংখ্যক মানুষের অবাধ সঞ্চয়ের পুঁজিবাদী প্রবণতাকে দমন করে প্রাউট প্রতিটি মানুষের জন্যে দেশ কাল পাত্র অনুযায়ী আর্থিক পরিস্থিতি বিচার করে সঞ্চয়ের পরিমাণ নির্দ্ধরণ করে৷
তাই প্রাউটের আর্থিক ব্যবস্থার মূল কাঠামো সমবায় ভিত্তিক৷ সমবায় পরিচালিত আর্থিক ব্যবস্থাই সমাজের সর্বশ্রেণীর সর্বস্তরের মানুষের সার্বিক বিকাশের সহায়ক হবে৷ বর্তমানে সমবায়ের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ সমবায় পরিচালকদের নৈতিকতার অভাব৷ তাছাড়াও প্রশাসনিক দুর্বলতাও সমবায়কে গ্রহণ করার মানসিকতার অভাব৷
আলোচনার বিষয় যেহেতু প্রাউটের শিল্পনীতি তাই সমবায় প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনায় যাব না৷ আমার আলোচ্য বিষয় প্রাউটের শিল্পনীতি কেমন হওয়া উচিত৷
প্রাউটের শিল্পনীতি ঃ ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যষ্টিগত মালিকানায় সমস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়৷ এতে এক শ্রেণীর মানুষ অতি ধনী হয়ে পড়ে৷ এই পুঁজিপতিরা মুনাফার দিকে তাকিয়ে শিল্প গড়ে, দেশের উন্নতির দিকে তাকিয়ে নয়৷ তাই এরা লাভের দিকে তাকিয়ে শিল্পকে কেন্দ্রীভূত করে৷ ফলে সারা দেশে শিল্প গড়ে ওঠে না, বিশেষ বিশেষ শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠে৷ এতে একদিকে যেমন নাগরিক জীবনের কদরতা বাড়ে, অন্যদিকে গ্রাম অবহেলিত হয়৷ দ্বিতীয়তঃ পুঁজিবাদী শিল্পনীতির ফলে দেশে বেকার সংখ্যা দ্রূত বাড়তে থাকে৷ কারণ আধুনিক বৃহৎ শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় গ্রামীণ ক্ষুদ্র শিল্প ধবংস হয়ে যায়৷ বৃহৎ শিল্পে যারা কাজ পায়, তার চেয়ে অনেক বেশী মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে৷ তৃতীয়তঃ পুঁজিপতিরা একচেটিয়া কারবার করে’ ইচ্ছামত মূল্যবৃদ্ধি ঘটায়৷ চতুর্থতঃ দেশের মূলধন সকল সময় অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদন বাড়ানোর কাজে লাগে না, বরং বিলাসদ্রব্য উৎপাদনের কাজে ব্যবহূত হয়৷ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের পর্যাপ্ত উৎপাদন করে’ দেশের মানুষের কল্যাণসাধন করা উচিত৷ কিন্তু পুঁজিপতিরা এই নীতিবোধে উদ্বুদ্ধ না হয়ে মুনাফা অর্জনের প্রেরণায় শিল্প গড়ে৷ তাই লাভজনক বিবেচনায় ধনিকশ্রেণীর প্রয়োজনে অতিবিলাসের সামগ্রীই প্রস্তুত করে৷ পঞ্চমতঃ সমাজের অধিকাংশ মুষ্টিমেয় সম্পদ মানুষের কুক্ষীগত হবার জন্যে ফলে চারিদিকে অভাবের মাত্রা চরম হওয়ার সুযোগ নিয়ে পুঁজিপতিরা টাকার জোরে দেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, এমনকি তথাকথিত আনুষ্ঠানিক ধর্মগুলিকেও নিজ স্বার্থে নিয়ন্ত্রিত করে৷ ফলে এই সমস্ত কিছুর অবনতিতে দেশের সভ্যতা---সংস্কৃতি অধোগতি প্রাপ্ত হয়৷
মিশ্র অর্থনীতিতে ধনতান্ত্রিক কাঠামোকে ধবংস তো করাই হয় না, ধনতান্ত্রিক সমাজের সমস্ত বদগুণগুলি থেকে যায়৷
কম্যুনিজ দেশের সমস্ত শিল্প বাণিজ্যকে রাষ্ট্রীয়করণ করার কথা বলে৷ তাতে ব্যষ্টি বা শ্রেণীগত ধনতন্ত্রের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় ধনতন্ত্রের উদ্ভব হয়, আর শিল্প উৎপাদনে ইন্সেন্টিভ না থাকার ফলে অর্থনীতির বিকাশের গতিও হ্রাসপ্রাপ্ত হয়৷
তাই প্রাউট দেশের শিল্পব্যবস্থাকে ৩ ভাগে ভাগ করেছে৷ (১) দেশের মূল বৃহৎ শিল্পগুলি থাকবে স্থানীয় সরকারের হাতে৷ মূল শিল্প বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই সমস্ত শিল্পগুলিকে যেগুলি জনসাধারণের ভোগ্যপণ্য প্রত্যক্ষভাবে উৎপাদন করে না, অন্যান্য শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদন করে৷ অর্থাৎ যাদের ওপর অন্যান্য শিল্প নির্ভর করে৷ যেমন, লোহা ও ইস্পাত শিল্প, এগুলি না---লাভ না---ক্ষতির ভিত্তিতে চলবে৷ (২) অন্যান্য সমস্ত বৃহৎ ও মাঝারি শিল্প চলবে সমবায় নীতিতে৷ (৩) ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুটির শিল্পগুলি কেবল মাত্র ব্যষ্টির উপর ছেড়ে দেওয়া হবে৷ ব্যবসা বাণিজ্যও যতদূর সম্ভব সমবায়ের মাধ্যমে পরিচালিত হবে৷ সমবায় অর্থনীতিকে সার্থক করে তুলতে গেলে বিশেষ কতকগুলি ব্যবস্থা নেওয়া অত্যাবশ্যক, যা না হলে সমবায় সফল হবে না৷ সেগুলি হ’ল---(১) কঠোর তত্ত্বাবধান৷ (২) সাামবায়িক মনস্তত্ব৷ (৩) এ সবের অভাবেই আজ সমবায় ব্যর্থ হচ্ছে৷
বর্তমানে সমবায়গুলির ব্যর্থতার জন্যে সমবায় সম্পর্কে মানুষের উৎসাহ তত বেশী নেই৷ আসলে সমবায় করলেই কেবল চলে না, সমবায়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে ও সমবায়কে রক্ষা করবার জন্যে রাষ্ট্রকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে৷ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমবায়ই মানবতার মূর্ত প্রতীক৷
পুঁজিবাদের সঙ্গে সরাসরি প্রতিযোগিতায় সমবায়গুলির টিঁকে থাকা কষ্টকর৷ কারণ ধূর্ত পুঁজিপতিরা তাদের বিশাল পুঁজির জোরে সমবায়গুলিকে ভেঙ্গে দেবার চেষ্টা করে৷ তাই পুঁজিবাদীদের আগ্রাসন থেকে সমবায়কে সর্বতোভাবে রক্ষা করতে হবে৷
- Log in to post comments