প্রাউটের সমাজ আন্দোলনের লক্ষ্য স্থানীয় মানুষের হাতে থাকবে অর্থনৈতিক ক্ষমতা

লেখক
মনোজ দেব

আজ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একমাত্র পথ হিসেবে মেনে নিয়ে আপন আপন কর্মসূচী নিয়ে কাজ করে চলেছে৷ তারা দেশে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যা সমাধানের জন্যে দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিদের শরণাগত৷ দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিরা যাতে রাজ্যে তাদের মোটা পুঁজি বিনিয়োগ করে’ শিল্প গড়ে তুলতে এগিয়ে আসে, সেজন্যে ওই পুঁজিপতিদের নানান ভাবে তোষণ করে চলেছে৷ তাদের নানাভাবে প্রলোভন দিচ্ছে৷ সস্তায় জমি, বিদ্যুৎ, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে করছাড় ইত্যাদির আশ্বাস দিয়ে নানাভাবে তাদের মন ভেজানোর চেষ্টা করছে৷ বাম আমলেও দেখা গেছে কট্টর মার্কসবাদী বলে পরিচিত সিপিএম সহ অন্যান্য সঘোষিত সমাজতন্ত্রী বামপার্টিগুলিও দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিদের পদতলে তৈল মর্দনের জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছিল৷ বাম শিরোমণি জ্যোতি বসু দফায় দফায় বিদেশ যাত্রা করতেন কেবল ওই সব দেশের পুঁজিপতিদের আমাদের রাজ্যে পুঁজি বিনিয়োগ করার জন্যে আমন্ত্রণ জানাতে৷ বর্তমানে দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা এই একই পথে হাঁটছেন৷ মানে, এঁদের সবার বদ্ধমূল ধারণা পুঁজিপতিদের পুঁজি বিনিয়োগ ছাড়া দেশের অর্থনৈতিক সমাধান সম্ভব নয়৷

কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখেছি? বিদেশী পুঁজিপতিরা এক সময়ে বাঙলায় তথা ভারতে ব্যবসা করার সুযোগ নেয়, পরে ‘বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ডরূপে’৷ ২০০ বছর ধরে দেশের ওপর দিয়ে তারা শোষণের ষ্টীম রোলার চালিয়ে গেল৷ সেই শোষণের হাত থেকে মুক্তি পেতে কত মানুষকে যে প্রাণ দিতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই৷ হাজার হাজার ত্যাগব্রতী মানুষের জীবনপণ আন্দোলন, কারাবাস, দীপান্তর ও ফাঁসী বরণের পর আমরা এই আধা স্বাধীনতা লাভ করেছি৷ আধা স্বাধীনতা এই জন্যে বললুম যে, ব্রিটিশ শাসকের শাসন থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি৷ কিন্তু দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিদের শোষণ থেকে মুক্তি পাইনি৷ মুক্তি পাওয়ার কথা তো দূর অস্ত্‌ আমরা ওই পুঁজিপতিদের মোহ বন্ধনে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে গেছি৷

শুধু আমাদের দেশ কেন---আজ গোটা দুনিয়ার এই হাল! এই পুঁজিপতিদের দেশ আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানী প্রভৃতি দেশেও বেকার সমস্যা চরম আকার নিচ্ছে৷ ধনবৈষম্য চরম রূপ নিচ্ছে৷ আর তার ফলে পুঁজিপতিরা অর্থবলে সমাজের কেবল অর্থনীতি নয়, সমাজ-সংস্কৃতি- রাজনীতি সবকিছুকে কবলিত করে তাদের শোষণের জালকে এমনভাবে বিছিয়ে দিচ্ছে যে এর থেকে বাইরে বেরুনো এখন খুব কঠিন হয়ে উঠেছে৷

আর এইভাবে তারা গোটা সমাজকে কুক্ষিগত করে’ কলুষিত করছে৷ মানুষের উন্নত সংস্কৃতি, সভ্যতা, ধর্মচেতনা সব কিছুকেই ধবংস করে চলেছে৷ এখন পুঁজিবাদীদের শোষণের এই অক্টোপাশ থেকে মানব জাতিকে মুক্ত হতে হবে৷ নাহলে মানব সংস্কৃতি ও সভ্যতা ধবংস হয়ে যাবে৷ ধনবৈষম্য, দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যাও সারা পৃথিবী জুড়ে চরমভাবে বেড়ে চলেছে এই ধনতান্ত্রিক অবস্থার জন্যে৷ এই অবস্থায় কিছু মানুষ পুঁজির সুবিশাল পাহাড় রচনা করছে৷ চরম বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিচ্ছে, তার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিপুল পরিমাণ সম্পদের অপব্যবহার করে সমাজে অসংস্কৃতির ‘সুনামী’ বইয়ে দিচ্ছে৷

এককথায় এই পুজিবাদী শোষণের অক্টোপাশ থেকে সমাজকে মুক্তি পেতেই হবে৷ কিন্তু কী করে? পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে সারা বিশ্বজুড়ে মার্কসবাদীরা মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে৷ শেষ পর্যন্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চরণে আত্মসমর্পণ করেছে৷

এখন উপায় কী? উপায় একমাত্র ‘প্রাউট’---প্রগতি- শীল উপযোগ তত্ত্ব৷ একথা আমরা বহুবার নানান্‌ যুক্তি সহকারে বুঝিয়েছি৷ পুঁজিবাদ ও মার্কসবাদ দুই-ই অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণের ওপর আধারিত৷ ধনতন্ত্রে শিল্পপতিরা---ব্যবসায়ীরা অর্থের কেন্দ্রীকণরণ ঘটায়, আর মার্কসবাদ তো আসলে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ৷ জনগণের হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতা আসে না৷

প্রাউটের পথে কীভাবে জনগণের হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতা আসবে? তার উত্তর--- প্রাউট নির্দেশিত সমাজ আন্দোলনের পথ ধরেই জনগণের অর্থনৈতিক ক্ষমতা আসবে৷ প্রাউট বর্তমানে বিভিন্ন অঞ্চলের সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে অর্থাৎ অথনৈতিক সম্ভাবনা, সম-অর্থনৈতিক সমস্যা, জনগোষ্ঠীগত (এথ্‌নিক) বৈশিষ্ট্য, সাধারণ সাংবেদনিক উত্তরাধিকার (সেণ্টিমেণ্টাল লিগ্যাসী) ও একই ধরণের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে স্বয়ং সম্পূর্ণ সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইয়ূনিট) গড়ে তোলার নীতিতে বিশ্বাসী৷ আর এই সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলকে সর্বাত্মকভাবে শোষণমুক্ত করার আন্দোলন করতে হবে৷ প্রাউটের পরিভাষায় এটাই হ’ল যথার্থ ‘সমাজ আন্দেলন’৷ এই সমাজ আন্দোলনের প্রাথমিক লক্ষ্য হ’ল সংশ্লিষ্ট সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রতিটি মানুষের  হাতে দৈনন্দিন জীবনের নূ্যনতম চাহিদাপুরণের ক্রয়ক্ষমতা ১০০ শতাংশ স্থানীয় মানুষের কর্ম সংস্থানের গ্যারাণ্টি প্রদান৷ আর তা করতে গেলে অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করতে হবে৷ স্থানীয় মানুষের হাতেই থাকবে অর্থনৈতিক ক্ষমতা, বহিরাগত পুঁজিপতিদের হাতে নয়৷ ব্লক ভিত্তিক পরিকল্পনা, সমবায়ের আদর্শে কৃষিভিত্তিক ও কৃষিসহায়ক শিল্পের দাবীতে অর্থনৈতিক শোষণমুক্তির আন্দোলনই হবে এর মাধ্যম৷ প্রাউটিষ্ট সর্বসমাজ সমিতি এই অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের নীতি নিয়ে ভারতবর্ষের সর্বত্র অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলন গড়ে তুলছে৷ তাদের এই সর্বাত্মক শোষণমুক্তির আন্দোলনের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য, নতুনত্ব তথা এর প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে দেশের সমস্ত বুদ্ধিজীবী, কর্ষক, শ্রমিক ছাত্র-যুব তথা মহিলাদের বিশেষভাবে অবহিত হতে হবে৷ সচরাচর অন্যান্য যে সব আন্দোলন আমরা দেখতে অভ্যস্ত তা থেকে এই আন্দোলন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র৷ কারণ এর পেছনে রয়েে’ছ আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠার এক নোতুন আদর্শ৷