তাপপ্রবাহে জ্বলছে দক্ষিণবঙ্গ মানুষ অতীষ্ঠ৷ সবার মুখে একই কথা---আর কতদিন এই গরম চলবে আর যে পারছি না এই গরম সইতে!
কিন্তু কেন এই অস্বাভাবিক গরম! এর একটাই কারণ---অবিবেচকের মত আমরা প্রকৃতির বুকে ছুরি মেরে চলেছি, বনজঙ্গল ধবংস করছি, পরিবেশের সামঞ্জস্যকে ধবংস করছি আমাদের সংকীর্ণ ‘আত্মস্বার্থ’ রক্ষার জন্যে৷ আমরা কেবল আমাদের নিজেদের সাময়িক সুখ---আরামটাই দেখছি৷ আমার চারপাশের মানুষ--- পশুপক্ষী---উদ্ভিদ নিয়ে বৃহত্তর সমাজ---বৃহত্তর প্রাকৃতিক পরিবেশ, তার দিকে আদৌ নজর দিচ্ছি না৷ গত মঙ্গলবার, ৫ই জুন, সারা দেশে ঘটা করে পরিবেশ দিবস পালিত হ’ল৷ ব্যস, তারপর সব ভুলে গেলাম৷ পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা কি কেবল বছরে একটা দিনের জন্যেই! এটা কি প্রকৃত সচেতনতা, না, সচেতনতার অভিনয় আমরা তো সব ব্যাপারে আজকাল অভিনয় করতে ও অভিনয়? দেখতেই বেশি অভ্যস্ত৷ অভিনয়টাই আমাদের পছন্দ৷ বাস্তব ততটা বোধ হয় আমাদের পছন্দ নয়৷ তাই সারা বছর আমরা পরিবেশের সামঞ্জস্য রক্ষার কথা ভুলেই থাকি৷ ভুলে যাই তো বলব না, আমরা জানি, জেনেই ইচ্ছে করে ভুলে থাকি৷ ভুলে থাকি ‘আত্মসুখের’র জন্যে৷ কিন্তু আমার স্বার্থের সঙ্গে সমগ্র মানবসমাজের স্বার্থ ---শুধু মানুষ নয়---সমস্ত মানুষ-পশুপক্ষী নিয়ে সমস্ত বিশ্বপ্রকৃতির স্বার্থ---বিশ্বপ্রকৃতির সামঞ্জস্য যে এক সূত্রে গাঁথা---এই চরম সত্যটা আমরা ভুলে থাকি৷
এই সব কিছু নিয়েই তো পরিবেশ! আমার চারপাশের মানুষ-পশু-উদ্ভিদ, মাটি-জল-বাতাস, দৈহিক---মানসিক---আত্মিক---সবকিছু নিয়ে সমগ্র পরিবেশ৷ ত্র্যম্বক সামঞ্জস্য৷ সর্বক্ষেত্রেই ‘প্রমা ত্রিকোণ’ তথা সামগ্রিক সামঞ্জস্য রচনা করতে হবে৷ একথাই বলেছেন মহানদার্শনিক ঋর্ষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার৷ এছাড়া মানবসমাজের বাঁচার কোনো উপায় নেই৷ একে অবহেলা করে আত্ম---সুখের নেশায় অন্ধ হয়ে ছুটে চললে মানুষ নিজেদের পায়ে কুড়ুল মেরে---নিজেদের ধবংস ডেকে আনবে৷
আত্মস্বার্থ---আত্মসুখের উগ্র নেশা আত্মহননের পথ৷ তাই মানুষ---পশুপক্ষী--- তরুলতা সবাইকার জন্যে ভাবতে হবে৷ এটাকেই জীবনের একান্ত ব্রত হিসেবে গ্রহণ করতে হবে৷ এরই নাম নব্যমানবতাবাদ৷ অর্থাৎ মানবতাবাদের নোতুন ব্যাখ্যা, মানবতাবাদকে আত্মসুখের কূপমণ্ডুকতা থেকে উদ্ধার করে ভূমার---বিশ্বপ্রাণের অসীম পরিবেশে বিস্তারিত করে দেওয়া৷ এই নব্যমানবতাবাদের মধ্যেই রয়েছে আজকের বিশ্বের সমস্ত সমস্যার সমাধানের চাবিকাঠি৷
এই নব্যমানবতাবাদের আদর্শে আমাদের চিন্তা ভাবনাকে ঢ়েলে সাজাতে হবে৷ আজকাল পরিবেশ দিবসের ভাষণে---প্রবন্ধে বলা হয়---আমাদের বাঁচার স্বার্থে বৃক্ষরোপণ চাই---বনকে ধবংস করা যাবে না৷ না, এভাবে ভাবলে চলবে না৷ তাহলে গাছপালা---পশুপক্ষীর প্রতি ভালবাসা জাগবে না৷ আত্মস্বার্থটাই প্রকট হয়ে থাকবে৷ সবাই আমরা বিশ্বস্রষ্টার সন্তান৷ মানুষ তাঁর শ্রেষ্ঠ সন্তান তাই মানুষের দায়িত্ব অনেক বেশী৷ প্রভাত সঙ্গীতের ভাষায়---
‘‘মানুষ যেন মানুষের তরে সব কিছু করে যায়
একথাও যেন মনে রাখে পশু পাখি তার পর নয়
তরুও বাঁচিতে চায়’’৷
এই বোধকে জাগাতে হবে৷ এইটাই নব্যমানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী৷ বলা বাহুল্য, আধ্যাত্মিকতাই নব্যমানবতাবাদের ভিত্তিভূমি৷ তাই কেউ যদি ভাবেন, আধ্যাত্মিক চিন্তা ধারাকে সম্পূর্ণ বর্জন করে আমি আমার মনের পূর্ণ বিস্তার ঘটাব, তাহলে কিন্তু ব্যর্থ হতে হবে৷
মোট কথা, এই পৃথিবীকে যথাযতভাবে বাসযোগ্য করতে গেলে, সকলের জীবন ধারণ ও জীবন বিকাশের অনুকূল পরিবেশ গড়তে হবে৷ গাছপালা, পশুপক্ষীকে ধবংস করে বাঁচার চিন্তা করলে চলবে না৷ সবাইকে বৃহত্তর সমাজের সদস্য হিসেবে ভেবে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে চলবার মানসিকতা গড়তে হবে৷ জাগতিক পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক পরিবেশও সমস্ত প্রকার দূষণের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে৷ এই হোক আমাদের প্রকৃত জীবন সাধনা৷ জীবনের এই মৌলিক---গভীরতর দিকটিকে উপেক্ষা করে আমরা কোনোভাবে এগিয়ে যেতে পারব না, আমাদের মহত্তর লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না৷
- Log in to post comments