কালচক্রের বিধানে আর একটা ২১শে অক্টোবর পেরিয়ে গেল৷ এই দিনটি আনন্দমার্গীদের কাছে অতীব দুঃখের! পরমারাধ্য ৰাৰা এই দিন আমাদের ছেড়ে চলে যান তাঁর ইহলীলা ত্যাগ করে! তিনি এক মহান কর্মযোগী৷ তাই তিনি কাউকে না জানিয়েই চলে যায়৷
তিনি রেখে যান তাঁর বিশ্ব জোড়া সংঘটন আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘ আর সারা পৃথিবীর ১৮২টি দেশে লক্ষ লক্ষ ভক্ত যাঁরা মহান কর্মযজ্ঞে যুক্ত৷ তাঁর আবির্ভাব সেই মহা পবিত্র বিহারের জামালপুরে ২১শে মে ১৯২১শে আর তিরোধান সেই ১৯৯০ এর ২১শে অক্টোবর সেই কলকাতার তিলজলার আনন্দমার্গ আশ্রমে৷
তাঁর কর্মকাণ্ডটাই নোতুন৷ তিনি একজন লৌকিক গৃহী কর্মযোগী৷ কিন্তু তাঁর কর্মকাণ্ডটা সেই সর্বক্ষণের অবধূত, অবধূতিকা যাঁরা সর্বত্যাগী ব্যষ্টিত্বের অধিকারী কিন্তু সমাজ কল্যাণে আত্মনিবেদিত প্রাণ৷ যে কর্মগুলি তারা করে---সেগুলি গৃহীদের চেয়ে শত গুণ বেশী৷ গৃহী আচার্য তাত্ত্বিক ও সাধারণ গৃহীগণ নারী পুরুষ নির্বিশেষে পূর্ণক্ষণের আর পার্টটাইমার হিসাবে কর্মরত সমাজ কল্যাণে৷ কারণ তাঁর লক্ষ্য ছিল সমাজ গড়া৷ সৎনীতিবাদী আধ্যাত্মিক আদর্শে অনুপ্রাণিত ও জাতি, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে নব্যমানবতাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ এক মানব সমাজ৷ একটি চরম সত্য কথা তা হলো সেই আত্মজ্ঞান সম্পূর্ণ ধার্মিক নীতিবাদী সৎ না হলো মানুষের সমাজে কোনদিন শান্তি আসবে না৷ এটি বড়ই কঠিন কাজ! সেই কঠিনতম কাজে হাত দিয়ে পাপশক্তির বিরুদ্ধে চরম সংগ্রাম করে গেছেন তাঁর ভক্তদের নিয়ে ও নিজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে৷ তিনি তাঁর মহান কাজ সারাজীবনের প্রথম দিকে নীরবে করে গেছেন৷ একজন সাধারণ গৃহী হিসাবে৷ শেষে জীবনের মধ্য ভাগে তিনি তাঁর সংঘটন করেন৷ ১৯৫৫ সালে জানুয়ারীর প্রথম দিকে জামালপুরে আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘ গড়ে তোলেন তার কিছু ভক্ত আচার্যদের ও গৃহীভক্তদের নিয়ে৷ সেই গৃহী আচার্য ও ভক্তগণ পরিকল্পনা মাফিক দেশের বিভিন্ন কোনায় কোনায় আনন্দমার্গ আশ্রম গড়েন ও আধ্যাত্মিক সাধনা দিয়ে ও সমাজে কিছু সেবামূলক কাজ করার লক্ষ্য তাঁদের সামনে রাখেন৷ তারা ইয়ূনিট খোলেন লোকসংখ্যা বাড়াতে থাকেন৷ কাজের গতি আনতে তিনি সর্বক্ষণের কর্মী গড়ে তোলেন আর আনন্দমার্গ প্রাইমারী স্কুল খোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়৷ শ্রীপরমারাধ্য বাবা যেন কিছু বছরের মধ্যে সারা ভারতবর্ষে এই স্কুলের নাম আনন্দমার্গ প্রাইমারী স্কুল৷ এতে সারা সমাজে একটা আলোড়ন পড়ে যায়৷ আর শত শত গেরুয়া পোশাকের কর্মী গড়ে তোলেন৷ স্বার্থন্বেষী রাজনৈতিক নেতারা ভয় পায় সমাজে আনন্দমার্গে সর্বক্ষণের কর্মীদের দেখে! তাই নানা স্থানে বিনা কারণে নানা ধরণের মিথ্যা অপবাদ দিয়ে সংঘটনকে ঝামেলায় ফেলে৷ কিন্তু সংঘটন ন্যায় সত্যের কারণে সর্বক্ষেত্রে জয়ী হয়৷ এদিকে কয়েক বছরের মধ্যে সংঘটন পুরুলিয়ায় বাগলতা এলাকায় কয়েক শত বিঘা জমি পায় সেখানকার মহীয়সী জমিদার প্রফুল্ল কুমারী দেবীর কাছ থেকে৷ সেখানে সেই কঠিন জমির উপর বনজঙ্গলে ঢাকা তাতেই আশ্রম গড়ে ওঠে আনন্দ মার্গ প্রচারক সংঘের৷ সেখানে নানা কর্মকাণ্ড দ্রুত তৈরী হতে থাকে৷ যথা স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, চিল্ড্রেন হোম, বৃদ্ধ, বৃদ্ধাশ্রম ও কুষ্ঠাশ্রম ও চাষাবাদ, দুগ্দ প্রকল্প, ফুল ও ফলের বাগান ইত্যাদি৷
মনে হয় সাহিত্যিক ও কবিগন অনেক সময় ভূত ভবিষ্যত সব কিছুরই একটা ইঙ্গিত পান তাঁরাই মনোজগতের পূজারী৷ বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ তাই সবকিছু দেখে শুনে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বুঝেছিলেন যে পৃথিবীকে রক্ষা করা সাধারণ মানুষের কাজ নয়৷ তাই তিনি সেই মহামানবতাকে তাঁর কবিতায় আহ্বান করেন--- ‘‘ঐ মহামানব আসে’’ তাঁর পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার আগে৷ আমার মনে হয় সেই পরমারাধ্য ৰাৰা শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী ওরফে মহান দার্শনিক প্রভাতরঞ্জন সরকার যিনি বিশ্বের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে প্রাউট দর্শন--- সেই প্রগতিশীল অর্থনৈতিক ও সামাজিক উপযোগ দর্শন দান করেন৷ কারণ আধ্যাত্মিক সাধনায় মানুষকে হতে হবে প্রকৃত সৎ ও নীতিবাদী মানুষ ও বৃহৎ মানসিকতার অধিকারী আর সকলে যাতে এই পৃথিবীতে খেয়ে পরে বেঁচে থাকে তার জন্য নূ্যনতম সেই ৫টি অতিপ্রয়োজনীয় জিনিস অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, এগুলি নিয়ে লোভী, সর্বগ্রাসী মানুষগুলো কামড়া কামড়ি করছে! তাই নির্লোভ যুক্তিবাদী এমন মানুষ দরকার যারা সীমিত বস্তুগুলি এই জগতে সকলে যাতে পায় ন্যায়সঙ্গত সুসম বন্টনের দিকে নজর দেবেন৷ সেই জীব সেবাই শিবসেবা৷ এই মহান ব্রতের সাফল্যে জীবন উৎসর্গ করবেন স্বাভাবিকভাবেই৷ তাই প্রকৃত মানুষ গড়ার কাজে তিনি এসেছিলেন৷ তাই যে প্রাউটের সেই পঞ্চনীতি আজ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করা বড়ই দরকার৷ এটা বড়ই কঠিন কাজ!
আজ তাঁর চলে যাওয়াতে সংঘটনের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল! সংঘটনে আজ কর্মী দরকার, গৃহী মার্গীদের কর্মী দিতে হবে, সংঘটনকে আর্থিক সংকট থেকে মুক্ত করতে হবে সেই গৃহীদেরই৷ কারণ এই সংঘটনের ভিত্তিই হচ্ছে মানুষের সমাজ৷ তাই ব্যাপক প্রচার দরকার৷
তিনি যে পার্থিব দেহ ছেড়ে দেবেন তার ইঙ্গিত নানা ভাবে দিয়ে যান৷ পার্থিব দেহ ত্যাগের বেশ কিছু দিন পূর্বে তিনি মার্গের বিভিন্ন স্তরের কর্মীদের শপথ করিয়ে নেন সংঘটন রক্ষার্থে জীবনপন করে শত বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে চলবে৷ একথা ভুলে গেলে চলবে না, ৰাৰা প্রায়ই বলতেন---‘‘তোমরা কেউ স্বেচ্ছায় আসনি৷ আমি তোমাদের নিয়ে এসেছি৷ আমি প্রাউট প্রতিষ্ঠার জন্য এই পৃথিবীতে এসেছি৷ যত তাড়াতাড়ি প্রাউট প্রতিষ্ঠা হবে ততই মানুষের মঙ্গল৷ প্রাউট প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত পৃথিবী ধান্দাবাজ স্বার্থপর রাজনীতির দালালদের স্বর্গ হয়ে থাকবে৷ তাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে, শোষনেরবিরুদ্ধে সংগ্রাম করতেই হবে, সংগ্রামই জীবন৷’’
তিনি পথ দেখিয়ে গেছেন ও সংঘটনের কর্মীদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন ভবিষ্যতে কী করতে হবে৷ তাই প্রাউটের প্রচার ব্যাপকভাবে করতে হবে৷ বন্ধ হয়ে যাওয়া পত্র-পত্রিকাগুলি পুনরায় চালু করতে হবে৷ আমাদের সংবাদ অন্যেরা ছাপবে না৷ সাপ্তাহিক নতুন পৃথিবী পত্রিকা যাতে প্রাত্যহিক হয়ে সকলকে দায়িত্ব নিয়ে চেষ্টা করতে হবে৷ তিনি কখনই নিজের প্রচার চাইতেন না, সবসময় আদর্শের প্রচার চাইতেন৷
- Log in to post comments