রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রহসন নয় জনগণের হাতে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিতে হবে

লেখক
প্রভাত খাঁ

নিরাপত্তার বেষ্টনি ভেদ করে সংসদে হামলা ও বিরোধীদের সরকারের ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি দাবী ও প্রধানমন্ত্রীর মৌনতাকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতিতে ১৪১জন বিরোধী সাংসদ সাসপেণ্ড৷ এর আগে রাজীব গান্ধীর সরকার ৬৩ জন বিরোধী সাংসদকে সাসপেণ্ড করেছিল৷

পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক গণতন্ত্রের এটাই পরিণতি৷ শাসক বিরোধী এই রাজনীতির যাঁতাকলে পিষ্ট জনগণ, আর এই সুযোগে দেশের সম্পদ লুঠছে পুঁজিপতিরা৷

মহান দার্শনিক পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার অনেক আগেই বলে গেছেন–‘‘রাজনৈতিক গণতন্ত্রের দিন  সমাগত প্রায়৷’’ প্রাউটিষ্টদের দাবী– অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করতে হবে৷

মুষ্টিমেয় ধনী ব্যষ্টি যারা ভারতের মতো বিশাল দেশের অধিকাংশ সম্পদ কুক্ষিগত করে বছরের পর বছর তাদের শোষণ ও বঞ্চনা করে চলেছে, এদেরই সঙ্গে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত রয়েছে সারা ভারতের শাসক গোষ্ঠী ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির দুর্নীতিগ্রস্ত নেতারা৷ তারই নির্মম পরিণতি হলো সারা ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণ লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি৷ যত কেলেঙ্কারী দেশের খনিজ, বনজ, শিল্পজ সম্পদ ও জমি নিয়ে আর সব কিছুর ভক্ষক হচ্ছে ওরাই৷ বর্ত্তমানে ভারতে যে গণতন্ত্র চলছে রাজনীতির আড়ালে, এটা সেই ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার একটা ভয়ঙ্কর শোষণেরই যন্ত্রবিশেষ৷ অদ্যাবধি কোন সরকার সাধারণ মানুষের ক্রয়–ক্ষমতা কিভাবে বাড়বে, তারা কিভাবে বেঁচে থাকবে সেদিকে যতটা দৃষ্টি দেওয়ার কথা তাতো দেয়ই নি বরং ছল চাতুরী করে তাদের শোষণই করছে৷ বেকার সমস্যা, খাদ্য সমস্যা, বস্ত্র সমস্যা, মাথা গোঁজার সমস্যা, শিক্ষা সমস্যা, রোগে ওষুধ পাওয়ার সমস্যা, এমনকি জাত–পাতের সমস্যাকে সমাধান করে মানুষের মনে একটু আশার আলো জাগাবার কোন ব্যবস্থাই নেই৷ দুর্নীতিতে দেশ ছেয়ে গেছে৷ দেশসেবক আজ আর পাওয়া যায় না৷ আজ পঞ্চায়েৎ স্তর হতে নানা দলের রাজনৈতিক নেতা–নেত্রীরা দেশ শাসনের নামে নির্মমভাবে শোষণ করে চলেছে৷ গ্রামগুলিকে কৃষি উন্নয়নে ও কৃষি ভিত্তিক, কৃষি সহায়ক শিল্প গড়ে স্বয়ং সম্পূর্ণ করে তোলার সামান্যতম কাজ না করে শাসকবর্গ ধনীদের আশ্রয়ে গিয়ে তাদের পকেটভর্ত্তি করে চলেছে৷ গ্রামে গ্রামে ছোট ছোট কুটির শিল্প গড়তে হবে৷ গ্রাম স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে সমবায় পদ্ধতিতে চাষাবাদ ও ছোট ছোট শিল্পের মাধ্যমে যেখানে কাজ করবে গ্রামের ছেলেমেয়েরা৷ শ্রমিকরাই হবে সমবায়গুলির অংশীদার৷ মালিক আর শ্রমিকদের পার্থক্যটা ধীরে ধীরে দূর করতে হবে৷ সবাই হবে শিল্প–কলকারখানার অংশীদার৷ তবে তো শোষণ বন্ধ হবে৷ ভালাবাসা ও আন্তরিকতার মধ্য দিয়ে দেশের সামাজিক তথা আর্থিক উন্নতি ঘটবে৷ ভারতের সার্থক সভ্যতাই হলো গ্রামীণ সভ্যতার বিকাশ৷ তাকে বিজ্ঞানের সহায়তায় ধীরে ধীরে উন্নত করে তুলতে হবে৷ সেদিকে অদ্যাবধি সরকার কি কেন্দ্র কি রাজ্য তো নজর দেয়নি

সর্বদাই দেখা যাচ্ছে দেশের বাইরের ধনীদের আর্থিক অনুগ্রহকে প্রাধান্য দিয়ে, শিল্পে উন্নতির দিকে নজর দিতে গিয়ে দেশ হুমড়ী খেয়ে পড়ছে৷ দেশের শিল্পপতিরা তো দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে চলেছে৷ তাদের সঙ্গে সর্বনাশের পথ প্রশস্থকরছে কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকগোষ্ঠী৷ বিড়লা ইচ্ছাকৃতভাবে হিন্দমোটরস্–কে ধ্বংস করে দিয়েছে৷ ৭৫০ একর জমি লীজ নেয়৷ তার মধ্যে সংবাদে প্রকাশ ৩৫০ একর বামফ্রন্টের আমলে কয়েকশ’ কোটি টাকায় সরকারের সহায়তায় বিক্রি করে দেয় কারখানার উন্নতির জন্য৷ কিন্তু কারখানার উন্নতি না করে টাকা সরিয়ে নেয়৷ কারখানাতে তালা ঝুলিয়ে শ্রমিকদের বেতন আটকে দিয়ে লক্ষাধিক লোকের জীবিকা বরবাদ করে দেয়৷ এ কাজে খোদ কমিউনিষ্ট মার্কস্বাদী সরকার যুক্ত ছিল৷ যারা শ্রমিকবন্ধু হিসাবে চিৎকার করত৷

একইভাবে সিঙ্গুর আজ সমস্যায় ভুগছে পুঁজিবাদের তোষণকারী বাম শাসকের খামখেয়ালীপনায়৷ শাসক চলে গেছে কিন্তু চাষীর দুর্দশা কি দূর হয়েছে হুগলীর সিঙ্গুরের অতি ঊর্বর জমি আলু, ধান, সরষে, শাকসব্জির উন্নতমানের ফসলে ভরে থাকতো, চাষীরা চাষের ফসল ফলিয়ে পরিবার চালাতো৷ তাদেরকে পথে বসিয়ে পুঁজিপতির হাতে জমি তুলে দিতে চেয়েছিল শ্রমদরদী সরকার এ কেমন গরিবের সরকাব ছিল কৃষি প্রধান দেশকে ধবংস করে সর্বহারার তকমা গায়ে লাগিয়ে ধনীর উদর পূর্ত্তির চেষ্টা! এর পশ্চাতে তো দলীয় স্বার্থ কাজ করেছে৷ আজ দুর্নীতির বিরুদ্ধে চিৎকার করছে৷ ৩৪ বছর যারা দুর্নীতির পাহাড়ে বসে রাজ্য শাসন করেছে৷

এদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এমনই পুঁজিপতি অক্টোপাশের দ্বারা আবদ্ধ তাদের পক্ষে গরিবের চোখের জল মোছানো সম্ভব নয়৷ কারণ তাদের দল বাঁচবে না যদি ধনীর কৃপাদৃষ্টি তাদের উপর না পড়ে৷

তাই জনগণকে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য গণ আন্দোলনকে জাগিয়ে তুলতে হবে৷ ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা আজ সব কিছুকে গ্রাস করছে৷ আজ দুর্নীতি শুধু একটা দুটো নেতা মন্ত্রী নয়, রাজনৈতিক দল, আমলা , প্রশাসন এমনকি গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ বিচার বিভাগ ও মিডিয়ার গায়েও কালিমাখাচ্ছে৷  দুর্নীতিগ্রস্ত স্টেট ক্যাপিট্যালিজমের ঔদ্ধত্য ও মার্কসবাদ সারা বিশ্বে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে৷ আজ তাই ক্যাপিট্যালিজম্ আর কমিউনিজমের মধ্যে তফাৎ নেই৷ তারা দুজনেই শোষক৷ মনে রাখা দরকার গণতন্ত্র বাঁচবে তখন যখন সমবায় আন্দোলনে জনগণের ক্রয় ক্ষমতাকে বাড়াতে সক্ষম হবে৷ যে নাগরিকগণ বেকার, খেতে পায় না – তাদের রাজনৈতিক অধিকার তো একটা প্রহসন৷

গণতান্ত্রিক পথে তাই গণর্থনীতিকে জনগণের হাতে তুলে দেবার পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার পথে সরকারকে ধীরে ধীরে এগুতেই হবে নচেৎ অদূর ভবিষ্যতে গণতন্ত্র এক প্রহসনে দাঁড়াবে৷ এব্যাপারে  মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের সামাজিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব প্রাউটই (প্রগতিশীল উপযোগতত্ত্ব) সমাধানের পথ দেখাতে সক্ষম৷ প্রাউট অর্থনীতির মূল কথা কেন্দ্রীত অর্থনীতির কাঠামো ভেঙে নোতুন করে বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গড়ে তুলতে হবে৷ যার দায়িত্বে থাকবে এক একটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থানীয় মানুষ৷ সেখানে কৃষিভিত্তিক ও কৃষি সহায়ক শিল্প গড়ে প্রতিটি মানুষের কর্মসংস্থান  করতে হবে ও প্রতিটি মানুষের হাতে ক্রয় ক্ষমতা দিতে হবে৷ এইভাবে বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে মানুষের হাতে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তুলে দিতে হবে৷ তবেই গণতন্ত্র সার্থক হবে৷