রবীন্দ্রনাথের নোবেল কি অধরাই থেকে যাবে?

লেখক
বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়

মানবতার পূজারী, মানব মৈত্রীর ঋষি ও বিশ্ববন্দিত কবি রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকে এক জায়গায় নিয়ে এসে মেলানোর জন্য তিনি বিশ্বভারতী গড়ে তুলেছিলেন৷ এই বিশ্বভারতী স্থাপনের নেপথ্যে কবির কঠোর পরিশ্রম আর আশাবাদ নিহিত ছিল৷ রবীন্দ্রনাথের উদার শিক্ষা চিন্তার স্মারক-এই বিশ্বভারতী৷ কত মনীষী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও চিন্তানায়কদের স্মৃতি বিধৌত এই বিশ্বভারতী৷ এই বিশ্বভারতীর আচার্য হলেন ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী৷ বিশ্বভারতীর সর্বাঙ্গীন বিকাশ, প্রসার, উন্নতি সর্র্বেপরি এর মহান ঐতিহ্যকে রক্ষা করার জন্য তিনি সদা জাগ্রত থাকবেন দেশবাসী এমনটাই আশা করে৷

১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অমর সৃষ্টি গীতাঞ্জলী কাব্যগ্রন্থের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন ও আন্তর্জাতিক মানুষের দরবারে ভারতবর্ষ তথা ভারতবাসীকে পরিচিতির আলোকে নিয়ে এসেছিলেন৷ ভারতবর্ষের সবর্বস্তরের মানুষ সেদিন রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তিতে গর্ব আর অতলান্ত আনন্দে উদ্বেল হয়েছিল৷

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপ ও লজ্জার বিষয় হল বিগত ২০০৪ সালে বিশ্বভারতীর সংগ্রহশালা থেকে আমাদের অত্যন্ত গর্বের স্মারক রবীন্দ্রনাথের নোবেল চুরি হয়ে যায়৷ এই ঘটনায় সেই সময় সারা দেশে মূলতঃ পশ্চিমবঙ্গে বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিক মহলে সাময়িক হৈচৈ হয়েছিল বটে৷ কিন্তু আশ্চার্য্যজনক পারে সর্ব স্তরেই নীরবতা নেবে আসে অর্থাৎ সকলেই নিশ্চুপ হয়ে যান৷

কিন্তু আমাদের ভাবতে অবাক লাগে ওই সময় পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রীর পুত্রের একটি ব্রিফকেস হারিয়ে যায় এবং সেই ব্রিফকেস ২৪ ঘন্টার মধ্যে লালবাজারের পুলিশ বাহিনীর অত্যন্ত তৎপরতা ও চেষ্টার ফলে উদ্ধার হয়েছিল৷ কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নোবেল উদ্ধারের ব্যাপারে কিঞ্চিৎ তৎপরতা দেখা যায়নি৷ এই ব্যাপারে একটি তদন্ত কমিশন ও গঠিত হয়েছিল বটে কিন্তু সেই কমিটির কার্যকাল অচিরেই শেষ হয়ে যায়৷

বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রাদের নিয়ে আমরা যখন শান্তিনিকেতনে শিক্ষামূলক ভ্রমণের উদ্দেশ্য যাই তখন বিশ্বভারতী সংগ্রহশালার আসল নোবেলের পরিবর্ত্তে যে নকল নোবেলটা রাখা হয়েছে সেটা দেখিয়ে ছাত্র-ছাত্রাদের বলতে হয় তোমরা রবীন্দ্রনাথের নোবেল কৌতূহল নিয়ে দেখে নাও তাদের কাছে সত্যঘটনাটা আমাদের সতর্কতার সাথে গোপন রাখতে হয়, এটা যে কত বড় আত্মশ্লাঘার বিষয় তা হয়ত ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না৷ নতুন প্রজন্মের কাছেও বিষয়টি অজানাই থেকে যায়৷

প্রকৃতির চিরায়ত আবর্ত্তনের পথ ধরে প্রতিবছর২৫শে বৈশাখ আর ২২শে শ্রাবণ আসে আর যায় কিন্তু নোবেল অধরাই থেকে যায়৷ এটা শতাব্দীর পাপ আর লজ্জা বলে আমরা মনে করি৷ কালের স্রোতে রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ণের বিশ্বভারতীর সেই ঐতিহ্য, পবিত্রতা কিংবা স্বাতন্ত্র অনেকটাই ফিকে হয়েছে৷ ছাত্র-ছাত্রাদের অসন্তোষ, অধ্যাপক মণ্ডলীর মধ্যে সংঘাত, একনায়কতান্ত্রিক পরিচালনা সব মিলিয়ে বিশ্বভারতীর সুমহান ঐতিহ্য বিপন্ন হচ্ছে৷ এটা কখনই কাম্য ছিল না৷ আজ দুই দশক অতিক্রান্ত হতে চলল তবুও ভারতবর্ষের অসংখ্য বুদ্ধিজীবী মানুষ ভারত সরকার সকলেই এ ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন৷ প্রতিদিন সংবাদপত্র ও দূরদর্শনের পর্র্দয় আমরা দেখি ভারতবর্ষ উন্নতির শিখরে পৌঁচাচ্ছে, কৃষি, শিল্প স্বাস্থ্য, শিক্ষা সব বিষয়েই ভারতবর্ষ এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যাচ্ছে৷ এর সত্যতা বা বাস্তবতা আমাদের অনুভূতির আড়ালে থেকে যাচ্ছে৷ এসব স্বপ্ণের মাঝখান দিয়ে দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নোবেল অধরাই থেকে যায়৷

এমতাবস্থায় বিশ্বভারতীর আচার্য তথা ভারতবর্ষের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের বিনীত অনুরোধ আর কালক্ষেপ নয়, আর শীতঘুমে আচ্ছন্ন থাকা নয়, রবীন্দ্রনাথের হৃত নোবেল পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে আপনি আন্তরিক উদ্যোগী ও চেষ্টিত হয়ে বিষয়টির নিষ্পত্তি করুন৷ আপনার হাতে তো অনেক দপ্তর৷ প্রতিরক্ষা বাহিনী সর্র্বেপরি সিবিআই তো আছেই৷ আপনিই পারবেন সবকিছু প্রয়োগ করে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুনরুদ্ধার করতে৷ আমরা এই দাবী প্রত্যাশা কিংবা অনুরোধ কার কাছে রাখব? যদি আপনি আন্তরিক সদিচ্ছা নিয়ে আমাদের গর্বের স্মারক রবীন্দ্রনাথের নোবেল উদ্ধার করতে পারেন তাহলে আপনাদের জাতীয় লজ্জা ও দূরপণেয় কলঙ্কই শুধু দূর হবে না, আপনি এই মহতী কাজের জন্য চলতি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন৷ এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, সেটা হল রবীন্দ্রনাথের নোবেল যদি আমরা রক্ষা করতে না পারি তাহলে ভারত ভূখণ্ডের স্বাধীনতা আমরা রক্ষা করব কিভাবে?