বর্তমান সামাজিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মূল কারণ–পুঁজিবাদ, জড়বাদ ও মৌলবাদ৷ নৈতিক অধঃপতনের কারণও তাই৷ পুঁজিবাদ মূলতঃ আত্মস্বার্থের কথা বলে৷ আমার সুখটাই বড় কথা, অন্যের হোক বা না হোক৷ আমার লাভটাই বড় কথা, গরীব মানুষের দুর্দশা যতই হোক৷ ওঁদের তাত্ত্বিকরা তথা পুঁজিবাদের সমর্থক অর্থনীতিবিদরা ‘ট্রিকল ডাউন’ তত্ত্বের কথা বলেন৷ বলেন, ধনিক শ্রেণীর অর্থনৈতিক উন্নতি হলে তা চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়বে ও তাতে দরিদ্র মানুষেরও অর্থনৈতিক উন্নতি হবে৷ প্রণববাবু যখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকেই সমর্থন করে’ গেছেন৷ কিন্তু তিনি যখন রাষ্ট্রপতি হলেন, তখন তিনিই তাঁর ভাষণে বলেন, এই ‘ট্রিকল ডাউন’ তত্ত্বের দ্বারা গরীব মানুষের যথার্থ উন্নতি সম্ভব নয়, দেশের দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়৷ আর তা যে সম্ভব নয়, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ স্বাধীনতার পর ৭৫ বছর ধরে তো ধনতান্ত্রিক নীতিকে ভারত মেনে চলল, বড় বড় শিল্পপতিরা বড় বড় শিল্প গড়েছে, কিন্তু এখনও তো এ দেশের দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যার সমাধান হ’ল না৷ শুধু ভারত নয় দুনিয়ার পুঁজিবাদী দেশগুলোতেও বেকার সমস্যা ক্রমবর্ধমান৷ তাই এখনও সে সব দেশে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রীট’ আন্দোলনের মত আন্দোলন অব্যাহত৷ ভারতবর্ষে পুঁজিবাদী শোষনে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বেকারত্ব আজ দেশের সামনে চরম বিপর্যয় ডেকে আনছে৷
তাছাড়া, দেশে এই পুঁজিপতিগোষ্ঠী দেশের সংস্কৃতি তথা বিভিন্ন মিডিয়াকে কুক্ষিগত করে অধিক মুনাফা অর্জনের জন্যে সংস্কৃতির নামে দেশে অসংস্কৃতির বন্যা বইয়ে দিচ্ছে৷ উন্নত মূল্যবোধ ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে৷ এরা রাজনীতিকেও কুক্ষিগত করে’– চরমভাবে কলুষিত করে চলেছে৷ বিপুল অর্থ বলে যোগ্য মানুষকে পরাজিত করে অযোগ্য মানুষের হাতে দেশের রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষমতা তুলে দেয়৷ ফলে দেশ ডুবছে
জড়বাদও সমাজের উন্নত মূল্যবোধকে ধ্বংস করে’ মানুষকে পশুর পর্যায়ে নামিয়ে আনে৷ ব্যষ্টি স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে’ কার্যতঃ সমাজের সাধারণ মানুষকে ক্রীতদাস বানিয়ে ফেলে৷ পুঁজিবাদের প্রাবল্য ও জড়বাদের প্রবল্য সমাজে অবাধ ভোগবাদ ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রাকে চরমভাবে বাড়িয়ে দেয়৷ সমাজে আজকে যে দুর্নীতি থেকে শুরু করে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ প্রভৃতির রমরমা এসবই পুঁজিবাদ ও জড়বাদের ফলশ্রুতি৷ পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে যে সামাজিক অর্থনৈতিক দুরাবস্থা, ছাত্র ও যুব সমাজের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ, নৈতিক অধঃপতন, শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতির যে অধঃগতি তার অন্যতম কারণ ৩৪ বছরের জড়বাদী শাসন৷
আর, ডগমা ভিত্তিক তথাকথিত রিলিজনকে আশ্রয় করে উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদ তথা মৌলবাদও আজ সমাজের কাছে একটা ভয়ঙ্কর বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
প্রকৃত ধর্মের সঙ্গে এই সব ডগমা আশ্রিত রিলিজিয়নের কিন্তু কোনো সম্পর্ক নেই৷ এরা যুক্তি বা মানবতার ধার ধারে না৷ আপন আপন সাম্প্রদায়িক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে সমাজে রক্তের বন্যা বইয়ে দিতে দ্বিধা করে না৷ মানবসমাজকে এরা খন্ড বিখন্ড করতে চায়, কিন্তু প্রকৃত ধর্ম বিশ্বাস করে, ঈশ্বর এক অনাদি অনন্ত সর্বব্যাপী, সর্বজীব – সমস্ত মানুষ একই ঈশ্বরের অভিব্যক্তি৷ তাই জীবের সেবাই ধর্মের মূলকথা৷ উদার বিশ্বপ্রেম তথা বিশ্বৈকতাবাদই প্রকৃত ধর্মের ভিত্তি৷ মৌলবাদ বা উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদ উল্টো পথে চলে৷ তাই এই মৌলবাদ বা সাম্প্রদায়িকতাবাদ আজ সমাজের অন্যতম প্রধান বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
তাই পুঁজিবাদ, জড়বাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবাদ থেকে শত হস্ত দূরে থাকতে হবে৷
আজ প্রকৃত বিশ্বপ্রেম ও বিশ্বৈকতাবাদ ভিত্তিক ধর্মের পথ ধরে সমসমাজতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা – সবাইকে সঙ্গে নিয়ে পরম পূর্ণতার পথে এগিয়ে চলার আদর্শই প্রকৃতপক্ষে সমস্ত সমস্যার একমাত্র সমাধান – সমস্ত প্রশ্ণের একমাত্র উত্তর – সমস্ত হতাশার একমাত্র আশ্বাস৷
- Log in to post comments