আজ আর সে-পাঠশালা নেই৷ এখন হয়েছে স্কুল-কলেজ আর ছাত্র-ছাত্রী৷ তখন ছিল আটচালার পাঠশালা আর পোড়োর দল৷ পাঠশালার সঙ্গে আজ আমাদের পরিচয় হয় পূরনো গল্প-উপন্যাসের মাধ্যমে৷
কারা তৈরি করত সেই সব পাঠশালা? এখন যেমন সরকার, পৌরসভা, বিভিন্ন সেবাপ্রতিষ্ঠানের দানে-অনুদানে স্কুল-কলেজ নির্মিত হয় তখন তো তা ছিল না৷ জমিদার বা গ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা সমাজসেবার অঙ্গস্বরূপ সে সব পাঠশালা তৈরি করতেন!
সেকালের কলকাতার পাঠশালায় সাধারণত বর্ধমানের কায়স্থ গুরুরাই পড়াতেন৷ সকাল-সন্ধ্যা দু’বেলাই পাঠশালা! বসত৷ যে সকল দরিদ্র ছাত্র দিনের বেলায় অবকাশ পায় না, তাহারা সন্ধ্যার সময় পড়িতে আসে’৷ (শরৎচন্দ্র) গুরুমশাই বেত হাতে বসতেন ঘরের মাঝখানের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে৷ আর পোড়োরা যার যার বাড়ি থেকে আনা মাদুর পেতে বসত৷ এ প্রসঙ্গে শিবনাথ শাস্ত্রী লিখে গেছেন---তখন কলিকাতার দক্ষিণপ্রদেশস্থ অনেক গ্রামের পাঠশালে বর্ধমানের গুরু দেখা যাইত৷ এই গুরুরা আসিয়া ধনী গৃহস্থদের চণ্ডীমণ্ডপে পাঠশালা খুলিতেন৷ এক গুরুমহাশয় খুটি ঠেসান দিয়া বেত্র হস্তে বসিতেন, সর্র্দর ছেলেরা তাঁর সহকারীর কাজ করিত নিম্নশ্রেণীর বালকদিগের শিক্ষায় সাহায্য করিত গুরুমহাশয়ের পয়সাদি আদায় করিয়া দিত তাঁহার পাকাদিকার্যের সাহায্য করিত পলাতক বালকদিগকে ধরিয়া আনিত ইত্যাদি৷’’ পাঠশালার গুরুমশাইরা বেতন কত পেতেন? বেতনের কোনও ঠিক ছিল না৷ পোড়োদের অভিভাবকরা যে যা দিতেন তাই সব মিলিয়ে হত দশ কি বারো টাকা৷ এ ছাড়া নানারকম পালা-পার্বন এবং পারিবারিক উৎসবাদিতেও গুরুরা কিছু কিছু দক্ষিণা পেতেন!
পাঁচ বছর বয়স থেকে শুরু হত পাঠশালার পড়াশুনা৷ পাঠ্যপুস্তকের বালাই ছিল না৷ ছিল না-কোনও ব্ল্যাকবোর্ড৷ গুরুমশাই মাটিতে খড়ি দিয়ে অ আ ক খ লিখতেন৷ পোড়োরা তাই দেখে বর্ণ চিনতে শিখত৷ তারপর তালপাতায় স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ লিখতে শিখে যুক্তাক্ষরে হাত দিত ৷ তারপর শাটিকা, কড়াকিয়া, বুড়িকিয়া ইত্যাদি শিখত৷ এর পর আস্তে আস্তে তালপাতা ছেড়ে কলাপাতায় উত্তীর্ণ হত৷ কলাপাতায় লেখা হত জমা খরচের হিসাব, তেরিজ, কাঠাকালী, বিঘাকালী, শুভঙ্করী ইত্যাদি৷ কলাপাতার পর শুরু হত কাগজে লেখা৷ কাগজে লেখা হত চিঠিপত্র৷ পোড়োরা মুখে মুখে বড় বড় মানসাঙ্কের সমাধান করে দিতে পারত৷
পাঠশালার শাস্তির ব্যাপারটা ছিল বড়ই নির্মম৷ ১৮৩৪ সালে উইলিয়ম এডাম এ দেশের পাঠশালাগুলি পরিদর্শন করে যে রিপোর্ট পেশ করেছিলেন৷ যেমন---
হাতছড়ি : সাধারণত দেরি করে পাঠশালায় এলে হাতছড়ি খেতে হত৷ ডান হাত পেতে গুরুমশাইর সামনে দাঁড়াতে হত৷ তখন গুরুমশাই দশ ঘা বেত মারতেন৷ নাড়ুগোপাল : অপরাধী পোড়োকে বালগোপাল অথাঁৎ শিশুর মতো দু’ পা আর বাঁ হাতে ভর দিয়ে ডান হাত তুলে থাকতে হত৷ সেই পেতে রাখা ডান হাতে একখানা এগার ইঞ্চি ইট চাপানো হত৷ হাত ব্যথা হয়ে গেলেও এ ইট ফেলা চলবে না৷ ইট ফেললেই পেছনের কাপড় তুলে বেত মারা হত৷ ত্রিভঙ্গ : অপরাধী পোড়োকে কৃষ্ণের মতো বেঁকে এক পায়ে দাঁড়াতে হত৷ হাতে দেওয়া হত একটা ভারী ইট বা পাথর৷ একটু নড়লে বা উত্তোলিত পা মাটিতে ফেললেই পেছনে পড়ত বেত্রাঘাত ৷ চ্যাংদোলা : কোনও ছাত্র ভয়ে পাঠশালায় না এলে বা পাঠশালা থেকে পালালে এই চ্যাংদোলা সাজা দেওয়া হত৷ উক্ত ছাত্রকে ধরে আনবার জন্য বয়স্ক এবং বলশালী কিছু ছাত্রকে পাঠানো হত৷ তারা তন্নতন্ন করে খুঁজে অপরাধী ছাত্রকে হাতে পায়ে ধরে ঝুলিয়ে আনত৷ ঐ চ্যাংদোলা অবস্থায় তাকে নিয়ে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে গুরুমশাই এলোপাথারি বেত চালাতেন তার ওপর! মাটিতে বসে ছাত্রকে নিজের একখানা পা কাঁধে তুলে বসে থাকতে হত ৷ উরুর তলা দিয়ে হাত চালিয়ে কান ধরে বসে থাকতে হত অনেক সময় কাপড় তুলে পেছনে বিছুটি দেওয়া হত৷ যাতে চুলকোতে না পারে তার জন্য হাত-পা বেঁধে রাখা হত৷
আরও মমার্ন্তিক শাস্তি হল একটা থলেতে একটা.. বেড়ালের সঙ্গে অপরাধী পোড়োকে ঢুকিয়ে মাটিতে গড়িয়ে দেওয়া হত৷ বিড়ালের দাঁতের কামড়ে আর নখের আঁচড়ে পোড়ো বেচারী ক্ষতবিক্ষত হত৷
- Log in to post comments