শিব, কৃষ্ণ ও রাম

লেখক
আচার্য মোহনানন্দ অবধূত

পূর্ব প্রকাশিতের পর---

দর্শনের কৃষ্ণ, শিব বা রামে তো এমনটি নেই৷ দর্শনের কৃষ্ণ-শিব-রাম তত্ত্বে মনের ক্ষুধা মিটতে পারে কিন্তু ভক্ত হৃদয়ের ক্ষুধা তো মিটতে পারে না৷ তাই মানুষের চাই পৌরাণিক রামের বা দর্শনিক রামতত্ত্ব থেকে মহাসম্ভূতি কৃষ্ণ, মহাসম্ভূতি শিব অর্থাৎ ঐতিহাসিক শিব-কৃষ্ণ৷ মহাসম্ভূতি শিব, কৃষ্ণ মানুষের যেন আপন লোক, ঘরের লোক৷ ‘তাই পাপী-পাপবিদ্ধ মানুষ---অনুতপ্ত মানুষ শিবের কাছে নতজানু হয়ে বলেন ‘তোমার শরণ নোব না তো কার শরণ নোব৷ তুমি ছাড়া কে আমায় আশ্রয় দেবে, তুমি যে ভোলানাথ৷ আমি এত পাপ করেছি তা শুধরে নেবার সঙ্গে সঙ্গেই তুমি আমাকে ক্ষমা করলে৷ ওঃ তুমি এত সহজে সন্তুষ্ট হও, তুমি যে আশুতোষ৷’ তেমনি তারব্রহ্মের মহাসম্ভূতি কৃষ্ণের বেলায় দেখি তার বরজলীলা৷ রাখাল বালকদের সঙ্গে খেলাধূলা, গোরু চরানো, যমুনার তীরে বাঁশী বাজানো আর গোপীদের সঙ্গে তার ছিল ঘরোয়া সম্পর্ক৷ মহাসম্ভূতি শিব ও কৃষ্ণ জন্ম থেকেই ছিলেন ঐশী গুণসম্পন্ন৷ মনে রাখতে হবে দর্শনে বর্ণিত ভূমাকেন্দ্রের যে শিব ও কৃষ্ণ, ঐতিহাসিক শিব ও কৃষ্ণ আর জীব বৈজ্ঞানিক শিব-কৃষ্ণ একই সত্ত্বার তিনটি ভূমিকা৷ বাঙলার মানুষ রামকে আদর্শ মানুষ, আদর্শ রাজা হিসাবে মানে কিন্তু প্রাণের ঠাকুর হিসাবে শিব-কৃষ্ণকে বেশী গুরুত্ব দেয়৷ বাঙলার শিব কৃষ্ণের প্রভাব বেশী৷ অথচ অবশিষ্ট উত্তর ভারতে অর্থাৎ তথাকথিত হিন্দুস্থানে নামের জনপ্রিয়তা বেশী৷ বাঙলায় সাধারণতঃ যেখানে শব বহন করা হয় ‘হরিবোল’ বলে সেখানে হিন্দী পরিভূর লোকেরা শব বহন করে নিয়ে চলার সময় বলে চলে ‘রাম নাম সত্য হ্যায়৷’ মনে রাখতে হবে তারা এই শিবকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে বাঙলায় অন্যান্য প্রদেশগুলির থেকে বিশেষ সংস্কৃতি বিশেষ আচায গড়ে উঠেছে যাকে আমরা বলি তান্ত্রিক কাল্ট৷ তান্ত্রিক কাল্ট-এ মানুষে মানুষের কোন জাত-পাতের বিভাজন নেই৷ কোন জাত-পাতের বিভাজন নেই৷ এছাড়া যখন বাঙলায় শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাব সে সময় আবার দেখা যায় জাত-পাতের বিভাজন ছিল উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ৷ পণ্ডিতেরা নীচু জাতিদের তথা শূদ্রদের ঘৃণার চোখে দেখতেন৷ তাদের ধর্মকমল, শিক্ষার ক্ষেত্রে পণ্ডিতেরা বাধা ও নিষেদ আরোপ করছিল৷ তাদের মানসিক বিকাশের জন্যে পথপ্রদর্শন তারা করতেন না৷ তাদের কোন বেদের মন্ত্র শুণবারও অধিকার ছিল না৷ সবিতৃ ঋক্ মন্ত্র যাকে ভুল করে লোকে গায়ত্রী মন্ত্র বলে অর্থাৎ  ওঁ ভূঃ ভূঃ স্ব.... যা মানুষ মাত্রেই প্রার্থনা মন্ত্র হিসাবে উচ্চারণ করতে বা পাঠ করতে পারে৷ তার থেকে তারা বঞ্চিত ছিল৷ তাই শ্রীচৈতন্যদেব তৈরী করলেন তথাকথিত হিন্দু ধর্মের থেকে আলাদা বৈষ্ণব ধর্ম৷ বিষ্ণু শব্দ থেকে বৈষ্ণব এসেছে৷ বিষ্ণু মানে সর্বব্যাপী যে সত্ত্বা৷ সবই বিষ্ণুর বিকাশ৷ তাই উঁচু-নীচু, পণ্ডিত, মুর্খ সবাইয়ের জন্যে এই বৈষ্ণব ধর্ম৷ শ্রীচৈতন্যদেব যবন হরিদাসকে কোলে টেনে নিয়েছিলেন৷ গায়ত্রী মন্ত্র যপের বদলে তিনি বিধান দিলেন ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’---সংকীর্ত্তন ও কৃষ্ণ মন্ত্র জপ৷ সাধারণ মানুষ জৈবী প্রবৃত্তি অর্থাৎ আহার, নিদ্রা, ভয় ও মৈথুন (বংশবিস্তার) নিয়ে ব্যস্ত থাকে যা পশুরা করে থাকে৷ মানুষ যদি কিছু কিছু ধর্মাচরণ না করল কেবল জৈবী প্রবৃত্তি নিয়ে পড়ে থাকে তবে তারাও পশুর সমান জীবন যাপন করে মারা যাবে৷ তার উচ্চাঙ্গের সাধনা বা শাস্ত্র অধ্যয়ন করতে পারবে না৷ তাই শ্রীচৈতন্যদেবের ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম.....’ মন্ত্র সাধারণ মানুষের কাছে সহজ সরল অথচ তাৎপর্যপূর্ণ মন্ত্র৷ ফলে সাধারণ মানুষের মনের বিকাশ ঘটতে থাকে৷ বাঙলায় শিবকৃষ্ণ ও শ্রীচৈতন্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিশেষ সংস্কৃতি ও সভ্যতা, গড়ে উঠেছে বাঙলার মানুষের বিশেষ মানসিকতাও গড়ে উঠেছে বিশেষ প্রাণধর্ম, জাত-পাতের ভেদাভেদ উত্তরপ্রদেশ ও বিহার প্রকৃতির মতো কঠোরতা বাঙলাতে নেই বা জাত-পাতের কঠোরতা নেই বললেই চলে৷ এখন দেখছি বাঙলার রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে জয় শ্রীরাম ধবনি তোলা হচ্ছে ও শ্লোগান দেওয়া হচ্ছে ও শিব-কৃষ্ণকে বাদ দিয়ে রামকে সর্বোচ্চ স্থান দিচ্ছে৷ তবে কী তাঁরা শিব-কৃষ্ণের যে প্রভাব ও মহিমা বাঙলায় ওতপ্রোতঃ হয়ে রয়েছে তা তাঁরা ছোট করতে চাইছে৷ তবে কী এরা বাঙলা সংস্কৃতি ও প্রাণধর্মকে সরিয়ে হিন্দুস্তানী সংস্কৃতি বাঙলায় প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে, যারা উত্তর ভারতীয় ও হিন্দুস্তানী তারা বাঙলার উচ্চমানের সংস্কৃতি নষ্ট করতে চাইবে---তাদের সংস্কৃতি ঢুকিয়ে দিয়ে৷ কিন্তু বাঙালী হয়ে যারা এটা করছে তারা তো বাঙলার সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতা করছে৷ যে সকল বাঙালী জয় শ্রীরাম ধবনি তুলে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগকে কাজে লাগাচ্ছে এরা কারা? এরা কি ধর্মবীর? এরা আর কেউ নয় এরা বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের পার্টির বলে জয়ী হয়ে ক্ষমতার স্বাদ নিচ্ছে৷ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এমন যে প্রভাবশালী পার্টি কোন রাম, শ্যাম, মধুকে দাঁড় করিয়ে জিতিয়ে নিতে পারে৷ সংবিধান রচয়িতা আম্বেদরের বিরুদ্ধে তারই পার্সোনাল সেক্রেটারীকে প্রার্থী করে জহরলাল জিতিয়ে নিয়েছিলেন৷ তাই বলা হয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনও ল্যাম্পপোষ্টকে দাঁড় করিয়ে জিতিয়ে নেওয়া যায়৷ কিন্তু ওই ল্যাম্পপোষ্ট দ্বারা দেশের হিত কী হবে? চটকদারী গান শিল্পী ও সিনেমা শিল্পীদের ও ক্ষমতালোভীদের দ্বারা  দেশ গড়ে উঠবে না৷

তবে যেহেতু এরা হনুমান জয়ন্তী নিয়ে ও রাম নবমী নিয়ে আদিখ্যেতা দেখাচ্ছে তবে বুঝে নিতে হবে এই রাম হ’ল পৌরাণিক রাম---বাল্মীকী বর্ণিত রাম৷ তাই যদি হয় তবে রাম তো ক্ষমতালোভী ছিলেন না৷ শুধু রাম কেন রামেণ অন্যান্য ভাইয়েরাও ক্ষমতালোভী ছিলেন না৷ রামকে ফিরিয়ে আনার জন্যে ভাই ভরত ও প্রজাগণ রামের কাছে গিয়ে কত অনুনয়-বিনয় করল, ভারত রামের পা ধরে কান্নাকাটি করেছিল তবু রাম তখন ফিরে আসেন নি রাজা হওয়ার জন্যে৷ আর ভরত রাজ্য লাভ করেও রাজ সিংহাসনে রামের পাদুকা রেখে রামেরই নামে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন৷ লক্ষ্মণ তার ব্যষ্টিগত সুখকে বিসর্জন দিয়ে রামের অনুগামী হয়েছিলেন৷ রাজ্যের ক্ষমতার লোভ কারোরই ছিল না, ছিল তাঁদের ত্যাগের মহিমা৷ কিন্তু এই শ্রীরামপন্থীরা পার্টি কর্মীদের জোর গলায় নির্দেশ দেয় যেন-তেন-প্রকারেণ ভোটে জিতে ক্ষমতালাভ করতে হবে৷ তার জন্যে এরা উগ্র হিন্দুত্ববাদের নাম নিয়ে হিন্দু মুসলিম বিভাজন সৃষ্টি করছে ও এই বাঙলার শান্তি নষ্ট করতে চাইছে৷ তার মানে এরা রামায়ণের শিক্ষাটুকু গ্রহণ করছে না৷ অথচ মুখে জয় শ্রীরাম ধবনি ও জয় শ্রীরামের নামে মিছিলও করছে৷ এখানে কীর্ত্তন সম্পর্কে দু-চার কথা বলে বক্তব্য শেষ করছি৷ আগেই হরে কৃষ্ণ হরে রাম কীর্ত্তন প্রসঙ্গে কিছু বলছি৷ এই ‘হরে কৃষ্ণ ও হরে রাম’ মন্ত্র সংকীর্ত্তনের দ্বারা কেবল তিনটি নামে ভগবানকে ডাকা হচ্ছে৷ এতে অন্য ভগবানের অন্য নামগুলি বাদ পড়ে যাচ্ছে৷ এতে অনাদি-অনন্ত পরমাত্মায় সীমায়িত হয়ে পড়ে৷ আবার তাঁরনন্ত গুণের জন্যে অনন্ত নামেও ডাকা সম্ভব নয়৷ তাই রাম, হরি, শিব-কৃষ্ণ ইত্যাদির পরিবর্তে সম্বন্ধ বাচক শব্দে কীর্ত্তন করা উচিত৷ তা হলো ‘বাবা’ শব্দ৷ বৈদিক ‘বপ্র’ থেকে ‘বাবা’ শব্দের উৎপত্তি৷ বপ্র মানে সবচেয়ে প্রিয়৷ অর্থাৎ অন্তরের অন্তরতম---আপনজন৷ পরমপুরুষই একমাত্র আপনজন৷ তাঁর গুণাত্মক নাম যাহাই হোক না কেন৷ ও যে ভাষাতেই হোক না কেন ‘বাবা’ এই সম্বন্ধবাচক শব্দের দ্বারা তাঁর সব গুণবাচক নামই বোঝাবে৷ তাই শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি অষ্টাক্ষরী সিদ্ধমন্ত্র ‘বাবা নাম কেবলম্’ প্রবর্ত্তন করেছেন৷ ‘বাবা’---অন্তরতম বা প্রিয় আর কেবলম্ মানে অদ্বিতীয় সত্তা৷ যিনি প্রতিটি সত্তার মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে রয়েছে৷ এখানে ‘বাবা’ বলতে হরি, কৃষ্ণ, শিব, রাম, আল্লা, গড সব গুণাত্মক নামকে বোঝানো হয়েছে৷  (সমাপ্ত)