যদি গভীরভাবে চিন্তা করা যায় তাহলে অবাক হতে হয় এই বিশাল ভারত দীর্ঘ ৭৭ বছরের মধ্যে কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে! বিশাল হিমালয় পর্বত ও তিন দিকে সমুদ্র দ্বারা পরিবেষ্টিত এই দেশ৷ নদীমাতৃক ও উর্বর এই দেশ৷ বনজ, খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ও উর্বর এই দেশ৷ এ দেশ সুপ্রাচীন কাল থেকে বাইরের ভাগ্যানুসন্ধিৎসুদের আকর্ষণ করে আসছে৷ তারা এই মহামানবের সাগরতীরে এসে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে৷ ভারত ভৌগোলিক দিক হতে প্রায় পৃথিবীর চক্রনাভিতে অবস্থিত এক বিরাট উপমহাদেশ৷ প্রায় ৭৫০ বছর এদেশ বিদেশীদের দ্বারা শাসিত হয়েছে৷ তবে তারা এদেশের মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে গেছে৷ তারপরে সমুদ্রপাড়ের শ্বেত মানুষেরা (ইংরাজ শাসক) এদেশকে কব্জা করে৷ তারা গত ১৯৪৭ সালে ১৫ই আগষ্টে বাধ্য হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে চাপে পড়ে ভারতকে স্বাধীনতা দেয়৷ মহান দেশটিকে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ করে অদূরদর্শী নেতারা ইংরেজের কূটনীতির কাছে হার মেনে নেন৷ ভারত স্বাধীন হয়৷ ১৯৫০ সালে ২৬শে জানুয়ারী ভারতের নিজস্ব সংবিধানের নির্দেশাবলী ও বিভিন্ন ধারা মতাবেক এ দেশ পূর্ণ স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে বিশ্বে স্বীকৃত হয়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা চালু আছে এেেদশে৷ কেন্দ্র ও রাজ্যগুলি যৌথভাবে লোকসভা ও বিধানসভার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসিত হয়৷ উভয় ক্ষেত্রেই শাসক ও বিরোধী দলগুলি মিলিত ভাবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশ শাসন করে থাকেন৷ কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীরা বিভিন্ন বিভাগে মন্ত্রী, উপমন্ত্রী নিয়োগ করে সচিবদের দ্বারা দেশ শাসন করেন৷ এদের মধ্যে লক্ষ্যণীয় হ’ল দেশের আর্থিক উন্নয়নের জন্যে যে বিভাগ সেই হ’ল অর্থবিভাগ৷ এই অর্থবিভাগের জন্যে কেন্দ্রে ও প্রতিটি রাজ্যে একজন করে অর্থমন্ত্রী আছেন৷ ১২০ কোটির অধিক মানুষ এদেশে বাস করে থাকে৷ এদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে বিষয়টি আছে সেটা এই কেন্দ্রীয় অর্থবিভাগের অধীনে৷ দেশের ভিতরে–বাইরে আমদানি–রপ্তানির দিকটা দেখে থাকে এই বিভাগ৷ বেকার সমস্যার সমাধান, উৎপাদন ও বণ্টন নীতিও দেখা এই বিভাগের কাজ৷ দেশের আয় ও ব্যয় এই দুটো হ’ল অর্থ দফতরের অধীন৷ সরকারের আয়ের উৎস সন্ধান করা আর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর বসিয়ে রাজস্ব বৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়াটা হ’ল এই দফতরের কাজ৷ এটা যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ কেন্দ্রীয় প্রশাসন পরিচালনার জন্য, ঠিক তেমনই প্রতিটি রাজ্য সরকারের একজন করে অর্থমন্ত্রী আছেন৷ সেই রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদেরও ঠিক তেমন অর্থ সংক্রান্ত দায়দায়িত্ব আছে৷ রাজ্যের রাজ্যশাসন তালিকায় নির্ধারিত আছে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী কোন কোন আর্থিক বিষয়ের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ আছে৷ তাছাড়া সর্বোপরি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর আর্থিক দায়দায়িত্ব আছে রাজ্যগুলিকে বিভিন্ন খাতে আর্থিক সাহায্য করার৷
এই দীর্ঘ ৭৭ বছর পার হয়ে গেল, গণতান্ত্রিক ভারতে কিন্তু আজও চরম বেকার সমস্যায় ভুগছে সিংহভাগ মানুষ৷ সকলের ক্রয়ক্ষমতা যদি না বাড়ে তাহলে দেশের আর্থিক উন্নতিটা যে কি হ’ল তা সত্য সত্যই কিছুই বোঝা যায় না! ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কাঠামোটা এদেশে বলবৎ আছে৷ গণতন্ত্রকে সত্যসত্যই সার্থক করতে দরকার প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা ও তার বাস্তবায়ন৷ ভারত কৃষিপ্রধান দেশ৷ তাছাড়া প্রাকৃতিক সম্পদে দেশ ভরপুর ও এদেশের মাটির নিচে আজও অফুরন্ত খনিজ সম্পদ আছে৷ দেশের মাটিতে যদি ঠিকভাবে ফসল ফলানো হতো আর সেই কৃষিজাত ফসল থেকে যদি কৃষিভিত্তিক শিল্পের মাধ্যমে শিল্পজাত দ্রব্য উৎপাদন করা হতো ও সেগুলিকে যদি দেশের ও দেশের বাইরের বাজারে রপ্তানি করা হতো তাহলে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের পথে ব্যাপক হতো৷ কারণ আজ বিশ্বের বুকে খাদ্যাভাব হলো বিরাট সমস্যা৷ প্রতিটি ব্লকে ব্লকে ছোট ছোট শিল্প সমবায় গড়ে তুলে বেকার সমস্যার সমাধানের পথের সন্ধান করতে হবে৷ তা কিন্তু হয়নি৷
পশ্চিমের দেশগুলি অর্থনৈতিকভাবে এদেশকে বেঁধে রেখেছে৷ এদেশের উৎপন্াদিত সামগ্রী এদেশের মানুষ যথাযথভাবে ভোগ করতে পারে না৷ বাইরে অনেক ভালো জিনিস চলে যায়৷ এদেশে সন্তুলিত ভাবে কৃষি ও শিল্পে উন্নতি না হওয়াতে দেশের হতভাগ্য নাগরিকগণ একনাগাড়ে শোষিত ও বঞ্চিত হয়ে আসছে৷ দেশের বাইরের কর্পোরেট সংস্থাগুলো ও শিল্পপতিরা সেজ (বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল) ব্যবস্থার জন্যে এদেশে আমমোক্তারী করার সুযোগ পাচ্ছে৷ আর বিরাট দেশের শাসন চালাতে প্রশাসনিক ব্যয়ভার বহন করতে সরকার পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ করের বোঝা জনগণের মাথায় চাপিয়ে জনগণকে চিড়েচ্যাপ্ঢা করে ছাড়ছে৷ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারীদের অবস্থা তাঁরা শোচনীয় করে তুলছেন৷ কথা প্রসঙ্গে বলি এই পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রণ্টের শাসনকালে দীর্ঘ বছর যিনি অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি হলেন শ্রী অসীম দাশগুপ্ত৷ তিনি আয়ের উৎস সন্ধানে কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রী শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর ঢ়ালাও ভ্যাট (ভ্যালু এ্যাডেট ট্যাক্স) চালুর প্রস্তাব দিয়ে অর্থনৈতিক জগতে এক পাকাপোক্ত বোঝা জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে যান৷ বেঁচে থাকার জন্যে যাই ক্রয় কর না কেন তাতেই ওই ভ্যাট দিতেই হবে৷ অসীমবাবু নাকি একজন পাকা অর্থমন্ত্রী ছিলেন৷ আর কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রী শ্রী প্রণববাবু তো বছরে কয়েকবার পেট্রোল, ডিজেল, রান্নার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে অর্থনীতির এমন হাল করে ছেড়েছেন যা কহতব্য নয়৷ প্রণববাবুরা এই মূল্যবৃদ্ধির যাঁরা বিরোধিতা করেন সেই সব রাজনৈতিক নেতা ও মন্ত্রীদের কঠোর সমালোচনা করেন৷ শ্রী মুখোপাধ্যায় একজন ব্যর্থ অর্থমন্ত্রী সে বিষয়ে সন্দেহ নেই৷ কারণ শিল্পে ও কৃষিতে পরিকাঠামোগত উন্নয়নের ব্যয়ভার বহন করার ব্যর্থতার দরুণ শিল্প ও কৃষিতে সমৃদ্ধির হার কমছে৷ এই সমৃদ্ধির হার কমার দরুণই বর্তমান আর্থিক বছরে সমৃদ্ধির হার একেবারে কমে গেছে৷ টাকার অবনমনের অর্থই হ’ল বৈদেশিক বাণিজ্যে রপ্তানীকৃত দ্রব্যের পরিমাণের দারুণ হ্রাসমান অবস্থা৷
ফলে দীঘ ৬৫ বছরে এদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি তো য়নি বরং সর্বনাশ হয়েছে৷ তাছাড়া কেবল ভর্তুকি দিয়ে উন্নয়নশীল দেশ উন্নতি করতে পারে না যদি তার মোট আয়ের উৎস না বাড়ে৷ তাই কৃষিপ্রধান ভারতে ব্যাপক ভাবে কৃষি উৎপাদন ও কৃষিভিত্তিক শিল্পের ওপর জোর দিতে হবে৷ বেকার সমস্যা মেটাতে সমস্ত কলকারখানাকে সচল করতে হবে৷ বিজ্ঞানের সাহায্য একদিকে নিতে হবে আর ম্যান পাওয়ারকেও খাটো করলে চলবে না৷ ছোট ছোট সমবায় শিল্পের মাধ্যমে দেশকে পথ দেখাতে হবে প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের পথ৷ বৈশ্য শ্রেণীর নিছক শোষণের উপর সমৃদ্ধিকে আঁকড়ে দেশ বাঁচতে পারে না৷ অত্যন্ত দুঃখের কথা শরিকদের ওপর দোষ চাপিয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ব্যর্থতাকে ঢ়াকতে পারেন না৷
তাই সরকারকে ভাবতে হবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিভাবে আসতে পারে৷ শুধু কর বাড়িয়ে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেশের কল্যাণ হয় না৷
- Log in to post comments