সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচন ঃ একটি সমীক্ষা

লেখক
প্রভাত খাঁ

ভারতের লোকসভা নির্বাচন শেষ হয়েছে ১৯শে মে আর গণনা হয় ২৩শে মে৷ ২৪শে মে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হয়৷ এই ফলাফলে এন.ডি.এ জোট পেয়েছে ৩৫৩টি আসন৷ ৩০৩টি আসন পেয়ে বিজেপি দল এককভাবে সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে ভারতের শাসন ক্ষমতার  অধিকার লাভ করেছে৷ অপরদিকে ইউ.পি.এ. ৯২টি আসন পেয়েছে৷ কংগ্রেস এককভাবে পেয়েছে ৫২টি আসন, বিরোধী দলের মর্যাদা পেতে গেলে এক দশমাংশ অর্থাৎ ৫৪টি আসনের প্রয়োজন ছিল৷ সেটা হয়নি৷  তাই কংগ্রেস আপন শক্তিবলে বিরোধী দলের মর্যাদা পাচ্ছে না ও অন্যান্য দলের মোট আসন ৯৭ টি৷

এদিকে দেখা যাচ্ছে ৪২টি আসনের মধ্যে যথাক্রমে তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ২২টি  আসন, বিজেপি পেয়েছে ১৮টি আসন ও জাতীয় কংগ্রেস দল পেয়েছে ২টি আসন৷ সিপিএম তথা বামফ্রন্ট কোন আসনই পায়নি৷ ১৯১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল পেয়েছিল ৩৪টি, এবারে তৃণমূল ১২টি আসন আসন হারিয়েছে বিজেপির কাছে৷  সমীক্ষায় দেখা যায় যে সারা ভারতে গড়ে ৬০ শতাংশ বোট (ভোট) পড়েছে৷ ৪০ শতাংশ বোট পড়েনি৷  এই ৬০ শতাংশ  ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে৷ দীর্ঘ ৭২ বছর হল ভারত স্বাধীনতা পেয়েছে৷ বর্তমান লোকসংখ্যা প্রায় ১৩৩ কোটি৷ তাদের মধ্যে সকলের ভোটাধিকার নেই৷ এদেশে ১৮ বছরের পর নাগরিক অধিকার পাওয়া যায়৷ এবারে লোকসভা বোট ৭ দফায় হয়৷  লোকসভার সদস্য সংখ্যা মাত্র ৫৪২জন৷ এই যৎসামান্য সদস্য নির্বাচনে প্রচণ্ড গরমের দিনে প্রায় দুই মাস ধরে বোট প্রক্রিয়া চালিয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করে নির্বাচন কমিশন ভারতে নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেন৷ কিন্তু দেশের ৪০ শতাংশ নাগরিকগণ কেন নির্বাচনে মতামত দান করা থেকে বিরত থাকলেন,  তার কী কোন সমীক্ষা হয়েছে? এই নির্বাচন ঘিরে পশ্চিমবাঙলায় তো চরম হিংসাশ্রয়ী  পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো৷  কলকাতায় বিজেপির রোড শো কে কেন্দ্র করে দেশের পরম শ্রদ্ধেয় মনীষী বিদ্যাসাগরের মূর্ত্তি ভাঙার মতো নক্ক্যারজনক ঘটনাও ঘটল৷ কেন্দ্রে শাসকদলের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ আনা হয়েছে৷ সেগুলির দিকে নির্বাচন কমিশন কোন কর্ণপাতই করেন নি৷ ভারতের বিশাল দেশে  নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই নিরপেক্ষ হতে হবে৷ তবেই তো গণতন্ত্র রক্ষা পাবে৷ টিভিতে দেখা গেছে, আধা সামরিক বাহিনী কোথাও কোথাও অনেকে ধৈর্য সহকারে কাজ করেছেন৷ আবার কোথাও কোথাও আচরণ সঠিক হয়নি৷ এইসবের দিকে নজর দেওয়াও উচিত ছিল৷ এত সাবধানতার মধ্যে ই.ভি.এম বিভ্রাট বাঞ্ছনীয় নয়৷ সেটাও হয়েছে৷  সংবিধানের মতে নির্বাচন কমিশন হলো সম্পূর্ণ স্বাধীন সংস্থা ৷ নির্বাচন কমিশনের আচরণ অবশ্যই প্রশ্ণাতীত হবে, এটাই কাম্য৷

ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থা যতদিন যাচ্ছে, ততই দেখা যাচ্ছে এটা একটা, বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের স্বৈরাচারী শাসনে, কি কেন্দ্র কি রাজ্য দুটিই লুটপাটের আখড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ হত দরিদ্র জনগণ কেবল করের বোঝা মাথায় নিয়ে, বেকার সমস্যার যন্ত্রণায় কাতর হয়ে, দিন যাপনের গ্লাণি বহন করে চলেছেন৷ সংবিধানকে অদ্যাবধি ১২৫ বার সংশোধন করে তাকে প্রায় শেষ করেই ছেড়েছে৷ আর্থিক দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারীতে দেশ আজ নিঃস্ব৷ জনপ্রতিনিধিরা অধিকাংশই কোটি কোটি টাকার মালিক৷ ধনীরা ধনেপুতে লক্ষ্মী লাভ করছে৷ জনগণের দিন যে কিভাবে চলছে তার সংবাদ শাসকগণ রাখেন না, দেশে নাকি গণতন্ত্র চলছে! রাজনৈতিক দলগুলি ভারতে প্রায় ৪৪টি সমাজকে জাত-পাত, উচ্চ-নীচ,  ছোট-বড় নানাভাবে টুকরো টুকরো করে ধবংস করে ছেড়েছে৷

আর দেশটিকে টুকরো টুকরো করে অসংখ্যভাগে ভাগ করে শোষণ করে চলেছে৷ নির্বাচনটা এই দলগুলির কাছে একটা সাংবিধানিক অধিকার লাভের টিকিট পাওয়ার মতো ব্যাপার৷ তাই যে দল শাসন ক্ষমতায় আসে তারা নিজেদের মতো করে একটা নির্বাচন করে থাকে৷  তা না হলে এত গরমে ৭ দিন ধরে সামান্য ৫৪২ জনকে নির্বাচিত করতে ভারতের মতো গরিষ্ঠ দেশে হাজার হাজার, কোটি কোটি টাকা খরচ করে দলীয় কোন্দলে  নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়ে নির্বাচন করায়৷ এত টাকা কোথা থেকে এল, কারা খরচ করল? নির্বাচন কমিশন এসবের হিসাব  জনগণকে দিতে পারবেন? তাই সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে নির্বাচন থেকে সরে যাচ্ছে৷ ‘নোটা’র সংখ্যা বাড়ছে,  গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা কমছে ৷  নির্বাচন বর্তমানে একটা ভয়ঙ্কর প্রহসনে পরিণত হয়েছে৷ নির্বাচনের পরও  কোথাও কোথাও  মানুষের রাতে ঘুম নেই৷ পাড়ায় পাড়ায় লড়াই হচ্ছে, লড়াই হচ্ছে ভাইয়ে ভাইয়ে৷ কিন্তু বিজেপিরা আনন্দ উৎসব করছে৷ এ কেমন গণতন্ত্র? এর সদুত্তর শাসকগণ কি দিতে পারবেন? নির্বাচন এলেই কি মাযের কোল খালি হবে! উলুখাগরার প্রাণ যাবে৷ দলের শ্রী বৃদ্ধি ঘটবে, এটা বন্ধ হোক৷ প্রত্যেক নাগরিক যেন  শান্তিতে নিজ নিজ এলাকায় বোট দান করতে পারে৷ তার গ্যারান্টি দিতে হবে রাজনৈতিক দলগুলিকে৷ এরাই তো ছাপ্পা বোট দিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে  মানুষকে বঞ্চিত করে৷ দলগুলোর সংযম, নৈতিকতা সেবার মানসিকতাকে  শ্রদ্ধা দিয়ে  গণতন্ত্রকে রক্ষার দায়িত্ব নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিক৷ অনেক হয়েছে আর নয়৷

মনে পড়ে, সেই ১৯৫২ সালের কথা যেদিন প্রথম সাধারণ নির্বাচনে জহরলাল নেহেরু প্রধানমন্ত্রী বর্ধমানের বিখ্যাত শিক্ষাবিদ শ্রদ্ধেয় সুকুমার সেনকে  চীফ্ ইলেকশন কমিশনার করেন৷ তিনি যে কি ফ্যাসাদে পড়েন তার ঠিক ঠিকানা নেই৷  কয়েক লক্ষ ভোটার যাদের নাম নেই, তারা রামের, শ্যামের মা এমন ধরণের নাম৷ তিনি সব বাদ দেন৷  পরে ত্রিপুরার মিঃ সেনবর্র্ম,মিঃ শেষন-এর মতো দঁুদে চিফ কমিশনার আসেন৷ পৃথিবীর ইতিহাসে ভারতের  নির্বাচন পদ্ধতির একটা সুনাম আছে৷ কিন্তু সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের সাত দফায় যা এই পশ্চিমবাঙলা দেখল, সেটা ইতিহাসে এক ন্যক্কাবজনক ঘটনা৷ বোটে কালো টাকার খেলা ধরা পড়ছে কমিশনের হাতে৷ তাহলে কত টাকা বাজারে ছড়ানো হয়েছে তার হিসাব আছে কি? নির্বাচনকে কালো টাকায় কলঙ্কিত করার লজ্জাটা মানবতার দরবারে চরম অপরাধ৷ লজ্জার কথা, সাক্ষী এই হতভাগ্য বাঙলা আর বাঙলার রাজনৈতিক নেতারা৷ হায় নির্বাচন!