তোমার আসা যাওয়া

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্‌হা

আমার এই দীন দুয়ারে

          তোমার নিত্য আসা-যাওয়া

তবু কেন অশ্রু-ধারে

          আকুল-ব্যাকুল পথ চাওয়া৷

বুঝিনা যে তোমার মরম

          বিশ্বজুড়ে অপার লীলা

তোমার ভাবে বিভোর এ মন

          দিবানিশি সারা বেলা৷৷

ভক্ত ও ভগবানের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক চিরন্তন, শাশ্বত, অন্তরের পবিত্রতায় সমুজ্জ্বল৷ ভক্তকে নিয়ে লীলাময়ের কত না ছলাকলা, লুকোচরি খেলা আর ভগবানের সঙ্গে ভক্তের মান অভিমান, প্রেম-ভালবাসা, পাওয়া-হারানোর অম্ল-মধুর রসায়ন৷ বিশ্ব সংসার, গ্রহ-নক্ষত্র, জড়-জীব, চেতন-অচেতন সব তাঁরই সৃষ্ট, তাঁতেই বিধৃত---আর পরমপুরুষও তাঁর সৃষ্টি মাঝেই ওতঃপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত৷ ভক্ত জানে যে পরমপুরুষ তার চারপাশে বিরাজমান---হৃৃদয়ের অন্তঃপুরে, মনের মণিকোঠায় অধিষ্ঠিত, তথাপি সেই অরূপ সত্তাকে রূপের প্রকাশে, মানবীয় আধারে তার একেবারে কাছটিতে পেতে চায়---হাসি-আনন্দ, দুঃখ-বেদনার সাথী করতে চায়৷ ভক্ত মনের এই চাওয়াও চিরন্তন৷ যুগে যুগে মুনী-ঋষি মহাভক্তগণ এভাবেই পরমপুরুষকে একান্তে পেতে চেয়েছেন, পেয়েওছেন৷ অপরপক্ষে পরমপুরুষও ভক্তের আকুল আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে নব নব রূপে ধরা দেন ও কোটি জনমের পুণ্যের ফলে পাওয়া ভক্তের মানব জীবনকে সার্থকতায় ভরিয়ে তোলেন৷

বিংশ শতাব্দীর মানুষ ভাগ্যবান৷ অগণিত ভক্ত-সাধক-মনীষীগণের আন্তরিক আহ্বানে ধূলার ধরণীতে মানব শরীরে আবির্ভূত হলেন এক দিব্যশিশু ১৯২১ সালের বৈশাখী পূর্ণিমার পুণ্যলগ্ণে শ্রীলক্ষ্মীনারায়ণ সরকারের গৃহকোণ আলোয় উদ্ভাসিত করে৷ তাঁর পিতৃদত্ত নাম শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার ও পরবর্তীকালে তিনিই আধ্যাত্মিক গুরু রূপে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী নামে বিশ্বসংসারে পরিচিত হয়েছিলেন৷ দীর্ঘ প্রতীক্ষার হ’ল অবসান৷ বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই সমগ্র পৃথিবী হিংসা-সন্ত্রাস, যুদ্ধ-বিগ্রহে বিপর্যস্ত, চতুর্দিকে অস্ত্রের ঝনঝনি, দুরাত্মা-দুর্বিনীত অত্যাচারীর শাসন-শোষণে সাধারণ মানুষ নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত---মানবতা ভূলুণ্ঠিত, নীতিবাদী, ধার্মিক মানুষজনের অস্তিত্ব ভয়ঙ্করভাবে বিপন্ন৷ তখনই তারকব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণ প্রদত্ত মহাভারতের আশ্বাসবাণী ‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারতঃ / অভ্যুত্থানম্‌ অধর্মস্য তদাত্মানম্‌ সৃজামহম্‌’-কে সত্য প্রতিপন্ন করে ধরাধামে মানবাধারে অবতীর্ণ হলেন তারকব্রহ্ম মহাসম্ভূতি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী৷ যন্ত্রণাতপ্ত পৃথিবীতে ভাবজড়তা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষদের গড়ে তুলতে লাগলেন আধ্যাত্মিকতার আদর্শে৷ আধ্যাত্মিক সাধনা অনুশীলনের দ্বারা দিশাহীন মানুষ উন্নততম জীবনাদর্শের সন্ধান পেল৷ তাঁর দিব্য সান্নিধ্যে ও সাধনার মাধ্যমে অভূতপূর্ব আনন্দের আস্বাদনে সমর্থ হলেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অসংখ্য অতি সাধারণ মানুষজন৷ অজ গ্রাম থেকে শহর, দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে গেলেন তাঁর প্রতিনিধিরূপে নবীন সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীর দল৷ অত্যন্ত অখ্যাত নারী-পুরুষদের নিয়ে তিনি গড়ে তুললেন এক বিশ্ব সংঘটন ‘আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘ’৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী প্রবর্তিত আনন্দমার্গ দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক জীবনাদর্শের বার্তা দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দিলেন আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘের একনিষ্ঠ সর্বক্ষণের কর্মীবৃন্দ৷ তাঁরই অহৈতুকী কৃপায় ও নির্দেশনায় অতি সাধারণ কর্মীগণ অসাধারণ কর্ম সম্পাদন করতে লাগলেন ও মানুষের কল্যাণে, সমাজের সেবায় আত্মনিয়োগ করলেন৷ আনন্দমার্গের সাধনার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদের লেশমাত্র রাখা হয়নি৷ তাই সমাজের সর্বস্তরের মানুষ অধ্যাত্ম সাধনার সুযোগ গ্রহণ করে উপকৃত হলেন৷

পুঁজিবাদ ও জড়বাদের জোড়া ফলায় বিদ্ধ সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিসহ৷ এক শ্রেণীর স্বার্থপর অর্থলোলুপ সুযোগ-সন্ধানী মানুষের দল পৃথিবীর সমস্ত সম্পদকে করায়ত্ত করার বাসনায় কোটি কোটি মানুষের ওপরে চালিয়ে গেছে শোষণের স্টীমরোলার৷ পুঁজিবাদী শোষকের ভাণ্ডারে সঞ্চিত হয়েছে সম্পদের পাহাড়, ভোগ-বিলাসের বিপুল আয়োজন---অন্যদিকে অসংখ্য শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের হাহাকার, আর্তনাদ, অনাহার, অর্ধাহার, অপুষ্টি, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, আশ্রয়হীনতা, ও জীবনের অনিশ্চিততা৷ এই বিভীষণ যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণের জন্যে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার প্রবর্তন করলেন সামাজিক অর্থনৈতিক দর্শন ‘প্রাউট’ PROUT—Progressive Utilization Theory) বা প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব৷ এই তত্ত্বে তিনি দ্বিধাহীন ভাবে ঘোষণা করলেন জগতের সমগ্র সম্পদের মালিক একমাত্র পরমপিতা সৃষ্টিকর্তা ও এই সম্পদে প্রতিটি মানুষ সহ সমগ্র সৃষ্ট সত্তার সমান অধিকার রয়েছে কারণ প্রতিটি সৃষ্ট সত্তাই পরমপুরুষের সন্তান-সন্ততি৷ অন্যকে বঞ্চিত করে এই সম্পদ কুক্ষিগত করার অধিকার কারো নেই৷ পৃথিবীর সমস্ত জাগতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক সম্পদের সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ করে সকলের কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে৷ প্রাউটের অর্থনীতি অনুযায়ী সমাজের সকলের সুবিধার্থে ও মঙ্গলসাধনে বিকেন্দ্রিত অর্থনীতির প্রচলন করতে হবে৷ কারণ বর্তমানে প্রচলিত পুঁজিবাদী বা তথাকথিত সাম্যবাদীদের কেন্দ্রিত অর্থনীতিই হচ্ছে শোষণের প্রধান উৎস৷ আর এই শোষণের উৎসকে সমূলে বিনাশ করার জন্যে ব্লক ভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে স্বয়ং সম্পূর্ণ আর্থ-সামাজিক অঞ্চল ঘটন করে সেই অঞ্চলে সকল স্থানীয় অধিবাসীদের একশত শতাংশ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে ও সকলের নূ্যনতম প্রয়োজন মেটানোর জন্যে যথেষ্ট ক্রয়ক্ষমতা সুনিশ্চিত করতে হবে৷ প্রাউট অর্থনীতির মূল উপাদান হ’ল সমবায়ের মাধ্যেমে সমস্ত মানুষের অংশগ্রহণের অধিকারের দ্বারা অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণ৷ সমবায় প্রথা সফল করার প্রধান চালিকা শক্তি হচ্ছে নীতিবাদ আর আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক জীবনাদর্শই মানুষকে নীতিবাদে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে৷ সেই কারণে সমাজ ও সমবায়ের নিয়ন্ত্রণে থাকবেন আধ্যাত্মিকতায় প্রতিষ্ঠিত নীতিবাদী আপোষহীন সংগ্রামী সদ্‌বিপ্র নেতৃত্ব, যাতে কোন অশুভ শক্তি সমাজের কোন ক্ষতি করতে না পারে৷ এইভাবেই রচিত হবে শোষণমুক্ত সকলের বাসযোগ্য মানুষের প্রকৃত সমাজ৷ সীমিত পার্থিব সম্পদকে নিয়ন্ত্রিত রূপে সকলের কল্যাণে ব্যবহার করে মানুষের অসীম আকাঙ্ক্ষাকে অনন্ত আধ্যাত্মিক জগতে পরিচালিত করার মাধ্যমে মানুষের সমাজকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তুলতে হবে৷ (ক্রমশঃ)