সরিবে দুর্নীতিরাজ

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

দুর্নীতির জালে জড়িত রাষ্ট্র৷ স্বাধীনতার জন্মলগ্ণের আগে থেকেই দুর্নীতির গুঞ্জন শুরু হয়েছিল ক্ষমতার অলিন্দে৷ শক্তি ও স্পর্ধার প্রভাবে রাজনৈতিক ব্যাভিচারের অভিযোগ উঠেছিল স্বাধীনতার আগেই৷  স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ নেহেরুকে এক পত্রে লিখেছিলেন---‘‘কংগ্রেসেরও অন্তঃসঞ্চিত ক্ষমতার তাপ হয় তো অস্বাস্থ্যের কারণ হয়ে উঠেছে বলে সন্দেহ করি৷’’ সেই ক্ষমতার তাপ আজ দুর্নীতির ভাইরাস হয়ে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে৷ আজ ভারতবর্ষে রাজনীতি ও দুর্নীতি একে অপরের পরিপূরক৷ অবশ্য দুর্নীতি বলতে শুধু আর্থিক কেলেঙ্কারিকেই বোঝায় না৷ রাষ্ট্রের পরিচালকরা আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করতে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অব্যবহার করাটাই দুর্নীতি৷ সেই অর্থে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই কম-বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত৷

আজ পুঁজিবাদ বিশ্বব্যাপী যে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে তার অন্যতম হাতিয়ার দুর্নীতি৷ পুঁজিবাদ নির্ভর গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় রাজনৈতিক নেতারা পুঁজিপতিদের হাতের পুতুল হয়ে যায়৷  দুর্নীতির জালে রাষ্ট্র নেতাদের জড়িয়ে দিয়ে শোষণের জাল বিস্তার  করা পুঁজিবাদী ফ্যাসিস্ট শোষকদের  কুট কৌশল৷ ক্ষমতালোভী, অর্থলোলুপ, আত্মসুখ সর্বস্ব নেতারা  খুব সহজেই পুঁজিবাদের জালে জড়িয়ে পড়ে৷ স্বাধীনতার বহু আগে থেকেই ভারতীয় পুঁজিপতিরা রাজনৈতিক দল ও শাসকের ওপর প্রভাব খাটিয়ে ব্যবসা করে আসছে৷ স্বয়ং সুভাষচন্দ্র অভিযোগ করেছিলেন---‘‘দেশীয় পুঁজিপতিরা ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে শক্তি যোগাচ্ছে৷ এদের বিরুদ্ধেও আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে৷’’ সুভাষচন্দ্রকে ভারতীয় রাজনীতি থেকে উচ্ছেদের যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল তার অন্যতম কারণ সুভাসচন্দ্রের ওই উক্তি৷ স্বাধীনতার পর দেশীয় পুঁজিপতিরা ধীরে ধীরে রাজনৈতিক নেতাদের  দুর্নীতির জালে জড়িয়ে অর্থনৈতিক ক্ষমতার পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষমতারও নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ায়৷ 

এই জাল থেকে বেরোবার পথ আজ ডান বাম রাম কারো জানা নেই, অথবা জানা থাকলেও বৃত্তির তাড়নায় অসহায় ভাবে আত্মসমর্পণ করে পুঁজিবাদের চরণ তলে৷ একদা যে বামেদের  মিছিলে রাজপথে শোণা যেত --- পুঁজিবাদের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও আজ তারাই পুঁজিবাদের তোষণ করছে৷  সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে আমরা তাই দেখেছি৷ রাজনৈতিক নেতাদের নৈতিক অধঃপতনের অন্যতম কারণ অধিকাংশ নেতাই মানব ধর্মের অনুশীলন ভুলে গেছে৷ বিশ্বকবি বলেছেন---‘পশু বলছে সহজ ধর্মের পথে ভোগ করো৷ মানুষ বলছে মানবধর্মের সাধনা কর৷ আজ মানুষ মানব ধর্মের সাধনা ভুলে সহজ ধর্মের পথে ভোগ লালসার পথে ছুটে চলেছে৷ এদের কারো কাছে ধর্ম আফিম, কারো কাছে ধর্ম স্বর্ণ ইটের মন্দির৷ পশুর ধর্ম পালন করতে করতে মানুষ দিন দিন  পাশবিক হয়ে যাচ্ছে৷  সমাজের কোণায় কোণায় তারই প্রভাব পড়ছে৷ বর্তমান সামাজিক বিপর্যয়ের মূল কারণ এটাই৷ গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো আছে ভ্রান্ত দর্শন৷ মানুষকে বিপদগামী করার সবরকম উপকরণ---শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷

অর্থনৈতিক বৈষম্য, ধর্মের নামে ব্যাভিচার, শিক্ষার অঙ্গনে উশৃঙ্খলতা, সংস্কৃতির নামে অশ্লীলতা সমাজকে করে তুলেছে বিপর্যস্ত, শোষণের পথ করেছে প্রশস্ত৷ সমাজকে এই বিপর্যয়ের হাত থেকে উদ্ধার করে শোষণমুক্ত আদর্শ সমাজ গড়ে তোলার সুনির্দিষ্ট পথ নির্দেশনা দিয়েছেন আনন্দমার্গ দর্শনের প্রবক্তা পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী, যাঁর লৌকিক জগতের নাম শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার৷ জগৎ ও জীবন, ধর্ম, অর্থ, রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞানভিত্তিক পথনির্দেশনা দিয়েছেন তাঁর আনন্দমার্গ দর্শনে৷ এই দর্শনেরই অন্তর্ভুক্ত সামাজিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব --- প্রগতিশীল উপযোগতত্ত্ব৷  সংক্ষেপে প্রাউট যার ভিত্তি আধ্যাত্মিক নব্যমানবতাবাদ৷ আধ্যাত্মিক নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্ব ছাড়া সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করা  কখনওই  সম্ভব নয়, তাই প্রাউটতত্ত্বের প্রবক্তা নেতৃত্বের গুণাবলী প্রসঙ্গে বলেছেন--- শারীরিক সক্ষম, মানসিকতায় দৃঢ় ও সর্বপ্রকার সংকীর্ণতামুক্ত উদার হৃদয়ের অধিকারী হতে হবে নেতৃত্বকে৷ তিনি এই নেতৃত্বের নাম দিয়েছেন সদ্‌বিপ্র ৷  এই নেতৃত্বের পক্ষেই সম্ভব হবে মানুষকে সর্বপ্রকার শোষণ ও  দুর্নীতিমুক্ত আদর্শ সমাজ উপহার দেওয়া৷  তাই শুধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে চিৎকার করে সমাজকে উদ্ধার করা যাবে না, সমাজের সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের উচিত আনন্দমার্গ দর্শন সম্পর্কে অবগত হয়ে আদর্শ সমাজ গড়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া৷ তবেই এই দুর্নীতিরাজ সরবে৷