শুভ হোক ১৪৩০

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

নববর্ষের নবীন সূর্য উদিত হয়েছে পূর্ব দিগন্তে৷ আরও একটি বৎসরকে পিছনে ফেলে এগিয়ে এসেছে নূতন বছর৷ নূতন বৎসর নিয়ে এসেছে নবজীবনের বারতা৷ বাঙালীর প্রাণে প্রাণে নূতনের আবাহন৷ ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে শহর ও গ্রামে সবখানে জেগেছে বিপুল প্রাণের স্পন্দন৷ আশা ও আশঙ্কার দোলাচল, তবু বাঙালীর আত্মার আবাহন এসো হে বৈশাখ৷ দুঃখ–গ্লানি, বেদনা–ব্যর্থতা পিছনে ফেলে নূতন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের আশায় গভীর আবেগে উদ্বেল বাঙালী৷ বাঙলা নববর্ষের সাথে বাঙালীর সম্পর্ক পরম আত্মীয়তার, এ সম্পর্ক নাড়ির৷ আজও নাগরিক জীবনের ও সরকারী কাজের সবকিছু ইংরেজী ক্যালেণ্ডার মেনে চললেও বাঙালীর মন জুড়ে আসন পেতে রেখেছে বাঙলা নববর্ষ৷ বাঙলার কর্ষক, এই দেশের প্রান্তিক মানুষ, বাঙলা পঞ্জিকার দিন–তারিখ গণনা করেই সবকিছু করেন৷ বাঙলা মাসের হিসাবেই এইখানে আবর্তিত হয় ছয় ঋতু৷ যুগ যুগ ধরে এই দেশের চাষী–মজুর–কামার–ক্ ও জেলে সহ নানান পেশার মানুষ বাঙলা নববর্ষ বরণ করে এসেছে বিবিধ উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে৷ বাঙলা নববর্ষে এখনও হালখাতা হয়, হিসাবের নূতন খাতা খোলেন ব্যবসায়ীরা৷

বাঙলার প্রকৃতির বিচিত্রতার সাথে মিল রেখে প্রবর্তিত হয় বাঙলা সন৷ বাঙালীর জীবন ধারার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক এই সনের মাস ও ঋতুচক্রের৷ প্রধানত শস্যের মৌসুম চিহ্ণিতকরণ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বাঙলা বর্ষপঞ্জী চালু করা হলেও এটা মিশে গেছে গোটা জাতির অস্থি–মজ্জায়, রক্ত ধারায়৷ চৈত্রে রবিশস্য, বৈশাখে বোরো, শ্রাবণে আউশ, আষাঢ়–শ্রাবণে ঘনঘোর বরষা, নদীজল ছলছল, শরতে কাশবনে বাতাসের দোলা, অঘ্রাণে নবান্নের উৎসব, পৌষে পিঠাপুলি, মাঘে কনকনে শীত, এ সবই আবহমান বাঙলার অতি চেনা অনুষঙ্গ৷ বৈশাখ এইখানে আসে কালবৈশাখির আশঙ্কা নিয়ে৷ তা সত্ত্বেও সমস্ত ভয় অগ্রাহ্য করে এইখানে বৈশাখ আসে জীবন সংগ্রামের অশেষ প্রেরণা সঞ্চারিত করে৷ জীর্ণ পুরাতনকে ভাসিয়ে দিয়ে নিয়ে আসে নবতর জীবন সাধনার অভয়বাণী৷ অনেক অর্জন–নার্জন, রাজনৈতিক সংঘর্ষ, খুনোখুনি, মাওবাদী সঙ্কট প্রভৃতির মধ্য দিয়ে আমরা অতিবাহিত করেছি ১৪২৯ বাঙলা সন৷ আমাদের সমস্যার অন্ত নেই৷ সম্ভাবনার দুয়ারও উন্মোচিত নয়৷ দারিদ্র্য এখনও আমাদের সবচাইতে বড় সমস্যা৷ দেশ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে৷ এর মাঝেও আছে আশা ও নিরাশার দোলাচল৷ কিন্তু রাজ্যে শাসকদলের দলীয় সন্ত্রাসে বাঙালী জীবন ওষ্ঠাগত৷ বিদ্যুৎ সংকটে নাকাল রাজ্যবাসী৷ ১৪২৯ সনের নানা সমস্যা নিয়ে আমরা পদার্পণ করলাম ১৪৩০ সনে৷ নূতন প্রভাতে বিদায়ী বর্ষের পাওয়া না পাওয়ার হিসেব আমরা অবশ্যই করব৷ যা অর্জন করেছি, তাকে বিকশিত করতে হবে, ধরে রাখতে হবে সাফল্যের ধারাবাহিকতা৷ আর যা অর্জন করা যায় নি, তাও অর্জন করতে হবে৷ খুঁজে দেখতে হবে না পারার কারণ৷ আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে ব্যষ্টিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে নির্মাণ করতে হবে সাফল্যের নতুন পথ৷৷ মোচন করতে হবে ভুল ও ব্যর্থতার সমস্ত গ্লানি৷ বাঙলা নববর্ষ যেমন সুর সঙ্গীতের, মেলা ও মিলনের, আনন্দ উদ্যাপনের, তেমনই সাহস ও সংকল্পের৷ রাজ্যের মানুষ শান্তি চায়, চায় আইনের শাসনও সকল মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চিততা৷ পরমতসহিষ্ণুতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বিবেক ও মনুষত্বের দীক্ষা যেন আমরা গ্রহণ করতে পারি৷ আমাদের অন্তর বিকশিত হোক, সুন্দর হোক নববর্ষের নবীন প্রভাত, এটাই আমাদের ঐকান্তিক প্রার্থনা৷ নববর্ষের শুভ দিনে পরমপুরুষের কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি ব্যষ্টিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের সকল পর্যায়ে সুখ ও সমৃদ্ধি৷ সকলের জন্যে শুভ হোক  নববর্ষ৷