৩০শে এপ্রিল ১৯৮২ – রাতের চেয়ে অন্ধকার এক সকাল

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

৩০শে এপ্রিল ১৯৮২–দিনটা ছিল শুক্রবার৷ প্রভাত সূর্যের রাঙা আলো গায়ে মেখে জেগে উঠেছে মহানগর কোলকাতা৷ ঘুম ভাঙা চোখে কেউ বা থলি হাতে বাজারের পথে, কেউ বা ঘর থেকে বার হয়ে গলির চায়ের দোকানে ভীড় জমিয়েছে৷ আর পাঁচটা দিনের মতই সাধারণ একটি দিন৷ তখনও কেউ বোঝেনি এই সকালটা আর পাঁচটা সকালের মত সাধারণ হয়ে থাকবে না৷

ওই সকালেই হাওড়া ষ্টেশন থেকে ট্যাক্সি ধরে দক্ষিণ কোলকাতার জনবহুল বালীগঞ্জ ষ্টেশন সংলগ্ণ বীজনসেতুর পথ ধরে আনন্দমার্গের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভি আই পি নগরের দিকে চলেছিলেন আনন্দমার্গের কিছু সন্ন্যাসী, সন্ন্যাসিনী৷ সর্বত্যাগী, সদাহাস্যময় সন্ন্যাসী–সন্ন্যাসিনীদ্ চোখেমুখে ছিল না কোন উদ্বেগের ছাপ৷ নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ মনেই তাঁরা গড়িয়াহাট পার হয়ে বীজনসেতুর মুখে এসে পঁৌছায়৷ নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ মনেই ছিল আশপাশের মানুষগুলোও৷ কেউ বা বাজারে সবজির দর দস্তুর করছেন, কেউ বা খবরের কাগজে চোখ রেখে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন৷ কারো মনে কোন আতঙ্ক উদ্বেগ থাকার কথাও নয়৷ কারণ বীজনসেতু কোন দস্যু কবলিত চম্বলের ভয়ংকর জঙ্গল নয়৷ হিংস্র জানোয়ারে ভরা আফ্রিকার দুর্গম গহন অরণ্য নয়৷ বীজনসেতু কোন বীজন জনপথও নয়৷ বিবেকানন্দ, রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র, সত্যজিৎ রায়ের শহর সভ্যতা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান কোলকাতা মহানগরীর অভিজাত জনবহুল এলাকায় অবস্থিত বীজনসেতু৷ দুরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ট্রেন থেকে পড়ে প্রাণ দিয়েছিলেন বীজন বসু৷ তাঁরই নামাঙ্কিত বীজনসেতু ওই সকালে ঘাতকের বদ্ধভূমিতে পরিণত হয়৷

সেই প্রভাতে ওই বীজনসেতুর আনাচে–কানাচে জন–চক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে ছিল চম্বলের দস্যুর চেয়ে ভয়ংকর, আফ্রিকার গভীর জঙ্গলের জানোয়ারের চেয়েও হিংস্র কিছু দ্বিপদ জীব৷ তাদের সঙ্গে ছিল লোহার রড, অ্যাসিড ব্লাব, ছোরা, ভোজালী, প্রেট্রোল ভর্ত্তি ডিবে৷ ট্যাক্সিগুলি বীজনসেতুতে উঠতেই সন্ন্যাসী–সন্ন্যাসিনীদ্ ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওই দ্বিপদ জীবেরা৷

কিন্তু ওই দ্বিপদ জীবেরা প্রকৃত ঘাতক নয়, যে হাতগুলো লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে সন্ন্যাসী–সন্ন্যাসিনীদ্ দেহের হাড়–পাঁজড়া ভেঙে দিয়েছিল, যে হাতগুলো চোখে অ্যাসিড ঢ়েলে দিয়েছিল, অথবা ভোজালী দিয়ে চোখ উপড়ে নিয়েছিল, যে হাতগুলো সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর অর্ধমৃত দেহগুলো পেট্রোল ঢ়েলে জ্বালিয়ে দিয়েছিল, সে হাতগুলো প্রকৃত ঘাতকের হাত নয়, প্রকৃত ঘাতক বসেছিল আলিমুদ্দিন ষ্ট্রীটের পার্টী–ফিসে, প্রকৃত ঘাতক ছিল কসবা তিলজলার থানায় বসে, প্রকৃত ঘাতক হিন্দুস্থান পার্কের বাড়ী থেকে পালিয়েছিল দার্জিলিঙে৷

বিংশ শতাব্দীর বর্বরতম, নিষ্ঠুরতম ঘটনাটি ঘটে গেল বীজনসেতুতে৷ সংখ্যা তত্ত্বের বিচারে অনেক হত্যা অনেক রক্তাক্ত ঘটনার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে বিংশ শতাব্দী৷ কিন্তু পাশবিকতায় ও নিষ্ঠুরতায় সব হত্যাকাণ্ডকে ম্লান করে দিয়েছে বীজনসেতু৷ নন্দীগ্রামের নারকীয় ঘটনা দেখে যে সহূদয় রাজ্যপাল হাড় হিম করা সন্ত্রাসের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন, বীজনসেতু চোখে দেখলে তিনিও নির্বাক হতেন৷ কারণ বীজনসেতুর পাশবিকতা কোন ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না৷ আতঙ্কিত, ব্যথিত কোলকাতাবাসীর মনে তখন একটিই জিজ্ঞাস্য–রাতের চেয়ে অন্ধকার নিয়ে একোন সকাল এলো কোলকাতার বুকে

ব্যথাকাতর, লজ্জায় নত হয়ে যাওয়া মানুষগুলো মুখে তখন প্রশ্ণ–সভ্যতা ও সংস্কৃতির পীঠস্থানকে এভাবে কলঙ্কিত করে দিল যে ঘাতকের দল–তারা কারা এ প্রশ্ণের উত্তর আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়৷–সত্য প্রচারের অপরাধে যারা মহাবিজ্ঞানী গ্যালিলওকে কারারুদ্ধ করেছিল–এরা তারা৷ দার্শনিক সক্রেটিসকে হেমলোক বিষ পান করতে বাধ্য করেছিল যারা–এরা তারা৷ প্রেমের বাণী প্রচারের অপরাধে খ্রাইষ্টকে ক্রুসবিদ্ধ করেছিল যারা–এরা তারা৷ দেশপ্রেমিক জোয়ান অব আর্ককে ডাইনি অপবাদে হত্যা করেছিল যারা–এরা তারা৷ নির্মম অমানবিক সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে গিয়ে আধুনিক ভারতের জনক রাজা রামমোহন রায় নির্যাতীত হয়েছিলেন যাদের হাতে–এরা তারা৷ বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসকে দেশদ্রোহী বলেছিল যারা–এরা তারা৷ সমাজতন্ত্রের মুখোশ পরে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহক হয়েছে যারা–এরা তারা৷ এই ঘাতকদের আধুনিক নাম সি পি আই (এম)–এর পশ্চিমবাঙলার শাসক, এরাই বীজনসেতুর ঘাতক৷

এই ঘাতকদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আনন্দমার্গকে শেষ করে দেওয়া, ধ্বংস করে দেওয়া৷

কিন্তু ঘাতকদের সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি৷ আনন্দমার্গকে ধ্বংস করা যায়নি, ধ্বংস করা যাবে না৷ আনন্দমার্গ তার মহান আদর্শের মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে বিরাজ করছে শুধু পশ্চিমবঙ্গে বা ভারতবর্ষে নয়, সমগ্র বিশ্বে৷ আর পশ্চিমবঙ্গের শাসক, বীজনসেতুর ঘাতক আজ মৃত্যুশয্যায়৷ তার জীবনদীপ নিভলো বলে৷

আনন্দমার্গ কতকগুলি শব্দের সমষ্টিমাত্র নয়৷ আনন্দমার্গ এক জীবন দর্শন, সম্পূর্ণ এক বৈপ্লবিক ও নতুন জীবনাদর্শ, যা প্রচলিত সমস্ত দর্শন ও আদর্শকে ম্লান করে দিয়ে, অসার করে দিয়ে আপন মহিমায় বিরাজিত৷ মানসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক জীবনের সর্বস্তরের সমন্বয়ে এক বাস্তববাদী জীবনাদর্শ আনন্দমার্গ, যার সঙ্গে এযাবৎ প্রচলিত কোন দর্শনের তুলনা চলে না৷ আনন্দমার্গ তথাকথিত কোন ঠুনকো মতাদর্শ নয়, যা সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করে, বিদ্বেষের বীজ বপন করে৷ সম্পূর্ণ বাস্তবধর্মী ও উদার দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে আনন্দমার্গ এগিয়ে চলেছে সমগ্র মানব সমাজ তথা জীবসমাজকে এক সূত্রে আবদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে৷ আর এই লক্ষ্যকে বাস্তবে রূপ দিতে জীবনের সর্বস্তরের উপযোগী আদর্শ মানুষ গড়ার মহান প্রচেষ্টায় ব্রতী হয়েছে আনন্দমার্গ জীবন সর্বস্বপণ করে৷ তাই কোন নির্যাতন অত্যাচারই আনন্দমার্গের গতিকে স্তব্ধ করতে পারেনি, পারবে না৷ বরং সে আরও দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে তার অভীষ্ট সিদ্ধির পথে৷