সমাজে প্রধান ব্যষ্টি যেমন আচরণ করেন, জনসাধারণ তেমনই অনুকরণ ও অনুসরণ করে৷ মানব সমাজে যে দুর্গতি এসেছে তার কারণ অনেক নয়, মাত্র একটাই৷ আর সেটা সমাজে নেতাদের দুর্নীতি৷
নেতাদের বিচারশীলতা কম হলেও জনসাধারণ তাঁদের চিন্তা-ভাবনাকে চোখ বুঁজে মেনে নেয়৷ তাদের বত্তৃণতা বা অভিনয় লাখ লাখ ব্যষ্টিকে সম্মোহিত করে রাখে৷ তাই কোন দেশে বা সমাজে ৰেশী ক্লেশ ও দারিদ্র্য দেখলে ৰুঝতে হৰে সেই দেশে বা সমাজে নেতার পাপে এমন হয়েছে৷
তাই যে নেতা হৰে তাকে সাবধানতা ও নিয়মৰদ্ধতার সঙ্গে চলতে হৰে৷ তার সবসময় দেখা দরকার যে তার গতি যেন অন্ধকারের দিকে না হয়, মৃত্যুর গহ্বরের দিকে না হয়, কারণ তা হলে তমিস্রা ও মৃত্যুর করালদংষ্ট্রা শুধুমাত্র তাকেই গ্রস্ত করবে না বরং তার অনুগামীদেরও ধবংস করে দেৰে৷ যে কাউকে কিছু শেখাবার দায়িত্ব নিয়েছে, পথ দেখাবার ভার নিয়েছে, তার আচরণ এই রকম হওয়া দরকার যাতে তার নিজের ও অনুগামীদের গতি শ্রেয়মুখী হয়৷ যিনি এই রকম আচরণের দ্বারা সঠিক আচরণ শেখান তাঁকে আচার্য ৰলা হয়৷
সবসময় মনে রাখা দরকার, বৈবহারিক জীবনে কোনো আচার্যের মধ্যে যদি কোন ক্ষুদ্র দুর্বলতারও প্রকাশ হয়ে পড়ে, তাহলে তার থেকে জনসাধারণের ক্ষতি হতে পারে৷ যেমন পিতার কাজ ও কথা সন্তানদের শিক্ষা দেয় তেমনই আচার্য তাঁর কথন ও কাজের দ্বারা শিক্ষা দেবেন৷ প্রত্যেক যুগে লোকে ৰলে থাকে, সমাজ আজ নষ্ট হয়ে গেছে, মানুষের আজ অধোগতি হয়েছে, অতীতে সমাজ ভাল ছিল৷ বৈদিক যুগে, ৰৌদ্ধ যুগে, পৌরাণিক যুগে, পাঠান যুগে, মুঘল যুগে একই রকমের ঘটনা ঘটেছে৷ মানুষ কি মনুষ্যত্ব থেকে নীচে নেমে গেছে? সমাজে কি আর তার সর্বোচ্চ স্থানে নেই?
মানুষের মনে যত রোগ আছে তার সবার কারণ ভূমাদৃষ্টির অভাব৷ সবার কথা চিন্তা না করে শুধুমাত্র নিজের কথা চিন্তা করা, সবাইকে ছেড়ে শুধু নিজের স্বামী, পু, কন্যার চিন্তায় ব্যস্ত থাকা এক ৰড় রোগ৷ তাও এটা মূল রোগ নয়৷ মূল রোগ মানসিক সংকীর্ণতার এক লক্ষণ মাত্র৷ চিকিৎসক জানেন যে কারণে রোগ হয়েছে, ঠিক তার বিপরীত ঔষধের ব্যবস্থা করলে রোগের উপশম হয়৷ তাই সংকীর্ণ মানসিকতা রূপ রোগের নিরাময় করতে হলে তার বিপরীত ব্যবস্থা করতে হৰে৷ তাই পতিত মানুষের কল্যাণের ভাবনা হল ব্রহ্মভাবনা৷
কিন্তু ব্রহ্ম ধ্যেয় হওয়া মাত্রই কেউ ৰ্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না৷ কেউ সঠিক পথে চলছে কিনা সেটা দেখার কাজ আচার্যের৷ বাস্তবে প্রত্যেক ছোট ও ৰড় কাজের ভার আচার্যের ওপরেই থাকে৷ তাই নিজের কাজ সম্পাদনের সময় আচার্যকে বজ্র কঠোর হতে হৰে৷ সে আধ্যাত্মিক অধিকার, যম-নিয়মে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত পাওয়া উচিত নয়, সেই অধিকার অন্যকে দেওয়ার সময় আচার্য কারোর পার্থিব পদমর্যাদা দেখে বিচার করৰে না৷ মনে রাখতে হৰে, Ananda Marga is a man-making Mission৷ সংখ্যার কথা না ভুলেও গুণবত্তার ওপরে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত৷ আনন্দমার্গে আসার সুবিধা সবাইকে দেওয়া উচিত৷ উৎসবে সবাই যোগ দিতে পারৰে৷ কিন্তু যম-নিয়ম অনুসরণকারীই প্রতিষ্ঠিত পদের অধিকারী হৰে৷ অন্যায়ের সঙ্গে সম্বন্ধ রেখে বা কারোর সন্তুষ্টির জন্যে কোন কাজ করা সম্ভব নয়, অন্যায়ের সঙ্গে সমঝোতা করা চলৰে না৷ মালিক আর মজদুরের সংগ্রামে বোঝাপড়া হতে পারে, কিন্তু আনন্দমার্গে পাপের সঙ্গে বোঝাপড়া চলৰে না৷ আনন্দমার্গের সংগ্রাম সত্যের জন্যে৷ তাই পার্থিব ক্ষেত্রে সত্যের পূর্ণ বিজয় না হওয়া পর্যন্ত এই সংগ্রাম ৰন্ধ হতে পারে না৷ যুধ্যমান অবস্থায় অন্যায়ের সঙ্গে বোঝাপড়া করা হলে, হতে পারে সেক্ষেত্রে সত্য আর অসত্যের অংশীদারীত্ব বারো আনা, আর চার আনা, তাহলেও তাকে সত্যের নিরঙ্কুশ জয় বা বিজয় ৰলা যেতে পারে না৷ তোমার লক্ষ্য জয় নয়, বিজয়৷ কুইনাইনের সূচিকা প্রয়োগ করে ম্যালেরিয়া দমন করে দেওয়া তোমার উদ্দেশ্য নয়৷ তাই অসত্যের যতক্ষণ সম্পূর্ণ ধবংস না হচ্ছে ততক্ষণ তোমার সংগ্রাম ৰন্ধ হৰে না৷
যে সমস্ত লোকেরা একসঙ্গে চলার জন্যে প্রস্তুত সেই লোকেদের সমষ্টিগত নাম সমাজ৷ পাপের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে ব্যষ্টিগত জীবনের সীমা থেকে সমষ্টির মধ্যে আনতে হৰে৷ মার্কণ্ডেয় পুরাণের এক গল্প আছে যখন দেবতারা অসুরের সঙ্গে সংগ্রামে ব্যষ্টিগত ভাবে হেরে গিয়েছিল, তখন তারা নিজ নিজ শক্তি দিয়ে, তাদের মিলিত শক্তি দিয়ে মহাশক্তি নির্মাণ করে অসুরকে ধবংস করেছিল৷ গল্পটা খুবই ভাল৷ সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর সার্থক প্রয়োগ সম্ভব৷ আচার্যের কর্তব্য হ’ল এই পরা বা মহাশক্তির সঠিক বিকাশের জন্যে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করে’ অসুরকে সমূলে ধবংস করা৷ জগতে ব্যষ্টি ও সমষ্টি জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই এই দেবাসুরের সংগ্রাম চলছে৷ এই সংগ্রামে মৃত্যুকে আহ্বান জানিয়ে অবতীর্ণ হবার জন্যে জনসাধারণকে প্রেরণা আচার্যই দেবেন৷ আচার্যকে সমসময় মনে রাখতে হৰে, পিতার ঋণ পরিশোধ করা পুরে শুধুমাত্র কর্তব্য নয়, অবশ্যপালনীয় দায়িত্ব৷ ঠিক ওই রকম সমাজকে পরিশোধন করা আচার্যের শুধুমাত্র কর্তব্য নয়, অবশ্য পালনীয় দায়িত্বও বটে৷ এইরকম করতেই হৰে, না হলে ধবংস অনিবার্য৷
এইরকম ভাবে সমাজ পরিচালনার দায়িত্ব যে নেবে তাকে যম-নিয়মে কঠোর রূপে প্রতিষ্ঠিত হতে হৰে৷ সমাজে জনসাধারণের জন্যে যা কিছু বৈকল্পিক ব্যবস্থা দেওয়া হয়েছে, তাকে আচার্য মেনে নেৰে না৷ উদাহরণ আপদান্নের বিষয় নিতে পার৷ শ্রেষ্ঠ আচার্যর জীবন বিপন্ন হলেও আপদান্ন গ্রহণ না করাই উচিত৷
১২ মে, ১৯৮৫, রাঁচি - আচার্যদের উদ্দেশ্যে দেওয়া শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী প্রবচন]