অচেনা শরৎ

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিনহা

প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে শরতের আবির্ভাব অপরূপ সৌন্দর্যে বিধৃত, উৎসবের মাধুর্যে মণ্ডিত৷ সুনীল আকাশে ভেসে চলা খণ্ড খণ্ড মেঘের  ভেলা, মাঝে মধে এক টুকরো কালো মেঘের আনাগোনা, হঠাৎ এক পশলা ঝিরঝিরে বৃষ্টি, মেঘ রোদ্দুরের লুকোচুরি, মাঠেঘাটে রাশি রাশি  কাশফুলের চামরদোলা, গাছের পাতায় ঘাসের গায়ে জমে থাকা শিশির বিন্দুতে সূর্য কিরণের ঝিকিমিকি, বাতাসে শিউলির সুবাস--- শরতের এই মোহময়ী অনন্য পরিবেশের পরশে মানুষের মন হয় আনন্দের স্পন্দনে উদ্বেলিত৷ বাংলা ও বাঙালীর সঙ্গে শরতের রয়েছে সুগভীর সম্পর্ক৷ শরতকালেই অনুষ্ঠিত হয় বাঙালীর সার্বজনীন উৎসব---দুর্র্গেৎসব, জগদ্বাত্রী পূজা, শ্যামা ও দীপাবলী৷ দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি ও পরিশ্রমে গড় তোলা অপূর্ব শিল্পসুষমামণ্ডিত, কারুকার্য খচিত বিশাল বিশাল আলোকমালায় সুশোভিত মণ্ডপগুলিতে চলে দেবী আরাধনার আয়োজন৷ দক্ষ মৃৎশিল্পীর  সুনিপুণ হস্তকর্মে নির্মিত মূর্তিগুলিও শৈল্পিক উৎকর্ষের নিদর্শনরূপে স্বীকৃত৷ মণ্ডপে মণ্ডপে ভক্তিপূর্ণ পরিবেশে নববস্ত্র পরিহিত ছোট বড় সকলের মিলনমেলা৷ এইসময় সকলে দৈনন্দিন জীবনের ক্লান্তি ও গ্লানিকে দূরে সরিয়ে রেখে উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে৷ এছাড়াও দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাহিত্য-সংসৃকতির  ক্ষেত্রেও শারদোৎসবের গুরুত্ব অপরিসীম৷

২০২০ সনের করোনা মহামারী উদ্ভূত পরিস্তিতিতে শারদোৎসবের চিত্র কিছুটা  ভিন্ন ধরণের৷ ২০১৯ সনের শেষদিক থেকে সারা পৃথিবী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে থরহরি কম্পমান৷ ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতিও এর ব্যতিক্রম নয়৷ গত মার্চ মাস থেকে হঠাৎ লকডাউন ঘোষণার পর কলকারখানা, অফিস-আদালত, সুকল কলেজ, দোকান বাজার, বিমান-রেল ও সড়ক পথে সবরকম গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে সাধারণ মানুষ চূড়ান্ত বিভ্রান্তিকর অবস্থার সম্মুখীন হয়৷ মহামারীর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্যে লকডাউনের প্রয়োজন অবশ্যই ছিল, তবে এক্ষেত্রে পরিকল্পনার অভাবও ছিল যথেষ্ট৷ হঠাৎ সব কিছু বন্ধ হয়ে যাবার ফলে সবচেয়ে বেশী অসুবিধায় পড়েছেন নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষজন৷ আচমকা রুজি রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে কলকারখানার শ্রমিক,ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কুটীর শিল্পে নিযুক্ত মানুষজন কর্মহীন হয়ে চরম দুর্বিপাকে পড়েন৷ সেই সঙ্গে  যুক্ত হয় করোনা সংক্রমণের রক্তচক্ষু৷ এমতাবস্থায় লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক পরিবার পরিজন সহ নিজের রাজ্যে, গ্রামে, শহরে ফিরে আসার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন ও এর ফলে মহাসংকটজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়৷ বর্তমানে লকডাউনকে ধাপে ধাপে আনলক করে জনজীবন স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে৷ কিন্তু ইতমধ্যেই দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন ও সর্বস্বান্ত হয়েছেন, দেশের অর্থনীতি মন্দার কোপে পতিত, জিডিপি প্রায় চবিবশ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, বহুবিধ পদক্ষেপ সত্ত্বেও করোনার সংক্রমণ বেড়েই চলেছে৷ সমগ্র বিশ্বে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৬কোটির ওপর, মৃত ১৪ লক্ষ ৯০ হাজার পেরিয়েছে৷ আমাদের দেশেও মোট আক্রান্তদের সংখ্যা এককোটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর মৃত ১.৩৮ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে৷ একদিকে অধিকাংশ মানুষের আর্থিক দুরবস্থা, অন্যদিকে মহামারীর সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা ও বিভিন্ন বিধি-নিষেধের কারণে এইরকম সংকটের সময়ে উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন অতীব দুরূহ ব্যাপার৷ এতদসত্ত্বেও বিভিন্ন উৎসব কমিটির উদ্যোক্তরা সাধ্যমত ছোট করে আয়োজন করেছেন৷ হাইকোর্টের নির্দেশ ও সরকারি  নিয়মকানুন মেনে সাধারণ মানুষের ভিড়ও ছিল অন্যান্য বছরের চেয়ে অনেক কম৷ করোনা অতিমারির সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যে সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা হিসাবে শারীরিক দূরত্ব (অন্তত দুই গজ) বজায় রাখা, মুখাবরণী বা মাস্ক ব্যবহার, বেশি মানুষের জমায়েতে এড়িয়ে চলা, নির্দিষ্ট সময় অন্তর দুই হাত সাবান বা স্যানিটাইজার দিয়ে জীবাণু মুক্ত করা ইত্যাদি নিয়মবিধি পালন্তুন একান্ত জররী৷ চাই বেশিরভাগ সময়েই অধিকাংশ মানুষ ঘরবন্দি থেকেছেন৷ শারদ উৎসবেরই অঙ্গ হিসেবে অনুষ্ঠিত  দীপাবলী, জগদ্ধাত্রী পূজা  ও ছট্ পূজার সময়েও সাধারণ মানুষ ও প্রশাসন অত্যন্ত সচেতনতা ও সতর্কতার পরিচয় দিয়েছেন৷ বিশেষতঃ দীপাবলীতে যে বিপুল পরিমাণে আতসবাজি পোড়ানো হয়,তার বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থগুলি বায়ুবাহিত হয়ে মানুষের তথা অন্যান্য জীবের ক্ষেত্রে ভীষণ ক্ষতিকর৷ করোনার সংক্রমণ মূলত ফুসফুস  ও শ্বাসনালীতে  বেশিমাত্রায় হয়ে থাকে বলে ওই বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থগুলি করোনা আক্রান্ত বা সম্ভাব্য আক্রান্তদের পক্ষে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে ও বহু মানুষের চরম সর্বনাশের কারণ হতে পারে৷ সুতরাং মানুষের হাইকোর্টের নির্দেশে আতসবাজি পোড়ানো নিষিদ্ধ হওয়ায় ও জনগণের সেই নির্দেশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে (কিছু বিক্ষিপ্ত ব্যতিক্রম ছাড়া) আতসবাজিহীন দীপাবলী সহ অন্যান্য উৎসব পালন  অবশ্যই প্রশংসনীয়৷

সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতীয় সংসৃকতি ও জীবনচর্যা ছিল আধ্যাত্মিকতার রসে  সম্পৃক্ত৷ ধর্ম সাধনা ও যোগ সাধনা ভিত্তিক জীবন যাপন ছিল মানুষের মজ্জাগত৷  বহিরঙ্গের দেখনদারির চেয়ে অন্তরের গভীরে ঈশ্বরের উপলদ্ধিই ছিল  মূল প্রতিপাদ্য৷ মানুষে মানুষে ছিল না কোন ভেদাভেদ৷ কিন্তু কালের  ব্যবধানে সময়ের বিবর্তনে কিছু চতুর স্বার্থবাদী মানুষের প্ররোচনায় ও চক্রান্তে  সমাজে জাতিভেদ প্রথার শিকড় প্রোথিত হলো৷ তথাকথিত উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণ্যবাদীরা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে  ও প্রভুত্বের মৌরসী পাট্টা কায়েম রাখতে বিভিন্ন দেবদেবীর  কোপ শাপের  অবতারণা করে সাধারণ মানুষের মনে হীনমন্যতা ও ভীতন্ম্যন্যতার সূচিকাভরণ করে মানসিক, আধ্যাত্মিক ও আর্থিক শোষণ চালিয়ে যেতে লাগলো৷ প্রকৃত আধ্যাত্মিকতার  পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে আচারসর্বস্ব আড়ম্বরপূর্ণ পূজার্চনার প্রচলন করলো৷ অন্তরের পবিত্র মন্দিরের আরাধ্যকে ছেড়ে বাহ্যিক জগতের ধন, শক্তি মান প্রাপ্তির জন্যে লালায়িত হয়ে উঠলো৷ মানুষের মনে বিশ্বাস উৎপাদনের জন্যে রচিত হল বিভিন্ন উপাখ্যান ও পুরাণগাথা৷ ধীরে ধীরে প্রাণের দেবতা অসীম অনন্ত পরমব্রহ্মকে কাঠ, পাথর, ধাতু মাটির মূর্তিতে বেঁধে ফেলে পৌত্তলিকতাভিত্তিক দেবদেবীর পূজা-অর্চনার ব্যবস্থা পাকা করা হলো৷ দুর্গা পূজার কথাই ধরা যাক৷ দূর্র্গপূজার প্রচলন সম্পর্কে পরম শ্রদ্ধেয় মহান দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, নৃতত্ববিদ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের রচনায় আমরা পাই---

‘‘দূর্র্গপূজার বর্ণনা আছে মার্কণ্ডেয় পুরাণে৷ সেটা বৌদ্ধোত্তর যুগে লেখা৷ বৌদ্ধ ধর্ম তত্ত্বতঃ এই দেশ থেকে শেষ হয়েছে দেড় হাজার বছর আগে৷ শঙ্করাচার্যের ভারত ভ্রমণের পরেই শেষ হয়েছে৷ মার্কণ্ডেয় পুরাণও প্রায় এই সময়কার৷ একেই কেন্দ্র করে দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে৷ বাল্মীকী রামায়ণে এর কোন উল্লেখ নেই৷ অনুমিত হয় বাংলা রামায়ণকার কবি কৃত্তিবাস তাঁর রামায়ণে এটা অন্তর্ভুক্ত করেন৷ কৃত্তিবাস ছিলেন বাংলার নবাব হোসেন শাহের সময়কার --- পাঠান যুগে,দুর্র্গপূজার প্রথম প্রচলন হয়েছিল পাঠান যুগে৷ রাজশাহী জেলায় তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণের দ্বারা৷ তিনিই প্রথম পূজা শুরু করেন৷ তিনি ছিলেন জমিদার, রাজা নয়--- তবে খুব বড় রাজ্য ছিল৷ তিনি বললেন, আমি রাজসূয় যজ্ঞ বা অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে চাই৷ পণ্ডিতেরা বললেন, কলিযুগে  অশ্বমেধ চলে না৷ মার্কণ্ডেয় পুরাণে যে দুর্গার কথা আছে তার পূজা করুন৷ তিনি তাই করলেন৷ সাতলক্ষ টাকা খরচ করে পূজা করলেন তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ রায়৷ আসল পদবী ‘সান্ন্যাল’, ‘রায়’ হ’ল জমিদারী উপাধি৷

তাঁর দেখাদেখি পরের বছর যশোহরের রাজা জগদ্বল্লভ রায় পূজা  করলেন সাড়ে আট লাখ টাকা খরচ করে৷ এইভাবে পাঠান যুগে শুরু হয়েছিল দূর্র্গপূজা৷’’

‘‘এটা ছিল জমিদারদের উৎসব৷ পরে ধীরে ধীরে প্রভাব ফেলেছে সমাজের অন্যান্য স্তরে আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে৷ হুগলী জেলার বলাগড় থানায় গুপ্তিপাড়া বলে একটা ছোট শহর আছে৷ সেখানকার কয়েকজন যুবক দেখলে, এতো ধনীদের উৎসব৷ এত খরচ কে করবে! এ তো জমিদার বাবুদের উৎসব৷ তখন সেই বার জন বন্ধু মিলে চাঁদা তুলে একটা পূজা করল৷ তোমরা জান, এককালে রাজভাষা ছিল ফার্সী৷ তারপর এল উর্দু শাহজাহানের সময়৷ উর্দুতে, ফার্সীতে, ‘ইয়ার’ শব্দের অর্থ বন্ধু৷ এই বার জন ইয়ারে মিলে যা করল তা হ’ল বারইয়ারী পূজা৷ বারোয়ারী পূজা সাধারণের স্তরে নেবে এসেছিল৷’’

(পরবর্তী অংশ ১লা জানুয়ারী, ২০২১সংখ্যায়)