তোমাদের কস্তুরী–মৃগনাভি প্রসঙ্গে বলেছিলুম যে, কস্তুরী–মৃগের দেহ–নিঃসৃত হর্মোন নাভিচক্রে জমা হয়ে যতই শক্ত হতে থাকে ততই তার সুগন্ধের মাত্রা বাড়তে থাকে৷ পরে শেষ পর্যন্ত সে যখন অতি মাত্রায় কঠোরতা প্রাপ্ত হয়, সুগন্ধ বাড়ে অত্যন্ত অধিক৷ এই অবস্থায় গন্ধমত্ত হরিণ গন্ধের খোঁজে ছুটতে ছুটতে শেষ পর্যন্ত ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়৷ যেমন বিশেষ বিশেষ অবস্থায় মদমত্ত মাতঙ্গ যদি উন্মাদ হয়ে যায় তখন সেই উন্মাদ অবস্থায় অল্প কিছুক্ষণ থাকার পরে মারা যায়৷ তবে সবাই উন্মাদ হয় না৷ যারা উন্মাদ হয় তারাও বেশী দিন উন্মাদ অবস্থায় বাঁচে না ৷ হাতীদের মধ্যে এই ধরনের মৃত্যু খুব বেশী ঘটে না......তবে ঘটে বৈকি৷ পাগলা হাতী যে কেবল মানুষের পক্ষেই ভয়ঙ্কর তাই নয়, অন্য হাতীর কাছেও ভয়ঙ্কর৷ অন্য হাতীরা তার ভয়ে দূরে তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ সাধারণ অবস্থায় হাতী লোকালয়ে প্রবেশ করে খাদ্যান্বেষণে৷ তাদের অতি প্রিয় খাদ্য হচ্ছে সবুজ ডাল–পালা, পাকা ভুট্টা, পাকা ধান, পাকা গম৷ নিরুপদ্রবে খাদ্য গ্রহণ করতে পারলে তারা কারও ওপর কখনও আক্রমণ করে না৷ গ্রামবাসীরা আগুন জ্বেলে, ক্যানেস্তারা–টিন বাজায় তাদের ভয়ে নয়, ঝামেলা এড়াবার জন্যে সে সবই করে থাকে৷ তোমাদের একবার রাঢ়ের ছড়াটা বলেছিলুম না৷ রাঢ়ে যখন বর্ষা শেষে শরৎ ও হেমন্তে হাতীর আগমন বাড়ে, গ্রামের লোকেরা তখন হাতীর দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে’ বলে ঃ
‘‘গড় করিলাম গণেশ ঠাকুর ধনেপ্রাণে বাঁচাইও
কেলা (কেড়া) দিব, ভুট্টা দিব
দুধি ভাতি খাওয়াই দিব
পাণ সুপারি পৈতা দিব
ধনে প্রাণে বাঁচাইও৷’’
কিন্তু মদমত্ত হাতী যখন ক্ষেপে গেছে খাওয়ার কথা সে তখন ভাবে না, কয়েকদিন অনাহারেই পড়ে থাকে.....নির্জলা অবস্থাতেও থাকে৷ তার মাথার গরম তাকে প্রেষিত করে বিধি ভাঙার দিকে .......সে তখন বিধানকে চ্যালেঞ্জ জানায়৷
তোমরা জান, বিধি ভাঙতে যারা উৎসাহ দেয়, প্ররোচিত করে তাদের পরিণাম ভাল হয় না৷ তাড়াতাড়ি স্বাধীনতা পাবার জন্যে ভারতের এক শ্রেণীর নেতা ইংরেজ যুগে আইন অমান্য আন্দোলন (ন্তুন্লন্প্ত স্তুন্ব্দপ্সত্ব্ন্দ্বস্তুন্ প্পপ্স্লন্দ্বপ্পন্দ্বুব্ধ্ ঃ হিন্দীতে কানুন তোড়না) শুরু করেছিলেন৷ কেউ কেউ বলতেন, এই কানুন ভাঙ্গা তো আমাদের লক্ষ্য নয় ......আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে অন্ধকারের কুহেলিকা ভেদ করে’ সত্যকে পরিস্ফুট করা ..... অন্ধকারের করালকৃষ্ণগ্রাস থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা, এটা আইন অমান্য নয়৷ এটা আমাদের সত্যকে খঁুজে পাবার আগ্রহ........এটা সত্যাগ্রহ৷ কিন্তু গোলাপকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন সে গোলাপই .....ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে.......(আইন অমান্য করার পথটাই হ’ল একটা বিধি ভাঙ্গার ব্যবস্থা......বিধানকে চ্যালেঞ্জ করার মনোবৃত্তি৷ এর ফল ভাল হয় না৷ তারই অনুরণনে আজ একটু বিক্ষোভ...... একটু অসন্তোষ জাগলেই তি লমাত্র চিন্তা না করে’ বেমালুম তারা নিজেদের কর–দত্ত পয়সায় কেনা ট্রাম–বাস পোড়ায়.............সরকারী–বেসরকারী ভবনে অগ্ণি সংযোগ করে’ নিজেরই কষ্টার্জিত সম্পদ ভস্মীভূত করে৷ এসবের আড়ালে লীলাখেলা করে চলেছে সেই ইংরেজ যুগের আইন অমান্য আন্দোলন (ন্তুন্লন্প্ত স্তুন্ব্দপ্সত্ব্ন্দ্বস্তুন্ প্পপ্স্লন্দ্বপ্পন্দ্বুব্ধ্) বা সভ্যভব্য ভাষায় সত্যাগ্রহ৷ না, চুলচেরা বিচারে একে সত্যাগ্রহ বলব না –– বলব দুরাগ্রহ৷ এ সমাজকে ভাঙ্গবার করপেটিকা৷)
বিপ্লবের নামে, বামতন্ত্রের নামে যারা নিরীহ মানুষকে হত্যা করে’ বেড়ায়, যুক্তিজাল বিবর্জিত হয়ে ভ্রান্ত দর্শনের প্রেষণায় মানবতাকে খুইয়ে বসে, তারাও এই ধরনের মনোবৃত্তির দ্বারা সম্প্রেষিত৷
যাই হোক, এত কথা বলা হ’ল পাগলা হাতীর বিধান ভাঙ্গার কথা বলতে গিয়ে৷ প্রকৃতি বিধান ভাঙ্গা পছন্দ করে না৷ বিধি বা বিধান যতক্ষণ আছে ততক্ষণ তা মানতেই হবে৷ যদি তা ক্ষতিকর বলে’ বিবেচিত হয়, যদি তা সমাজের অগ্রগতি ব্যাহত করে, যদি তা প্রতি পদবিক্ষেপে মানুষের চলার পথকে নাগপাশের মত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জাপটে ধরে’ রাখতে চায় তবে সে বিধিকে ভেঙ্গে দিয়ে চূর্ণ করে’ ধূলোয় মিশিয়ে দিয়ে নূতন বিধি তৈরী করে’ সেই বিধিকে মানতে হয়৷ অন্যথা সমাজে মাৎস্যন্যায় দেখা দেবে যা একক বা সামূহিক দু’য়ের পক্ষেই ক্ষতিকর৷ Civil disobedience movement ভারতের সমাজে সেই ক্ষতির ক্ষতই রেখে গেছে৷
(কণিকায় প্রাউট ষোড়শ খণ্ড)