আকাশ তরঙ্গ - এই বঙ্গের রাজ্যপাল

 আমাদের রাজ্যের রাজ্যপালকে নিয়ে প্রায়শই আমরা নানান কথা শুনতে পাই । যা শুনে কারোর খুব ভালো লাগে, কেউ বা ব্যথিত হন। কিন্তু এমন একজন রাজ্যপালের খবর কি কারোর কাছে আছে যার সবটাই ভালো লাগার সোনা দিয়ে মোড়া?

হ্যাঁ আছে ।।

আমি আজ এমনই এক বাঙালি রাজ্যপালের গল্প শোনাতে চাই । 

গল্প বললে ভুল হবে । কারণ গল্পের মত শোনালেও, এঁর সবটাই যে সত্যি ।

বাংলার এই রাজ্যপালের নাম ছিল ডঃ হরেন্দ্রকুমার মুখার্জী। ইংরেজিতে লিখতেন Harendra Coomar Mookerjee.

১৯৫১ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত রাজ্যপাল হিসাবে ইনিই ছিলেন কলকাতার রাজভবনের মালিক ।

ভোরবেলা রাজ্যপাল ডঃ হরেন্দ্রকুমার মুখার্জীর হাঁটতে বেরোনোর অভ্যাস। এক শীতের সকালে রাজভবন থেকে বেরোতে গিয়ে তিনি দেখলেন লিফটম্যান সারা রাত ডিউটি করে লিফটের পাশেই ঘুমিয়ে পড়েছে। এই দৃশ্যটি দেখে তিনি আবার ঘরে ফিরে গেলেন । ঘরে গিয়ে একটা শাল নিয়ে এসে লিফটম্যানের গায়ে জড়িয়ে দিয়ে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে গেলেন এই রাজ্যপাল। পরে লিফটম্যান ঘুমিয়ে পড়ার জন্য, রাজ্যপালের কাছে গিয়ে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে শাল ফেরত দিতে গেলে তিনি সস্নেহে তাকে বলেছিলেন, "ছোট ভাইকে দেওয়া উপহার ফিরিয়ে নিতে নেই।"

এই রাজ্যপাল তখন মাইনে পেতেন ৫০০০ টাকা। ৫০০ টাকা নিজের ও পরিবারের জন্য রেখে, বাকিটা তিনি দুঃস্থদের এবং টিবি রোগীদের চিকিৎসায় দান করে দিতেন। 

   একবার রাজভবনের সব কর্মচারীদের তিনি ডাকলেন এক চায়ের নিমন্ত্রণে । সবাই শঙ্কিত।  কর্মচারীদের মনে এক আশঙ্কা । কারণ তাঁরা সবাই জানত, ডঃ হরেন্দ্রকুমারের একটা 'বদভ্যাস' আছে। এই ধরণের চায়ের পার্টি ডেকে তিনি টাকা তোলেন ; আর পরে সেই টাকা বিলিয়ে দেন সামাজিক উন্নয়নে। এবারও  তিনি কর্মচারীদের কাছে তেমন কোন চাঁদা না চেয়ে বসেন। চা-পর্ব শেষ হলে রাজ্যপাল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। হাত জোড় করে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, "আমি গরীব রাজ্যপাল। আদেশ করতে পারি না। বরং আপনাদের কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। আপনারা জানেন যে আমায় টিবি ফান্ডের খাতাপত্রের হিসেব রাখার জন্য একজন লোক রাখতে হয়েছে এবং তাকে মাইনে দিতে হয় । আপনারা যদি একটু ভাগাভাগি করে হিসেবপত্তরগুলো রাখার দায়িত্ব নেন, তাহলে মাইনের টাকাটা বেঁচে যায়। ওই টাকা দিয়ে বরং রোগীদের কিছু ফলমূল কিনে দিতে পারি।" শুনে তো সবার মাথা হেঁট। ওঁনার স্ত্রী-র নাম ছিল বঙ্গবালা। রাজভবনের কর্মীরা ওঁনাকে 'মা' বলে ডাকতেন। 

রাজভবনের বিলাসব্যসন এই রাজ্যপাল শূন্যে নামিয়ে এনেছিলেন । যারা তখন রাজভবনের অতিথি হয়ে বাইরে থেকে এখানে আসতেন, সেই অতিথিদের কেউ কেউ দিল্লি ফিরে গিয়ে সরাসরি নেহেরুর কাছে নালিশ করতেন -এই রাজ্যপালের কাছ থেকে অতি সাধারণ আতিথেয়তা পেয়ে । রাজভবন ছেড়ে চলে যাবার সময় রাজ্যপালের আতিথেয়তা ফান্ডে আট লক্ষ টাকা জমিয়ে রেখে গেছিলেন ডঃ হরেন্দ্রকুমার মুখার্জী। রাজভবনে অনুমতি ছাড়া সকলের প্রবেশ নিষেধ । সাধারণের তো নয়ই।

কিন্তু অনেকেই দেখছেন, একজন বৃদ্ধ মানুষ, মাঝে মাঝেই এসে সটান ঢুকে যাচ্ছেন একেবারে রাজভবনের ভিতরে । রক্ষীরা কেউ কিছু বলছেও না। কী হল ব্যাপারটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতেই একাংশ চিনতে পারলেন ওই বৃদ্ধ ব্যক্তিটিকে। আরে এ যে শরৎচন্দ্র পণ্ডিত; মানে দাদাঠাকুর! এসেছেন ‘বন্ধু’র সঙ্গে একটু দেখা সাক্ষাৎ করতে। সুতরাং তাঁর প্রবেশ ছিল রাজভবনে অবাধ । অবাক হওয়ার কিছু নেই। ডঃ হরেন্দ্রকুমার মুখার্জী ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত তৃতীয় রাজ্যপাল। আরও ভালো করে বললে, পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র পূর্ণ সময়ের বাঙালি রাজ্যপাল । যিনি ছিলেন সেই বাঙালি!

বাঙালি মানে, যাকে বলে 'ফ্রম্ টপ টু বটম্; আদ্যোপান্ত এক নিপাট সৎ নির্ভীক বাঙালি। আর হবেন নাই বা কেন। এত বিশাল জায়গায় গিয়েও মনটা যে তাঁর মাটির দিকেই পড়ে থাকতো। পড়ে থাকতো মাটির মানুষের কাছে । যেমন স্বভাব, তেমন ব্যক্তিত্ব, তেমনই ছিল তীক্ষ্ণ মেধা। 

অবশ্য স্রেফ রাজ্যপাল হিসেবেই তাঁকে মনে রাখেনি ইতিহাস। মনে রেখেছে আরো অনেক কারণে । পড়াশোনায়ও তিনি ছিলেন তুখোড়। হরেন্দ্রকুমার মুখার্জীই ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজিতে প্রথম ডক্টরেট। পরে সেই বিভাগের তিনি প্রধানও হয়েছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়তেই আরও নানা পদে ছিলেন তিনি।

হরেন্দ্রকুমারের সঙ্গে দাদাঠাকুরের সম্পর্ক ছিল গভীর বন্ধুত্বের, স্নেহের। একে অপরকে শ্রদ্ধাও করতেন। দাদাঠাকুরের ব্যঙ্গ ও রসিকতা তো কিংবদন্তিসম। সেই রস থেকে বঞ্চিত ছিলেন না হরেন্দ্রকুমার । তাঁর কড়া নির্দেশ থাকত, দাদাঠাকুর এলে যেন কেউ তাঁর পথ না আটকান। দাদাঠাকুর একদিন রাজভবনে ঢোকার পরেই রাজ্যপাল  ডঃ হরেন্দ্রকুমার কুশল জিজ্ঞাসা করছেন। আসতে কোনো অসুবিধা হয়েছে কিনা,এই প্রশ্নটাই করতেই দাদাঠাকুর বলে উঠলেন, "কিছু অসুবিধা হয়নি। একজন নরকের সঙ্গী আমাকে এগিয়ে দিয়ে গেছে।” এই কথাটা শুনে রাজ্যপাল হরেন্দ্রকুমার একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। 'বলে কী - নরকের সঙ্গী! সেটা আবার কী?'

হরেন্দ্রকুমার খুবই ইতস্তত ভাবেই জিজ্ঞেস করতেই দাদাঠাকুর বলে উঠলেন, ‘ওই যে, যাঁদের মাথায় হেলমেট থাকে, তারাই তো নরকের সঙ্গী । 'হেল' মানে 'নরক, আর 'মেট' মানে হল 'সঙ্গী’। তাহলে কি দাঁড়ালো বন্ধু -- আমি কিছু ভুল বলেছি। দুই বন্ধু হো হো করে হেসে উঠলেন ।

একদিন কথাবার্তায় হঠাৎ দাদাঠাকুর হরেন্দ্রকুমারকে বলে উঠলেন,‘আপনার নামটা ভুল।’ 

হরেন্দ্রকুমার তো অবাক! বলে উঠলেন 'বলেন কী! এতদিন এই নামটা ব্যবহার করছি, বাপ -ঠাকুরদার দেওয়া নাম ভুল হয় কী করে ?' এই প্রশ্নটিরই যেন অপেক্ষা করছিলেন দাদাঠাকুর। সঙ্গে সঙ্গে জবাব, ‘আপনি যা উপার্জন করেন, তার সবই দান করেন। অথচ আপনার নাম হরেন্দ্র । মানে 'হরণ' । কিন্তু আপনি তো হরণ করেন না!’ মজার কথা হলেও, হরেন্দ্রকুমার মুখার্জীর স্বভাবটাই ছিল সে রকম। একদম সাদাসিধা জীবন। যেটুকু দরকার না হলেই নয়, সেটুকু নিয়েই থাকতে চাইতেন তিনি। যা রোজগার করেন, সবই দান করে দেন। রাজ্যপাল হবার আগেও তিনি এমনটা করেছিলেন। অধ্যাপক থাকাকালীনই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রথমে তিন লাখ টাকা , পরে আরও এক লাখ টাকা দান করেছেন । সেই সময় এই টাকার যে কত বিপুল মূল্য , তা সহজেই অনুমেয় । এছাড়াও যখন তিনি সেখানকার ইন্সপেক্টর, তখনও খ্রিস্টান যুবকরা যাতে ঠিকঠাক শিক্ষা পায়, অসুবিধা না হয়,সেটা দেখতেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডঃ হরেন্দ্রকুমার নিজের বাবা-মা’র নামে একটি ফান্ডও তৈরি করে ছিলেন । প্রথমে দুই লাখ, পরে আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা সেখানে দিয়ে ছিলেন ।

১৯৫৬ সালের আগস্টে মারা যান রাজ্যপাল ডঃ হরেন্দ্রকুমার মুখার্জী । বয়স তখনও ৭০ পেরোয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর আরও এক বাঙালি, ফণীভূষণ চক্রবর্তী রাজ্যপাল হন; কিন্তু সেটা মাত্র তিন মাসের জন্য। পূর্ণ সময় অবধি তাঁর মেয়াদ ছিল না। তারপর আজ পর্যন্ত বাংলা কোনো পূর্ণ সময়ের বাঙালি রাজ্যপালকে পায়নি। ডঃ হরেন্দ্রকুমারই এক এবং একমাত্র। তবে মারা যাওয়ার আগেও, নিজের সারা জীবনের  সঞ্চয় ১৭ লাখ টাকা দিয়ে যান তাঁর সাধের প্রতিষ্ঠান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে। এক প্রকার নিঃস্ব হয়েই তাঁর মৃত্যু হয়  । 

 সবশেষে আর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ না করলে রাজপাল ডঃ হরেন্দ্রকুমার মুখার্জীর জীবনের একটি মহান দিক আমাদের অজানা থেকে যাবে । জানতে পারব না আমাদের দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির সেই ঐতিহাসিক দিনটার কথা । 

প্রথম রাষ্ট্রপতি বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ একবার কলকাতা সফরে আসেন। তখন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ছিলেন  ডঃ হরেন্দ্রকুমার মুখার্জী । রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানানোর জন্য নিয়ম অনুয়াযী দমদম বিমানবন্দরে সেদিন হাজির রাজ্যপাল হরেন্দ্রকুমার মুখার্জি। বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষার পর রাষ্ট্রপতির বিমান দমদমের মাটি ছুঁলো । অবতরণের পর প্রটোকল মেনে রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদের দিকে এগিযে গেলেন রাজ্যপাল হরেন্দ্রকুমার মুখার্জী । দেখা গেল রাজ্যপাল করমর্দনের জন্য রাষ্ট্রপতির দিকে  হাত বাড়িযে দিলেন । কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাষ্ট্রপতি করমর্দনের পরিবর্তে নত হয়ে রাজ্যপালের পা ছুঁযে প্রণাম করলেন। রাজ্যপাল হরেন্দ্রকুমার মুখার্জি আপ্লুত হয়ে তাঁর প্রিয় ছাত্র রাজেন্দ্রপ্রসাদকে বুকে জড়িয়ে  ধরলেন। বিমানবন্দরে  তখন উপস্থিত মন্ত্রী, আধিকারিক, সাংবাদিকরা সেই প্রটোকল ভাঙার দৃশ্য দেখে আবেগ আপ্লুত হয়ে হতচকিত হয়ে যান। দেশের রাষ্ট্রপতি মাথা নত করছেন একটি রাজ্যের রাজ্যপালের পায়ে ! এ দৃশ্য তারা কোনওদিনও দেখেননি। পরে জানা গিয়েছিল হরেন্দ্রকুমার মুখার্জী যখন প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন, তখন বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ ছিলেন তাঁর অন্যতম প্রিয় ছাত্র। তাই গুরু হরেন্দ্রকুমার মুখার্জীকে তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু জানাতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠা করেননি রাষ্ট্রপতি বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ ।।

ভাবলে গর্বে বুক ফলে ওঠে এই ভেবে যে, কলকাতার এই রাজভবনে রাজ্যপাল হিসাবে ডঃ হরেন্দ্রকুমার মুখার্জীর মত একজন মহান, উচ্চ শিক্ষিত, সৎ, মহৎপ্রাণ মানুষের অধিষ্ঠান ঘটেছিল