ধর্ম নয়, কোন একটি ধর্মমত যখন রাজনীতির হাতিয়ার হয়, তখন সেই রাজনীতিতে রাষ্ট্রের কল্যাণ দূরে থাক, সামান্য মানবিকতার স্পর্শও থাকে না৷ ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মর্যাদা রক্ষা হয় না৷ স্বাধীন খণ্ডিত ভারতের জন্মই হয়েছে ধর্মমতাশ্রিত সাম্প্রদায়িক হানাহানির গর্ভে৷ সেই স্বাধীনতা কোটি কোটি মানুষের কাছে অভিশাপ স্বরূপ৷ স্বাধীনতার ৭৭ বছর অতিক্রম করেও ভারত সেই অভিশাপ থেকে মুক্ত হলো না৷ হওয়ার কথাও নয়৷ কারণ ধর্মমতাশ্রিত দুই সম্প্রদায়ের বাইরে আরও দুটি সম্প্রদায় ছিল৷ তারাই স্বাধীন ভারতের দুণ্ড-মুণ্ডের কর্তা---শাসক ও শোষক সম্প্রদায়৷ পরাধীন ভারতে রাজনীতির মঞ্চ থেকে সুভাষচন্দ্রের বেদনাদায়ক বিদায়ের পশ্চাতের ছিল এই সম্প্রদায়ের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র৷ কারণ এদের মতলব সুভাষচন্দ্র বুঝে গিয়েছিলেন৷ এরাও বুঝেছিল এই লোকটিকে রাজনীতি থেকে উচ্ছেদ করতে না পারলে স্বাধীনতার ফলার রসনায় উঠবে না৷ তাই সেদিন কায়েমি স্বার্থবাদীরা নিজেদের রসনাতৃপ্তির স্বার্থেই সুভাষচন্দ্রের মত ব্যষ্টিত্বকে রাজনীতি থেকে নির্মূল করে দিয়েছিল, যাঁর অভাব আজও দেশের মানুষকে কুরে কুরে খাচ্ছে৷ কারণ সুভাষচন্দ্র দেশে থাকলে ভারতবর্ষের মানচিত্র আজকের মত হত না, ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক পরিবেশও এত দুর্দশাগ্রস্ত হতো না৷
যাই হোক, খণ্ডিত স্বাধীনতার ফলারে ভাগ বসাল শাসক ও শোষক সম্প্রদায়, আর অবুঝ জনগণ সাম্প্রদায়িকতায় লিপ্ত থেকে ফলের খোসাটুকু কপালে জুটলো৷ তারপর দীর্ঘ ৭৭ বছরে শাসক পাল্টেছে, কিন্তু শোষক পাল্টায়নে, শোষন বন্ধ হয়নে৷ ৬৫ বছরের শাসনে শোষনে জর্জরিত ভারতবাসীকে বহু আশারবাণী শুনিয়ে, আচ্ছা দিনের স্বপ্ণ দেখিয়ে শাসকের আসনে অধিষ্ঠিত হল প্রত্যক্ষ সাম্প্রদায়িক শক্তি, যারা পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসন ও শোষনের সহায়ক ছিলেন৷ তাদের রাজনীতির হাতিয়ার হলো ধর্মহীন ধর্মমত, যা অন্ধ বিশ্বাস, ভাবজড়তা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, মতলব হাসিলে সিদ্ধ৷ তবু জনগণের ঘুম ভাঙে, চেতনা জাগে, ধীরে হলেও জাগে৷ তাই গত দুবারের একক গরিষ্ঠতা কপালে জুটলো না, শরিকের কাঁধে ভর দিয়ে শাসনে অধিষ্ঠিত মদগর্বী শাসক একক গরিষ্ঠতার অহঙ্কার বিসর্জন দিয়ে৷
এত সাত কাহনের অবতারণা করার উদ্দেশ্য গত ১৮ই মার্চ সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ, মাঠে ময়দানে ধর্মমতের ধবজাধারী নেতাদের গরল কথন৷ ভারতবর্ষ শুধুমাত্র একটি দেশ নয়, যুক্তরাষ্ট্র৷ সেই যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান নানা ভাষাভাষীর নানা সংস্কৃতির নানা ধর্মমতের নাগরিকদের সমান অধিকার দিয়েছে নিজ নিজ ভাষা-কৃষ্টি-সংস্কৃতি ধর্মমত অনুযায়ী জীবন যাপনের৷ সেখানে কোন একটি ধর্মমতকে, কোন একটি ভাষাকে বলপূর্বক সমস্ত দেশবাসীর ঘাড়ে চাপাতে গেলে তা যেমন অসংবিধানিক তেমনি দেশের সংহতির পরিপন্থী৷ এমন উদাহরণ প্রতিবেশী রাষ্ট্রেই আছে৷ কিন্তু ধর্মহীন ধর্মমতের সাম্প্রদায়িক আবেগ না মানে শাসন, না মানে বারণ৷ মাঠে ময়দানের ভাষনে নেতারা যখন প্রতিপক্ষকে ছুড়ে ফেলার হুংকার দেয় তখন ওই নেতাদের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতাতো থাকেই না, বিজ্ঞানের প্রতি গর্জনের সরল হিসাবটাও রাখে না৷ গণতন্ত্রের বেদীতে এরাই হিংসার উৎসবে মেতে ওঠে৷
গত ১৮ই মার্চ প্রধানমন্ত্রীর লোকসভায় ভাষণে প্রয়াগরাজের মহাকুম্ভ (পূর্ণকুম্ভ) কে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ, গান্ধীর ডাণ্ডি অভিযান ও স্বাধীনতার বেদীমূলে ভগৎ সিং-এর বলিদানের ও নেতাজী সুভাষচন্দ্রের দিল্লি চলো ডাকের সঙ্গে তুলনা করা হয়৷ কোন হিসাবে প্রধামমন্ত্রী প্রয়াগরাজের মহাকুম্ভকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলোর সঙ্গে তুলনা করলেন দেশবাসীর কাছে তা স্পষ্ট নয়৷ তবে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে একটা কথা স্পষ্ট হয়েছে ১৯২৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত আর এস এসের ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদানের কোন ঐতিহাসিক মুহূর্ত নেই৷ থাকলে তিনি তা এড়িয়ে যেতেন না৷ নামের বাহার নিয়েও প্রধানমন্ত্রী কোন উচ্চবাচ্য করেননি৷ পূর্ণকুম্ভ কিভাবে মহাকুম্ভে হলো, শাহীস্নান কিভাবে অমৃতস্নান হলো তা নিয়েও তিনি নীরব থেকেছেন৷ প্রধানমন্ত্রীর ভাষনের বেদনাদায়ক ও অমানবিক দিকগুলো হল মহাকুম্ভের মহাবিপর্যয়ের কথা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গেলেন৷ যে মানুষগুলো অন্ধ আবেগে অণুপ্রাণিত হয়ে অমৃত স্নানের মহাপূণ্য লাভের লোভে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর মিছিলে সামিল হলেন তাদের জন্যে সামান্য বেদনা, সামান্য সহানুভূতি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে স্থান পেল না৷ প্রধানমন্ত্রী কি এতটাই অমানবিক, না কি নয়া দিল্লি ষ্টেশনে, ত্রিবেণী সঙ্গমে সরকারী প্রশাসনের অদক্ষতা, অদূরদর্শিতা ও ব্যর্থতা ঢাকতেই মহাকুম্ভের মহা বিপর্যয় নিয়ে নীরব থাকলেন৷ দেশের শাসকদলের এই অসাংবিধানিক অমানবিক আচরণই কি মুখোশের আড়ালের আসল মুখ নয়!
- Log in to post comments