‘আমার বাঙ্গলা’র অর্থনৈতিক অবস্থার অতীত ও বর্তমান -এর কথা উঠলেই একটা ‘দিকদর্পণ’ সামনে আসে--- তা হ’ল,---একটা জাতির, একটা জনগোষ্ঠীর বা একটা দেশের অস্তিত্ব, স্থায়িত্ব, উদ্বর্তন ও ক্রমোনতি নির্ভর করে পঞ্চশক্তি ওপর, যথা অর্থশক্তি, ভাষা-সংস্কৃতির শক্তি, ক্ষাত্র শক্তি, প্রশাসনিক দক্ষতা বা ম্যানেজেণ্ট,---অন্য কথায় নেতৃত্ব, এবং লক্ষ্য পূরণের জন্য অদম্য জিদ বা সুদুঢ আত্মবিশ্বাস৷ অর্থ শক্তি এদের মধ্যমণি৷ তাই হয়তো জীবনবাদী মহাভারতকার বললেন---‘অর্থই অনর্থের মূল’৷ ভাবুক দরবেশ গাইলেন -টাকা টাকা টাকা ভাই, টাকার মত জিনিস নাই,/ টাকা নাই যার মরণ ভাল এ সংসারেতে৷’’---কথার মধ্যে ভাবের আতিশয্য থাকলেও বাস্তবকে অস্বীকার করা যায় না৷ অর্র্থশক্তি মুষ্টিবদ্ধ না হ’লে ক্রয়ক্ষমতা বা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসে না! নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্তি বা সুখ-স্বাচ্ছন্দ ও তার বৃদ্ধি সম্ভব নয়৷ অনেক সমস্যার মূলে ও সমাধানে আছে অর্থশক্তি এ শক্তি সুপ্ত আছে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভৌগোলিক অঞ্চলের মাটির নীচে ও ওপরে৷
বিশ্বের জনগোষ্ঠীগুলো ভূপৃষ্ঠে বসতি স্থান করেছে, এই নিজস্ব অঞ্চলের মাটির ওপরের ও নীচের সম্পদ শক্তির ওপর ভর করেই অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে তুলেছে, আর প্রকৃতি তাদের দিয়েছে এক একটা বিশিষ্ট জীবনধর্ম ও বৈচিত্র্য৷ যুগে যুগে তা স্ব-নির্ভরতাও দিয়েছে৷ কিন্তু নানা কারণে তা মুখ থুবড়ে পড়েছে৷ আধিপত্যবাদ-আগ্রাসন৷ বঞ্চনার সৃষ্ট দারিদ্র্য আজকের বিশ্বের কর্কট ব্যাধি---শোষণের ব্যতিক্রম নয়৷ তাই হারিয়ে যাওয়া স্বয়ম্ভর-অর্থনৈতিক-বুনিয়াদ ফিরে পাওয়া তো চাই-ই৷
ইতিহাস সাক্ষী, স্বরণেও আসে --- সাবেক বাঙলার বা বৃহত্তর বঙ্গের ‘পঞ্চগৌড়’ বা বঙ্গবেসিন বা বঙ্গ মহাভূমি বা মহাসংস্থান আধুনিক অর্থনৈতিকবোধ অনুযায়ী প্রকৃতিগতভাবে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল৷ কী নেই এখানে! মানুষের জীবনধারণের নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্তির নিরাপত্তা-নিশ্চিততা-নানা সুখ-সুবিধার উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি, নানান জাগতিক সখ মেটানো তথা ভোগ- বিলাসের অমেয় উৎস এই বঙ্গবেসিনেই বর্তমান৷ এই উৎস হচ্ছে বৃহত্তর বঙ্গের অর্থাৎ বাঙ্গালীস্থানের অখণ্ড-অর্থনৈতিক পরিসরে অবস্থিত বহুমুখী সম্পদের প্রাচুর্য ‘‘এই সম্পদকে আমরা তিনটি ধরণে আলাদা করে দেখে নিতে পারি, যথা প্রাকৃতিক সম্পদ, মনুষ্যসৃষ্ট সম্পদ ও মানব সম্পদ৷ মানুষের অর্থনৈতিক জীবন তথা দেশের অর্থনীতির উৎস ও স্তম্ভই হচ্ছে এই সম্পদ ৷ প্রাকৃতিক সম্পদ বলতে কৃষিজ, খনিজ, বনজ, জলজ সম্পদকে ধরা হয়, আর শিল্প-বাণিজ্যই মূলতঃ মনুষ্য সৃষ্ট সম্পদ৷
মানব সম্পদের কথা দিয়েই শুরু করা যাক --- আধুনিক অর্থনৈতিক ভাবনায়, উন্নয়নে মানব সম্পদ বা জনংসধ্যা একটা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত৷ জনসংখ্যার পরিমাণ,গুণাগুণ ও ক্রিয়াত্মিকা শক্তির দ্বারা সম্পদ তথা অর্থশক্তির চলমানতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি নির্ধারণ হয়ে থাকে৷ জনসংখ্যাই বাজার সৃষ্টি করে,পুঁজিবাদী কেন্দ্রিত অর্থনীতিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে শ্রমের যোগান বাড়ায় মজুরি না বাড়িয়েও শ্রমের পর্যাপ্ত যোগান পাওয়া যায়৷ এবং কম মূলধন ব্যয় করে বেশী শ্রমিক লাগিয়ে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব৷ আবার এর নেতিবাচক দিকটাও আছে *জনবিস্ফোরণ ঘটলে উন্নয়ন বাধাপ্রাপ্তও হতে পারে৷ বলাবাহুল্য,কেন্দ্রিত (সেণ্ট্রালাইজড অর্থনৈতিক দুনিয়ায় কথাটা আংশিক সত্য হলেও বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক জগতে খাটেনা সম্পদের বিশাল ভূখণ্ডে আত্ম-প্রবঞ্চনা মাত্র, বা কর্ণধারদের অক্ষমতা-অপদার্থ ঢাকার অপকৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়৷ বরং বিকেন্দ্রিত অর্থব্যবস্থায় মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার-তথা হাতে ক্রয়ক্ষমতা থাকার পরিস্থিতে মানুষের পিছনেই কাজ ছুটবে, কাজের অনিশ্চয়তায় কাজের পিছনে মানুষকে হন্যে হয়ে ছুটতে হবে না৷ অবশ্য এ ব্যাপারে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে---দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটলে জনসংখ্যা আপনা থেকেই কমে যায়৷ বিশ্বের সিংহভাগ ধনী দেশ, ধনী পরিবার তার সাক্ষী! বর্তমানে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী! এ বিষয়ে প্রাউট প্রবক্তা একটা কথা বললেন---‘‘বিপুল সংখ্যক নদী-নালা খাল-বিল, সরোবর, অরণ্য, পর্বত, জীবজন্তু সমন্বিত বাঙ্গালা এখনো প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডার---নিজের সম্পদেই স্বাবলম্বনের অনন্য নজীর৷ হিমালয় বঙ্গোপসাগর, বিন্দ্যপর্বত -আরাকান ঘেরা ---এই বিস্তীর্ণ সামগ্রিক ভূখণ্ডেই বাঙালীদের বসবাস৷ স্থানীয় জলবায়ুর প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুযায়ী পোষাক-পরিচ্ছদ, সংসার ও লোকাচার অনুসরণ করে বহু গোষ্ঠীর উদ্ভব হলেও মূলতঃ সকলেই এক বৃহৎ জনগোষ্ঠী---বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত৷ নিজস্ব সম্পদ নির্ভর অর্থনৈতিক অঞ্চলের অধিবাসী হিসেবে কয়েক হাজার বছর আগেই তারা আর্য সভ্যতা-সংস্কৃতি নিরপেক্ষ নিজস্ব সংস্কৃতি এতিহ্য ও জীবনচিন্তা অনুযায়ী এক বিশাল প্রাচীন বাঙালী সভ্যতার গোড়া পতন করেছিলন ৷ স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক ইতিহাস গড়ে উঠেছিল৷
ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় বললেন---‘‘নানা বর্ণ, নানা জাতি এবং নানা শ্রেণীর অগণিত ও অলিখিত জনসমষ্টি লইয়া প্রাচীন বাঙলার ... সমাজ...‘‘এই প্রসঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হ’ল বাঙ্গলার সাধারণ (তথাকথিত নীচুতলার) মানুষই বাঙ্গলার বড় সম্পদ৷ এ বিষয়ে ড.দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের কথাটা প্রণিধানযোগ্য--- ‘‘সমাজের উপরকার স্তরের বহু পরিবর্তন হইয়াছে৷ তাঁহারা নানান দেশের সংস্পর্শে আসিয়া যুগে যুগে রীতি, নীতি, ভাব ও ভাষার অনেকরূপ পরিবর্তন করিয়া লয়৷ এমন কী অনেক সময়ে ভিন্ন দেশাগত বিজয়ী বীরদের অত্যাচারে কখনও কখনও সমাজের উচ্চশ্রেণীর লোকেরা একেবারে বিলুপ্ত হন, নতুবা দেশান্তরী হইয়া আত্মরক্ষা করেন৷ কিন্তু সমাজের নিম্ন শ্রেণীর লোকেরা সেই ঝড়ের উৎপাতে একেবারে নষ্ট হয় না৷ শাল, তমাল ভাঙ্গিয়া প্রভঞ্জন লীলা করেন৷ কিন্তু তিনি শ্যামদুর্বাদলের একটি শিখা ভাঙ্গেন না৷ দেশের প্রাচীনতম আচার নীতি এমন কী শিক্ষা, দীক্ষা, কলাবিদ্যা---এ সমস্তই দেশের নিম্ন শ্রেণীর কুটিরে লুকাইয়া আত্মরক্ষা করিয়া থাকে৷ ‘‘(এদেশে যে হইয়াছে তাহার ভুরি ভুরিই প্রমাণ দিব৷ ) ড. সেনের কথার প্রতিধবনি করে বলা যায় বাঙলার সাধারণ মানুষ তথা নিম্নশ্রেণীর লোকেরাই জাতীয় প্রাচীন সম্পদের অন্তঃপুরের দুর্গসবরূপ*৷ বাঙলার অর্থবল- স্তম্ভ ক্ষাত্র স্মরণি বলের৷ তা আগে যেমন ছিল এখনও আছে, তবে তাঁদেরকে শৈল্পিক যোড়যন্ত্রে গোত্রচ্যুত -কক্ষচ্যুত করা হয়েছে৷ বাঙলার মানব সম্পদের (সাধারণ মানুষের) একটা অনন্য নজীর হচ্ছে ইষ্টনিষ্ঠা (প্রভুভক্তি)৷ ড.সেনের কথায় ‘‘বাঙ্গালীরা যুদ্ধকালে দুর্দান্ত হইলেও প্রভূভক্তিতেও তাহারা অসামান্য৷ বাঙ্গালার রাজাগণই বিদ্রোহী হইয়াছেন, কিন্তু জনসাধারণের প্রভুভক্তিতে তুলনা নাই৷ শ্রীহট্টে নবাব হরেকৃষ্ণ ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে নিহত হইলে সেই শোকে (১৭০৯-১১খৃ) তাহার সেনাপতি রাধানাথ আত্মহত্যা করিয়াছিলেন৷ ‘‘উৎকোচ প্রলোভনে বাঙলার সেনাদের কখনো বশ করা যায়নি৷ *কৃষিজ সম্পদ---প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে কৃষি৷ কৃষিই ছিল প্রাচীন বাঙলার অর্থব্যবস্থার মুলস্তম্ভ---যা আজো বর্তমান৷’’ আমার বাঙ্গলার নদ-নদী বিধৌত সমভূমি বিশ্বের অন্যতম উৎকৃষ্ট-উর্বর সমভূমি ৷ বাঙলার বিস্তীর্ণ চাষযোগ্য জমির উৎপন্ন ফসল হচ্ছে ধান, গম ,যব, মিলেট , ভুট্টা ইত্যাদি খাদ্য শস্য আলু সহ বহুবিধ শাক-সবজি আম, জাম, কাঁঠাল লিচু, পেয়ারা, নারিকেল, আনারস, কুল ইত্যাদি ফলমূল বাদাম, তিসি, তিল, সরষে ইত্যাদি তৈলবীজ পাট, শোন, ম্যাচতা, কার্পাস, রেশম, মুগা ইত্যাদি তন্তুজ ফসল মুগ,কলাই অড়হর, মটর, ছোলা ইত্যাদি নানান ডাল চা, তামাক , ইক্ষু, সিঙ্কোনা, লাক্ষা, এরগু ও বহুবিধ ভেষজ দ্রব্য বাঙলার কৃষিজ সম্পদ৷ তবে অতীতের মত আজো ধানই প্রধান ফসল৷ কৃষিজ দ্রব্যগুলির মধ্যে বহু কৃষিজ দ্রব্যকে ভিত্তি করেই কৃষি ভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠেছে ও উঠতে পারে
এই প্রসঙ্গে আরো * অপরিচিত অপ্রচলিত উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হছে এরণ্ড বীজের মধ্যে কৃত্রিম পেট্রোলিয়মের গুণ বর্তমান কলা একটা ফল এবং থোর-মোচা পুষ্টিকর সবজি -ডাঁটা সহ কলাপাতার ছাই-এ উৎকৃষ্ট ডিটারজেণ্ট গুণ আছে (অতি প্রাচীন কালে তা ব্যবহার হ’ত)- ভোজবাড়ির থালা শিল্পে ব্যবহার ভেস্তি গাছের ছালের আঁশ থেকে উৎকৃষ্ট তন্তু পাওয়া যাবে-বীজ থেকে ভোজ্য তেল হবে, আনারস যেমন ফল তেমনি এর পাতা থেকে তন্তুও পাওয়া যাবে কাঁঠাল ফল ও সবজি দুই-ই-কাঁঠাল কাঠ কাঠ-শিল্পের উপকরণ --তবে পাকা কাঁঠাল থেকে’ সুগার অব মিস্কও এ্যালকহল তৈরি করা যাবে ইত্যাদি৷ *বাঙলার কৃষি ও কৃষিব্যবস্থা বিষয়ে ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার যা বললেন--- রত বাঙলা চিরকালই কৃষি প্রধান দেশ৷ এখনকার ন্যায় তখনও ধান্যই প্রধান শস্য ছিল৷ চাষের প্রণালী ও বর্তমান কালের ন্যায়ই ছিল৷ খুব প্রাচীন কাল হইতেই বাংলাদেশে ইক্ষুর চাষ হইত৷ ইক্ষুর রস হইতে প্রচুর পরিমানে চিনি ও গুড় প্রস্তুত হইত এবং বিদেশে চালান যাইত৷ সর্ষের চাষও এখানে বহুল পরিমাণে হইত ৷ পানের বরজ ও এখানে ছিল৷ বহু ফলবান বৃক্ষের রীতিমত চাষ হইত৷ ইহার মধ্যে নারিকেল, সুপারি, আম , কাঁঠাল, ডালিম, কলা, লেবু, ডুমুর, প্রভৃতি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য---’’ আরো উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে--- বস্ত্রশিল্পে উন্নত প্রাচীন বাঙলার প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত তুলো বাঙওলাতেই উৎপন্ন হ’ত৷’’ রাঢ়ের যে অংশে ভূ-স্তরের ওপর ব্ল্যাক কটন সয়েল বা কৃষ্ণমৃত্তিকা আছে সেখানে প্রাচীন কাল থেকেই---বিশ্বের সেরা কার্পাস উৎপন্ন হ’ত ও বাঁকুড়া জেলার অংশ বিশেষে জন্মাগত এই ভাল জাতের তুলো মুঘল যুগের মাঝামাঝি পর্যন্ত৷ এই তুলো থেকে তৈরী হ’ত ঢাকাই মসলিন, মুর্শিদাবাদী মসলিন, বিষ্ণুপুরী ও সোনামুখী মসলিন৷’ বাঙলার ভূমি ব্যবস্থা বিষয়ে এক ঝলক---যাহারা চাষ করিত বা অন্য প্রকারে জমি ভোগ করিত, তাহাদের কতকগুলি নির্দিষ্ট---কর দিতে হইত৷ রাজা মন্দির প্রভৃতি ধর্মপ্রতিষ্ঠান ও ব্রাহ্মণকে প্রতিপালনের জন্যে জমি দান করিতেন! এই জমির জন্যে কোন কর দিতে হইতনা৷ বংশানমে ইহা চিরকাল ভোগ করিতেন৷’’
- Log in to post comments