অমর ২১শে

লেখক
একর্ষি

২০২৩’র ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২-র’ ভাষা শহীদ দিবস৷  বঙ্গভাষী আমরা৷ সেই ভাষা শহীদদের স্মরণ করি কৃতজ্ঞ-শ্রদ্ধার্ঘ্যচিত্তে, জানাই শত কোটি প্রণাম৷ বাঙালী জীবন ধারায় এ এক দিগ্‌দর্শন (মাইল ষ্টোন)৷ কিন্তু দুর্র্গেৎসব -ঈদ-বড়দিন-পৌষ উৎসবের মত’ ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯শে মে কে উৎসবের ‘ঠিক আছে’ গোছের ‘হালকা মেজাজে’ নামিয়ে আনা হয়েছে৷ পূর্ববঙ্গ ছাড়া বৃহত্তর বঙ্গের সর্বত্র কি বাংলাভাষা  অফিস-আদালত, সরকারী-বেসরকারী কাজে ও বাঙালী জীবন  চর্যায় সর্বত্র আবশ্যিক ও বাধ্যতামূলক হয়েছে কি? রাজশক্তি বাঙালীর ভাষা-অর্থনীতি, ভাষা-রাজনীতি, ভাষা-ক্ষাত্রায়ন ও ভাষা-সংস্কৃতিতে বাস্তবতা-বলিষ্টতা- অপ্রতিহত গতি সঞ্চারবাংলা ভাষায় করেছে কী? একটাই উত্তর,---না তাহলে নির্মম বাস্তবটা হচ্ছে---সালাম, বরকত, জববর কমলাদের দুস্তর অসম্পূর্ণ পথ এখনও পার হওয়া বাকী৷

এখন তো ১৯৫২ সালের ২১শে’র ‘ভাষা-আন্দোলন একটা লেজেণ্ড, একটা মিথ, একটা নষ্টাল্‌জিয়াতে পরিণত হয়েছে৷ তবে ভাষা আন্দোলনের কতগুলো দিগ্‌দর্শ রয়েছে৷ আর রয়েছে মাতৃভাষার চেতনাচপেটাঘাত---যা বাঙলার ও বাঙালী-জীবনের কতগুলো ধূসরপ্রায় নির্মম বাস্তবের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষন করে৷ যথা---

১) ২১শের ভাষা আন্দোলন বিশ্বের দরবারে বাঙালীকে চিনিয়েছে নোতুন করে,মাতৃভাষার গুরুত্বে এসেছে স্বীকৃতি৷ অর্থাৎ ২১শে ফেব্রুয়ারী স্বীকৃতি৷ অর্থাৎ ২১শে ফেব্রুয়ারী স্বীকৃত হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রূপে৷ কিন্তু বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার আন্দোলন--- এইটাই প্রথম ও একমাত্র নয়৷ এর সলতে পাকান শুরু হয়েছে ১৯১২ সাল থেকে ---যা ‘মানভূম ভাষা আন্দোলন’ নামে খ্যাত--- যা এই প্রজন্মের বাঙালীর কাছে অজানা---যা তীব্র আকার ধারণ করে ১৯৪৮ সাল থেকে  ১৯৫৬ সাল অবধি---যার একটা খণ্ডিত পরিণতি ঘটে ১লা নভেম্বর,১৯৫৬ সালে স্বাধীনোত্তর পশ্চিমবঙ্গে মানভূমের খণ্ডিত বন্ধ্যা অংশ পুরুলিয়া জেলারূপে সংযুক্তির মধ্য দিয়ে৷ এরই মাঝে ৫২’র ২১শে ফেব্রুয়ারী৷ এরপরে ১৯৬৯র ১৯শে মে অসমের শিলচরে বাঙালীদের ভাষা আন্দোলন৷ কিন্তু বাংলা  ভাষার অধিকার রক্ষার লড়াই এখন থামেনি৷ পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়িয়ে থাকা সাবেক অখণ্ড বাঙলা থেকে কেটে দেয়া খণ্ড খণ্ড মাতৃভাষা ---বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার লড়াই চলছে৷ পৃথিবীর ইতিহাসে এ এক দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন৷

২) ভাষা আন্দোলন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে কেবল পশ্চিমবঙ্গ বা বাঙলাদেশই বাঙলা নয়৷ ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের ভাবনার অনুকরণে বলি---‘মা (বঙ্গমাতা) যা ছিলেন---রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার বাঙলা’ জীবনানন্দের ‘রূপসী বাঙলা’, নজরুলের ‘বাঙলাদেশ’, অতীতের ‘পঞ্চগৌড়’ আর মা যা হয়েছেন--- খণ্ডে খণ্ডে দ্বাদশ-১) বাঙলাদেশ যা আজ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র, ২) পশ্চিমবঙ্গ যা ভারতের একটা অঙ্গরাজ্য,৩) ত্রিপুরা যা ভারতের একটা অঙ্গরাজ্য,৪)পশ্চিমবঙ্গ সংলগ্ণ ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ১৮টি জেলার মধ্যে ১১টি জেলাই সাবেক বাঙলার অংশ-বাঙালী অধ্যুষিত এলাকা,৫) বিহার রাজ্যে বাঙলার অংশ,৬) ওড়িষ্যা রাজ্যে বাঙলার অংশ,৭) অসমে বাঙলার অংশ যার  সংখ্যা গরিষ্ঠ অধিবাসীর নাম বাঙালী, ৮) স্বতন্ত্র রাষ্ট্র নেপালের পুরো ঝাঁপা জেলাটাই বাঙলার, ৯) স্বতন্ত্র রাষ্ট্র মায়ানমারের আরাকান অঞ্চলটিও আদি বাঙলার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ,১০)মেঘালয় রাজ্যে বাঙলার অংশ, ১১) মণিপুর রাজ্যের এক ভগ্ণাংশও বাঙলার অংশ,১২) মিজোরামে বাঙলার অংশ৷ আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের দাবী ও বাঙলার৷

খণ্ডগুলো জুড়ে পরখ করলেই পৃথিবীর বুকে বাঙলার অবস্থান, ভৌগোলিক পরিচয় চৌহদ্দি ও ক্ষেত্রমান বোঝা যাবে৷ ---ব্রিটিশ ভারতে ১৮৭২ সালে প্রকাশিত মানচিত্র অনুযায়ী---অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ অনুসারে বাঙলার দক্ষিণ সীমা ১৯ ডিগ্রী ১৮ মিনিট অক্ষাংশ থেকে ২৮ ডিগ্রী ১৪মিনিট অক্ষাংশ পর্যন্ত, পূর্বে-পশ্চিমে ৮২ ডিগ্রী পশ্চিম দ্রাঘিমা থেকে ৯০ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমা পর্যন্ত বিস্তৃত৷

মহাদেশীয় অবস্থানে বাঙলার উত্তরে নেপাল, ভুটান ও সিকিম, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও মাদ্রাজ, পূর্বে মায়ানমার ও চীন সীমান্ত অর্থাৎ পূর্বে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা-আরাকানের রাখাইন-মায়ুনদী উপত্যকা, পশ্চিমে শোন নদী, উত্তরে হিমালয়ে, দক্ষিণে চিল্কা হ্রদ---বঙ্গোপসাগর৷ পশ্চিমে তৎকালীন যুক্তপ্রদেশ ও মধ্য প্রদেশ৷

আর ভূতত্ত্বের বিচারে বাঙলা হচ্ছে বিভিন্ন গিরিবেষ্টিত নদী মেখলা অঞ্চল৷ প্রাচীন সংস্কৃতে একে বলে মহাসংস্থান বা মহাভূমি৷ অর্থাৎ বাঙলা হচ্ছে এক বিশেষ ভৌগোলিক বাতাবরণে গড়ে ওঠা স্বাতন্ত্র্য-চিহ্ণিত ও স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টিকারী বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ভূভাগ৷ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মেকং নদীর উপতক্যায় ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বদিকে ভূভাগটাই বাঙালীদের বাসভূমি---যার উত্তরে দুর্ভেদ্য হিমালয়, আরাকান ইয়োমা, আর মধ্যাংশে বহমান গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ও নদীমেখলা, আর দামোদর সহ রাঢ়ের নদীগুলি বাহিত পললভৌম দেশ৷ এজন্য বৈদিকযুগে বাঙলাকে বলা হোত ‘মহাসংস্থান’৷ প্রায় ৫০০০ বছরের অধিক কাল ধরে এই নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলের মধ্যে রাজনৈতিক সীমানার ভাঙাগড়া নিরপেক্ষ বাঙালী জনগোষ্ঠী বসবাস করে আসছে৷

৩) ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালীর জাতিসত্তার (এথ্‌নিসিটি) রক্ষাকবচ৷ বলাবাহুল্য, বাঙালীর জাতিসত্তার উদ্ভব এই মহাসংস্থান বা মহাভূমিকে ঘিরেই৷ বাঙালী একটা মিশ্র বা সঙ্কর জনগোষ্ঠী৷ বাঙালীর জাতিসত্তায় মহাভূমির প্রকৃতিদত্ত মাটি ও তার পরিবেশের সঙ্গে জুড়েছে পৃথিবীর মুখ্য চার ধরণের রেস্‌ বা জাতির---অর্থাৎ আর্য-নিগ্রো-অষ্ট্রিক-মঙ্গোলীয় রক্তের মিশ্রণ, তারও সঙ্গে লগ্ণ হয়ে আছে এতদ অঞ্চলের সামাজিক ঐতিহ্য৷ আবার মিশ্রণের মিশ্রণ ঘটেছে৷ এরই ক্রম পরিণতিতে বাঙালীর জাতিসত্তায় আধৃত প্রধান ছয়টি জাত বাঙালী--- রাজবংশী - মাহাতো - চাকমা - কৈবর্ত্ত-সদগোপ-নমশূদ্র সহ অসংখ্য বাঙালী গোষ্ঠী৷ যেমন---কোচ,মেচ,রাজগুন, কোলিয়া, ত্রিপুরী, কাছাড়ী, বোড়ো, কিরাত, হাজং হালং, দালু,বাগদী, দুলে,শবর, পুলিন্দ, খেড়িয়া, সাঁতাল, হো, সিংমুড়া, চূয়াড়,খাঙার, মুড়া, খেলিয়া মুড়া, লোধা, বেদে-মাহাতো, কুশমেন্ট মুড়া, কুর্মী,কুর্মী মাহাতো, বাউড়ী, মালপাহাড়ী ইত্যাদি৷ এথ্‌নিক্‌ পরিচয়ে সবাই বাঙালী,গঠনতন্ত্রটা ফুল বা চালতে বা পেঁয়াজের সন্নিবিষ্ট দলের মত৷ একই এথ্‌নিক গ্রুপের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও সিংহভাগেরই বাঙালী পরিচয় ছাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, নয়তো কেড়ে নেয়া হয়েছে, ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে৷ ভাষা আন্দোলনই সবাইকে এক ছাতলায় দাঁড় করাতে পারে৷ তাই ২১শে এটাও সেই ফিরে দেখার দিন, আপন ঘরে (বাঙালী জাতিসত্তায়) ফিরে আসার-ফিরিয়ে আনার দিন৷

৪) ২১শে’র ভাষা আন্দোলন কেবলমাত্র ভাষার মর্যাদা বা অধিকার রক্ষার লড়াই-এ সীমাবদ্ধ নয়৷ এ লড়াই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও স্বয়ম্ভরতা অর্জনের লড়াই, সামাজিক ঐতিহ্য রক্ষার  লড়াই৷ কেননা আজকের পৃথিবীতে যে ভয়াবহ শোষণ-বঞ্চনা-নির্যাতন চলছে তার প্রধান ক্ষেত্রটাই হচ্ছে অর্থনৈতিক শোষণ৷ আর অবাধ-নিরঙ্কুশ অর্থনৈতিক শোষণ কায়েম করতে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের প্রধান লক্ষ্যই হয় উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ভাষা-সংস্কৃতি-সামাজিক বন্ধন ধবংস করে দেয়া৷ আর এটা করতে পারলে শোষণের দরজা সহজেই খুলে যায়৷ মুখের ভাষা হারা-ভিন্‌ সংস্কৃতিপিষ্ট-সামাজিক পরিচয় (আত্মপরিচয়-আইডেন্‌টিটি) বিস্মৃত জনগোষ্ঠী উদ্যমহীন, ভবিষ্যতের উজ্জ্বল স্বপ্ণ বিমুখ, আত্মমর্যাদাহীন হয়ে হীনমন্যতার শিকার হয়৷ এই হীনমন্য আত্মমর্যাদাহীন জাতি সহজেই অর্থনৈতিক শোষণের যাতাকলে পিষ্ট হয়৷

৫) পৃথিবীর বহু দেশেই মাতৃভাষার (ন্যাচারল্‌ ল্যাঙ্গুয়েজ্‌) অধিকার রক্ষার লড়াই চলেছে৷ কিন্তু বাঙলার প্রেক্ষাপটটা আলাদা৷ ১৯১২ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত বিষয়টা ভালভাবে খুঁটিয়ে পরখ করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে যেদিন থেকে বাঙলার বুকে ছুরি চালনা শুরু হয়েছে, বাঙলার অঙ্গচ্ছেদ শুরু হয়েছে সেদিন থেকে বাঙালীর মুখ থেকে বাংলা ভাষা কাড়া শুরু হয়েছে, বাংলা ভাষার ওপর একনাগাড়ে অবদমন চলছে৷ আর বাঙালী জনগোষ্ঠীর সামূহিক সর্বনাশও জ্যামিতিক হারে শুরু হয়েছে৷ মাটির পৃথিবী থেকে ভাষার মানচিত্র থেকে বাংলা ভাষাকে, সঙ্গে বাঙালী জাতিসত্তাকেও নিশ্চিহ্ণ করার গভীর ষড়যন্ত্রও চলছে৷ এ বিষয়ে বাঙালী বিদ্বেষী-ঈর্ষাকাতর-প্রতিহিংসা পরায়ণ-বাঙলার অফুরন্ত সম্পদলোভী লুটেরা তথা সাম্রাজ্যবাদীরা নগ্ণস্বার্থ পূরণ করতে বাঙলা ও বাঙালীর বুকে তিনটে ভয়ঙ্কর শক্তিশেল প্রয়োগ করেছে৷ যথা---

এক ঃ বাঙালী একটা মিশ্র বা সঙ্কর জনগোষ্ঠী৷ অনেকগুলো গোষ্ঠী নিয়ে বাঙালী জাতি৷ তালিকা ভুক্ত জাতি-উপজাতি ইত্যাদি নানা বাহানায় সিংহভাগ বাঙালী গোষ্ঠীগুলোকে স্বতন্ত্র জাতিসত্তার তকমা দেয়া হয়েছে৷ ফলে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম বাঙালী জনগোষ্ঠীকে (বাঙালী জনসংখ্যা এখন প্রায় চল্লিশ কোটি) একটা সংখ্যা লঘিষ্ঠ নগন্য জনগোষ্ঠী বলে চালান হচ্ছে৷ এই যুক্তিতে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা সংখ্যা লঘু মানুষের ভাষা বলে অপপ্রচার চলছে৷ বাঙালী জাতিসত্তা থেকে ছিন্ন করা বাঙালী গোষ্ঠীগুলোকে একদিকে স্বতন্ত্র জাতি বলে দেখান হচ্ছে, অন্যদিকে তাদের মুখের ভাষাকেও বাংলা ভাষা থেকে স্বতন্ত্র ভাষা বলে দেখান হচ্ছে৷ কার্যতঃ বঙ্গভঙ্গ বাংলা ভাষার হরেক ভঙ্গ৷

দুই ঃ বাঙলাকে খণ্ড খণ্ড করায় কেবল বাঙালী জনগোষ্ঠীর উদ্বেগজনকভাবে সংখ্যা হ্রাসই হয়নি বাঙলার কিছু উপভাষাকে, খণ্ডভাষাকে (ডাইলেক্ট) সাব্‌ডাইলেক্ট---বাঙলায় ১২টি উপভাষা ও বেশ কয়েকটি খণ্ডভাষা ও দুই উপভাষার ও বাঙলার আর পাশের ভাষার মধ্যবর্তী কথ্য ভাষা আছে) স্বতন্ত্র ভাষা বলে প্রমাণ করার ন্যাক্কারজনক অপচেষ্টা চলছে৷ অথচ পূর্ণাঙ্গ ভাষার বৈশিষ্ট্যে সবগুলোই বাংলা ভাষারই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ৷ এইভাবে চলছে বাংলা ভাষাটাকেই হিমঘরে পাঠানোর গভীর ষড়যন্ত্র৷ ভারতে চলছে হিন্দীবাদের আগ্রাসন,ওপার বাংলায় চলছে বাংলা ভাষার আরব উপদ্বীপীয় করণ৷

তিন ঃ ধর্মেরনামে বাঙলা ভাগে, শাসনকার্যের সুবিধার অজুহাতে ও নবগঠিত প্রদেশের রাজস্ব ঘাটতি খয়রাতির আছিলায় ব্রিটিশের বঙ্গভঙ্গে ও উত্তর সাতচল্লিশে হিন্দীসাম্রাজ্যবাদের ভাষাভিত্তিক রাজ্যঘটনের কারসাজিতে বাঙলাকে টুকরো টুকরো করার মধ্যে একটা ঘৃন্য অভিসন্ধি কাজ  করেছে৷ সমাজ বিজ্ঞানের ও অর্থনীতির ছাত্র মাত্রই ভাঙা সাবেক বাঙলার খণ্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে একটু তলিয়ে পরখ করতে বুঝতে পারবেন যে বাঙলা ভাঙার পিছনে একটা সুদূর প্রসারী অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের দুর্বুদ্ধি কাজ করেছে৷ ব্যাপারটা একটু খোলসা করা যাক৷ ভূ-পৃষ্ঠে পঞ্চগৌড় বা সোনার বাঙলা বা বঙ্গভূমি নামে নির্দিষ্ট অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ বেষ্টিত পরিক্ষেত্র বিশিষ্ট ভৌগোলিক তথা প্রাকৃতিক অঞ্চলটি হাজার হাজার বছর ধরে একটা সমৃদ্ধ স্বয়ম্ভর অর্থনৈতিক বনিয়াদের অঞ্চল হিসাবে পরিচিত---যার তুলনা বিশ্বে কমই আছে৷ যে কোন দেশের অর্থনৈতিক ভিতটা তৈরী হয় সম্পদকে ভর করে৷ আধুনিক অর্থনীতিতে এই সম্পদের উৎস হচ্ছে কৃষি, বনভূমি, খনিজ, সমুদ্র, শিল্প ও এগুলিকে ভিত্তি করে ব্যবসা-বাণিজ্য৷ প্রকৃতির অকৃপণ দানে বাঙলার (সাবেক বাঙলার) ভৌগোলিক অঞ্চলে এই সব ধরণেরই সম্পদই ছিল আছে৷ বঙ্গভঙ্গের ফলে এক একটা ভাগের সঙ্গে চলে গেছে এক একটা সম্পদ৷ বাঙালীর অর্থনীতির মেরুদণ্ডটাই ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে৷ তাই বাঙালীর ভাষা আন্দোলন নিছক ভাষাতেই আটকে নেই৷ এ ভাষা আন্দোলন বাঙলার অর্থনৈতিক মুক্তিরও আন্দোলন৷

চারঃ ভাষা তো সংস্কৃতির বাহন৷ ভাষার ওপর ভর করেই সংস্কৃতি বয়ে চলে যুগ থেকে যুগান্তরে৷ ভাষা ভাবের বাহন৷ আর মানব মনের সব ভাবের সামূহিক অভিপ্রকাশই হচ্ছে সংস্কৃতি৷ কাজেই ২১শে’র ভাষা আন্দোলন বাঙালীকে বাঙলার বুক থেকে অসংস্কৃতির উৎপাটন এবং  বঙ্গসংস্কৃতির  পরিপোষন  সংকর্ষণ-উজ্জীবন-উদ্বর্ত্তনার স্বপ্ণ দেখায়৷ বাঙালীর রাজনৈতিক বন্ধন মুক্তিরও দিশা দেখায় ৷ আবার বাঙালীর গৌরবোজ্জ্বল ক্ষাত্রায়নকে ফিরে দেখতে ও ক্ষাত্র তেজে দীপ্যমান হ’য়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করে৷ কাজেই বাঙলায় ভাষা আন্দোলন একাধারে ভাষা-সংস্কৃতির মুক্তি আন্দোলন, ভাষা ক্ষাত্রায়ন,ভাষা অর্থনীতি, ভাষা-জাতিসত্তা রক্ষার আন্দোলন৷