অনেকদিন পর্যন্ত সমাজ–সেবার কাজে লিপ্ত থাকার পর যখন প্রকৃত মানুষ তৈরী করার কথা ভাবা হ’ল তখন ১৯৫৫ সালের ৯ জানুয়ারী আনন্দমার্গের প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল৷ প্রকৃতপক্ষে এর কিছু পূর্বেই আনন্দমার্গের কাজের সূত্রপাত হয়ে গিয়েছিল কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে যেটা হ’ল ১৯৫৫ সালে৷ কিন্তু প্রথমে ‘আনন্দমার্গ’ নামকরণ হয় নি৷ এর কয়েক মাস পরে ১৯৫৫ সালের শ্রাবণী পূর্ণিমার দিন ‘আনন্দমার্গ’ নামকরণ করা হ’ল৷ ১৯৪০ সালে শ্রাবণী পূর্ণিমার দিনেই এই কলকাতায় আমি প্রথম দীক্ষা দিয়েছিলুম৷ এরপরে অন্য কোন শ্রাবণী পূর্ণিমার দিন আমি কলকাতা বা ৰাঙলায় যাই নি৷
এখন চলছে ১৯৭১ সাল অর্থাৎ ৩১ বছর পরে আবার আজকের দিনে আমি কলকাতায় আছি৷ ৩১ বছর অনেক দীর্ঘ সময়৷ ৩১ বছরের কোন ছেলে অনেক বড়ই তো হয়ে যায়৷ তাই নয় কি? তোমাদের মধ্যে আজ অনেকেই আছো এখনো ৩১ বছর বয়সই হয় নি৷ আনন্দমার্গে অনেক অবধূত–বধূতিকাও আছেন যাঁদের এখনও ৩১ বছর বয়সই হয় নি৷
১৯৫৫ সালে আমরা পরিকল্পনা তৈরী করলুম যে আগামী পনের বৎসরের মধ্যে ভারতবর্ষে সংঘটনকে ভালভাবে গড়ে তোলা হবে৷ পনের বৎসরের অর্থ হ’ল ১৯৭০ পর্যন্ত ও তার পরবর্তীকালে বহির্ভারতে আনন্দমার্গকে ছড়িয়ে দেওয়া হবে৷ কিন্তু ১৯৭০–এর আগেই বহির্ভারতে আমরা সাংঘটনিক কাজ শুরু করে দিয়েছিলুম৷ আমাদের প্রথমে ভাবনা ছিল বহির্ভারতে কয়েকটি জায়গায় আরও পনের বৎসর আমরা কাজ করব আর তারপরেই সমগ্র পৃথিবীতে নিবিড়ভাবে কাজ শুরু হয়ে যাবে৷ এরপরে তোমরা যখন রকেটের ব্যবস্থা করে ফেলবে তখন অন্য গ্রহেও কাজ হবে৷ কী তাই নয় কি? আমি তো এটা কখনই বলিনি যে আমরা অন্য গ্রহে ধর্মমহাচক্র অনুষ্ঠিত করতে যাব না৷ তো এই স্কীম অনুসারে ভাবা হয়েছিল যে ১৯৮৫ সালে সারা পৃথিবীতে আনন্দমার্গ মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে৷ কিন্তু তা আমরা ছয় বছর আগেই করে ফেলেছি অর্থাৎ আমরা ছয় বৎসর এগিয়ে গেছি৷ এই যে যেরূপ ভাবা হয়েছিল আমরা তার থেকেও ছয় বৎসর এগিয়ে যেতে পেরেছি তার মূল কারণ হচ্ছে ‘‘আনন্দ সূত্রম’’–এ বলা হয়েছে–‘‘ৰাধা সা যুষমানাশক্তিঃ সেব্যং স্থাপয়তি লক্ষ্যে’’৷
আমাদের অগ্রসর হওয়ার পথে অনেক ৰাধা এসেছে, প্রবল ৰাধা এসেছে৷ আর সেই ৰাধার সঙ্গে সংগ্রাম করেই আমরা এগিয়ে যেতে পেরেছি৷ আসলে এই কারণেই কিছু কম সময়ে অনেক বেশী কাজ আমরা করে ফেলতে পেরেছি৷
যাই হোক, আমি তো বলব ৰাধা এলে তোমরা ভয় পেয়োনা৷ যত ৰড় ৰাধাই আসুক, সংগ্রাম করতে থাকো আর তাতেই তুমি এগিয়ে যাবে৷ ৰাধা এই জন্যেই আসে যাতে তোমাদের মধ্যে সংগ্রাম করার, লড়াই করার প্রেরণা জেগে যায়৷ ৰাধাবিপত্তিগুলো আসলে কী? আমি পূর্বে অনেকবারই বলেছি যে ৰাধাবিপত্তি হচ্ছে এগিয়ে যাবার পথে প্রস্তরখণ্ড মাত্র৷ পথ চলার সময় রাস্তায় ৰাধা দেবার জন্যে পড়ে থাকে যেসব পাথরের টুকরো, ৰাধা হচ্ছে তাই–ই৷ পদাঘাতে সেসব চূর্ণবিচূর্ণ, দীর্ণবিদীর্ণ করে দাও আর এগিয়ে চলো৷ এতেই চলার শক্তি বেড়ে যাবে৷ এইভাবেই অগ্রসর হতে হয়৷
যার সামনে কখনও ৰাধা আসেনি সে জানতেই পারে না এগিয়ে যাবার রহস্যটা কী৷ কেননা তার জীবনে ৰাধার সম্মুখীন হবার কোন অভিজ্ঞতাই নেই৷ তাই বেশ কিছুটা এগিয়ে যাবার পরে যখন ৰড় ৰাধা সমুপস্থিত হয় তখন সে বিচলিত হয়ে পড়ে৷ কিন্তু ৰাধার মধ্যে দিয়ে যারা এগিয়ে গেছে তারা ছোট ছোট ৰাধার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ৰড় বাধার সঙ্গেও পরিচিত হয়ে যায়৷
এইভাবেই জেগে ওঠে আত্মবল, আত্মশক্তি৷ সেই ব্যষ্টি দুর্দম, অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে৷ তাঁকে কেউ আটকাতে পারে না৷ রবীন্দ্রনাথ ঠিক এই কথাটাই বলেছেন, ‘যে অমর তাকে কোন ব্যঙ্গ–বিদ্রুপের আবরণ ঢেকে রাখতে পারে না৷ যে তপস্যা সত্য তাকে কেউ রোধ করতে পারে না৷ যা সত্য তা শীঘ্রই প্রকাশ হয়ে পড়বে’৷
আমরা যত কম সময়ে যে কাজ করে ফেলবার পরিকল্পনা তৈরী করেছিলুম তার থেকেও কম সময়েই তা সফল করতে পেরেছি৷ এটা আত্মশ্লাঘার জন্যে বলছি না৷ এটাই সত্যের স্বীকৃতি৷ এই জন্যেই বলছি যে তোমরা নিজেদের কর্মশক্তির সঙ্গে সঙ্গে যে অনুপ্রেরণা পেয়েছ, যে ঐশ্বরিক প্রেরণা লাভ করেছ তা জয়যুক্ত হবেই৷
ধর্মেরই জয় হয়৷ ছোট বড় বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তোমরা দেখেছ ৰড় ৰড় শক্তি তোমাদের নির্মূল করার চেষ্টা করেছে কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত কিছুই করতে পারে নি৷ বরং তারা নিজেরাই নিঃশেষ হয়ে গেছে৷ হাতি যখন রাস্তা দিয়ে চলে তখন কুকুরগুলো সেদিকেই তাকিয়ে থাকে৷ তার হিংসা হয়৷ তারা ঘেউ ঘেউ করতে থাকে৷ কিন্তু হাতি দেখেও দেখে না৷ এগিয়েই চলতে থাকে৷ রথ (বা যে–কোন যান) যখন ঘর্ঘর আবাজ করে ৰড় রাস্তায় চলে আসে তখন তার পেছনে পেছনে কুকুর তো ঘেউ ঘেউ করেই কিন্তু রথ তাতে থেমে যায় না৷ বরং রথের অবিরাম ঘর্ঘর ধ্বনিতে কুকুরের আবাজই ঢাকা পড়ে যায়৷
‘‘হাতি চলে ৰাজার মে, কুত্তা ভূখে হাজার৷
সাধুকো দুর্ভাব নহী, জব্ নিন্দে সংসার’’৷
রাস্তার কুকুরের ঘেউ ঘেউ আবাজে রথের চাকা থেমেযায় না৷
শ্রাবণী পূর্ণিমা, ৪ অগষ্ট, ১৯৭৯, কলিকাতা