...বৈবহারিক ক্ষেত্রে কোন জিনিস কতটা সার্থক সেটা বিচার করে মন৷ পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে কোন ব্যবস্থাপত্র কতখানি মানিয়ে চলতে পারে সে বিচারও করে মন৷ খেয়ে পরে শান্তিতে থাকা–এগুলোও করা হয় মানসিক তৃপ্তির জন্যে৷ আর সব চাইতে বড় কথা, যে কোন মতবাদ সম্বন্ধেই বলা হোক না কেন, সমর্থনশাস্ত্র মননশীলতার ওপরই নির্ভরশীল৷ মানসিক ব্যাধি বা আধ্যাত্মিক ব্যাধিমাত্রই মায়াবাদ নয়৷ মাটির পৃথিবীর সঙ্গে, মানুষের মনের সঙ্গে যোগসূত্র রেখেও আধ্যাত্ম দর্শন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে৷ আনন্দমার্গ তেমনি একটা দর্শন৷
অপেক্ষাকৃত বিচারশীল মানুষ যারা তাদের মধ্যে কেউ কেউ কামময় কোষকে রূহ বা আত্মা মনে করে, কেউ বা অতিমানস, বিজ্ঞানময় অথবা হিরণ্ময় কোষকে আত্মা থেকে অভিন্ন বলে মনে করে, কিন্তু প্রকৃত তত্ত্বজ্ঞ আচার্য, যাঁর কাছ থেকে তুমি ব্রহ্মবিদ্যা শিখবে, তিনি তোমাকে ৰুঝিয়ে দেবেন, আত্মা এই কোষগুলোর চাইতে অনেক সূক্ষ্ম৷ প্রতিটি কোষই পরিবর্তনশীল সুতরাং অনিত্য–কেবল আত্মাই নিত্য৷ তাই আধ্যাত্মবিদ্যার আরাধনায় তুমি যে সুখ পাবে, তা নিত্যসুখ–তাই আনন্দ পদবাচ্য৷ আনন্দ অনিত্য বস্তু থেকে পাওয়া যায় না৷ অনিত্য বস্তু আসবে, যাবে, কখনও হাসাবে, কখনও কাঁদাবে৷ অনিত্য জগতে যত প্রিয়বস্তুই পাও না কেন, একদিন সে তোমাকে কাঁদিয়ে কাঙাল করে চলে যাবেই যাবে, কিন্তু সে তোমাকে কাঁদাবে না৷ সে নিত্য, অপরিণামী, অপরিবর্তনশীল সত্তা৷ যম বলেছেন–হে নচিকেতা, তোমার সম্মুখে ব্রহ্মধামের দ্বার উদঘাটিত হয়ে গেছে৷ যে মর্ত্যবস্তু সম্বন্ধে সম্যক্জ্ঞান অর্জন করেছে, সে বিনাশশীল ও বিনাশ রহিত উভয় প্রকার বস্তুরই জ্ঞান অর্জন করেছে৷
মননশীলতার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খণ্ডসুখ থেকে জীব যতই ক্ষৃহৎ সুখের দিকে অর্থাৎ আনন্দের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে ততই সে শরীরগত সুখ ছেড়ে মানসিক সুখের পানে ঝুঁকতে থাকে৷ দেশপ্রেম বা অনুরূপ অনেক সূক্ষ্ম সুখের জন্যে মানুষ দেহ বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাক্ষোধ করে না৷ এগুলো আসলে মানুষের মন–প্রধানতার লক্ষণ৷ কুকুর–বেড়ালের সুখ শরীরগত, মনের সুখ তাদের আধারে প্রধান হয়ে উঠতে পারে না৷ কুকুর বেড়ালকে প্রহার করো ও তারপর কিছু সুখাদ্য–সুপেয় গ্রহণ করবার জন্যে ডাকো, সে ছুটে আসবে, কিন্তু মানুষ সামান্য হতাদর বা মনের ওপর সামান্য আঘাতও সহ্য করতে রাজী নয়৷ অবস্থার চাপে পড়ে যে তোমার দাসত্ব করছে, সর্বদা খোসামোদী করে তোমার মনকে ভিজিয়ে রাখতে চাইছে, সেও মনে মনে তোমার ওপর অত্যন্ত অসন্তুষ্ট৷ সে এই বাধ্যবাধকতার হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্যে সর্বদাই সচেষ্ট হয়ে রয়েছে৷ অবস্থার চাপে ফেলে তুমি মানুষের মন জয় করতে পার না৷
আনন্দমার্গোক্ত অষ্টাঙ্গিক যোগের সাধনায় দেহাত্মক্ষোধযুক্ত সাধক ধীরে ধীরে তার অস্ফুট মননশক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পারে আর সেই উন্নত মনের সাহায্যে শেষ পর্যন্ত আত্মিক স্থিতি লাভ করে৷ এই আত্মিক স্থিতিতে, এই স্বরূপ–স্থিতিতেই সে পায় সত্যিকারের আনন্দ৷ তাই বলি, উপযুক্ত আচার্যের কাছ থেকে ব্রহ্মবিদ্যা শিখে নাও–প্রাকৃত জ্ঞানের সাহায্যে এ জিনিস পাবে না, পুঁথি পড়ে ব্রহ্মজ্ঞান অর্জন করা যায় না, এজন্যে শ্রদ্ধা–ভক্তি নিষ্ঠা নিয়ে আচার্য সমীপে আসতেই হবে, নিষ্ঠাটুকু জাগাবার ইচ্ছা কর, ইচ্ছা করলেই নিষ্ঠা জাগবে৷ আর নিষ্ঠা জাগলে ভগবৎ কৃপা পাবেই পাবে৷
‘‘মহদ্ কৃপয়ৈব ভগবদ্ কৃপালেশাদ্বা৷’’ (নারদ ভক্তিসূত্র)
এই ভগবৎ কৃপার লেশমাত্র পেলে মানুষের স্থূল শরীর থেকে আমিত্ব ক্ষোধ সরে যেতে থাকে, নিত্যানিত্য বিবেক জাগ্রত হয়, আর, এই বিবেকই তাকে ব্রহ্ম স্বরূপত্বে প্রতিষ্ঠিত করে৷ মনে রেখো, সাধনা–মার্গে সব চাইতে বড় কথা নিষ্ঠা৷ নিষ্ঠা থাকলে ভগবৎ কৃপা হবেই হবে–হতেই হবে৷
দেহগত আসক্তি ত্যাগ করা দুরূহ ব্যাপার৷ স্থূলদেহের রক্ষণাবেক্ষণ করা আর তার প্রতি আসক্ত হয়ে থাকা দু’টো ঠিক এক জিনিস নয়৷ কিন্তু যেখানে স্থূলদেহের রক্ষাব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়নি বা হয় না, সেখানেও যদি মানুষ দেহের মোহে বদ্ধ হয়ে থাকে সেটাই আশ্চর্য৷ ভূমিকম্পের সময় মা তার শয্যায় শায়িত শিশুকে ফেলেই ঘরের বাইরে ছুটে যায়৷ তারপর অর্ধপথ গিয়ে তার সন্তানের কথা মনে পড়ে, তখন সে পুনর্বার তাকে রক্ষা করবার জন্যে ভিতরে প্রবেশ করে৷ এই সন্তানের কথাটা যে মায়ের যত শীঘ্র মনে পড়ে যায়, ৰুঝতে হবে, নিজের দেহগত আসক্তি সেই মায়ের ততটা কম৷ আর যে এই আসক্তির ঊর্ধ্বে উঠেছে সে প্রথমেই সন্তানের কথা চিন্তা করবে ও তাকে সঙ্গে নিয়েই ঘরের বাইরে যাবে৷ যথোপযুক্ত সাধনার দ্বারাই মানুষ এই দেহগত আসক্তিকে তথা সর্বপ্রকার আসক্তিকে জয় করতে পারে৷ আনন্দমার্গের অষ্টাঙ্গিক সাধনার দ্বারা যে নিজের সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর রূপকে জাগাতে পেরেছে, তার সব রকমের আসক্তি পাশ ছিন্ন হয়ে যেতে বাধ্য হয়৷