প্রাউট–প্রবক্তার তোমরা (প্রাউটিষ্টরা) যেহেতু সমগ্র বিশ্বের দায়িত্ব নিয়েছ তাই অপুষ্টি সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করাও তোমার পবিত্র কর্ত্তব্যের মধ্যে পড়ে৷ অপুষ্টির মূল কারণ বিশ্বে আর্থিক ব্যবস্থায় ধনসম্পদের অসন্তুলন৷ প্রাউট এর চিরস্থায়ী সমাধান৷ তবে এজন্যে খাদ্যাভাব সমস্যার আশু সমাধান জরুরি ভিত্তিতে করতে হবে৷ তুমি এজন্যে কী করছ?
তোমরা এ ব্যাপারে তোমার গুরুদায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারো না৷ সমগ্র বিশ্ব তোমাদের দিকে কাতর নয়নে তাকিয়ে আছে৷ এটা আমাদের পবিত্র কর্তব্য৷ আমাদের এই দায়িত্ব পালন করতেই হবে৷
পৃথিবী ব্যাপী এই অপুষ্টি তথা সম্পদের অসন্তুলন ও ত্রুটিপূর্ণ বণ্টনের একমাত্র সমাধান হ’ল বহুমুখী উন্নয়ন পরিকল্পনা রূপায়িত করা৷ এই পরিকল্পনা রচিত হবে একটি দেশে দারিদ্র্যের মাত্রা, যথাশীঘ্র মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর লক্ষ্য আর সারা পৃথিবীতে সুসংহত বিকাশ –এ সবের ভিত্তিতে৷ পৃথিবীতে স্থায়ী–স্থায়ী ত্রাণকার্য আর শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়ন এই পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত হবে৷ উদাহরণস্বরূপ–ইউরোপের রোমানিয়া, আলবানিয়া, বলকান অঞ্চলগুলির জন্যে অস্থায়ী ত্রাণকার্যের ওপরে জোর দিতে হবে পোর্তুগালে স্থায়ী ত্রাণ আর গ্রীণল্যান্ডে শিক্ষা এভাবে জোর দিতে হবে৷ স্পেনের বাস্কে অঞ্চল অত্যন্ত গরিব আর গ্রীণল্যান্ডে জনসংখ্যা খুবই কম৷ প্রথমে কাজ শুরু হয়ে যাওয়ার পর যেখানে সবচেয়ে বেশী জরুরি সেখানে অগ্রাধিকার দিতে হবে তারপর তা ছড়িয়ে পড়বে অন্যান্য স্থানে৷
ইতালি উন্নত দেশ কিন্তু তত উন্নত নয়৷ এ উন্নয়নশীল দেশের সীমা অতিক্রম করেছে আর উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ এ দু’য়ের মাঝখানে অবস্থান করছে৷ ইতালি পোর্তুগালের থেকে বেশী উন্নত অথচ এ ব্যাপারে স্পেনের সমান৷ এখানে উদ্যান–চাষ (Horticulture), বনজ সম্পদ, ভূমি সম্পদের অধিকতর উপযোগ এসব বিষয়ে আরো উন্নতির সুযোগ আছে৷ তুঁত রেশমের চাষ বাড়ানো উচিত৷ সিসিলি আর সারদানিয়ার দক্ষিণাংশে তেল পাওয়া যেতে পারে৷ ধানের উৎপাদনে ইতালি বেশি সম্ভাবনাপূর্ণ আর গম উৎপাদনের মাত্রা বাড়ানো উচিত৷ ইতালির দক্ষিণাংশে ভূমধ্যসাগরীয় ফলের উৎপাদন ভাল হয়৷ এ সংক্রান্ত শিল্প ওখানে গড়ে তোলা উচিত৷ ৰৃহৎ শিল্পের মধ্যে শিল্পজাত দ্রব্য বাইরের দেশ থেকে আমদানি করতে হয়৷
সার্বিক জনসেবামূলক পরিকল্পনা
তাহলে কীভাবে শুরু করতে হবে? পৃথিবীতে জটিল সমস্যাগুলোর সুষ্ঠু সমাধানে অন্যান্য প্রয়াসের সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে সব দেশে সার্বিক জনসেবামূলক কাজগুলি রূপায়িত করতে হবে৷ কিন্তু বিশেষ জোর দিতে হবে কম্যুনিষ্ট ও পুঁজিবাদী দেশগুলির সমস্যা সমাধানে৷ কেননা সেসব স্থানে মানুষের শোষণ চলে জাগতিক ও মানসিক এই দুই অভাবের জন্যে৷ এই দেশগুলি বা অন্য দেশের অংশবিশেষ যা এই তালিকার মধ্যে পড়ে সেগুলিকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে চিহ্ণিত করে অবিলম্বে কাজ শুরু করে দিতে হবে, কারণ সেখানে চরম খাদ্যাভাব৷
এই সার্বিক জনসেবামূলক কর্মসূচী বহুমুখী উন্নয়ন পরিকল্পনারই বর্ধিত অংশ বলে বিবেচিত হবে৷ সব গরিব দেশে বিভিন্ন সেবার কাজ হবে দু’ভাবে–ছড়িয়ে–ছিটিয়ে (extensive) আবার নিবিড়ভাবে (intensive)৷ বিস্তারিত ভাবে কাজ মানে সেবা যাতে গ্রামস্তরে পৌঁছায় আর নিবিড়ভাবে কাজ মানে যাতে অধিকতর সংখ্যায় মানুষ উপকৃত হয়৷ পৃথিবীর অনেক প্রান্তে আর্থিক সন্তুলন না থাকার কারণেই এই ধরনের কর্মসূচীর প্রয়োজন আর দলীয় রাজনীতির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই৷
দুর্বিপাক ও দুর্যোগের সময় স্থানীয়ভাবে মানুষের সাহায্যের জন্যে এগিয়ে যেতে হবে৷ অন্য যাঁরা নিঃস্বার্থভাবে সেবা করতে চান তাঁদের কাছ থেকেও সহায়তা নিতে হবে৷ গণ–ন্নসত্র (mass feeding centre), সস্তা ভোজনালয় তো থাকবেই, এর সঙ্গে বস্ত্র–বিতরণ, চিকিৎসা, সেবা ও স্কুলদ্রব্য বিতরণের কাজও থাকবে৷ এছাড়া থাকবে অবস্থা অনুযায়ী দরিদ্র মানুষের জন্যে বিশেষ গৃহ নির্মাণ পরিকল্পনা৷ তুমি যদি কোনো দেশে সেবার কাজে প্রবেশাধিকার না পাও তবে সে দেশের সীমান্ত অঞ্চলে গিয়ে কাজ করবে৷
সার্বিক জনসেবামূলক কাজের সূত্রে আমরা দেখিয়েছি সরকারী কর্ত্তৃপক্ষ কী ধরনের সামাজিক সংস্থা তৈরী করে সাধারণ মানুষের জীবনধারণের মানোন্নয়নের কাজ করে যেতে পারেন৷ এই কর্মসূচী অনুসারে অত্যাবশ্যক ভোগ্য বস্তু দরিদ্রতম ও সবচেয়ে অভাবী লোকেদেরই আগে দিতে হবে৷ কোনো সরকারী কর্ত্তৃপক্ষ যদি এই কর্মসূচীর মূল ভাবধারাকে অনুসরণ করেন–সেটা প্রাউট ব্যবস্থাকেই অনুসরণ করা হবে৷
তাই সমাজের সার্বিক বিকাশের স্বার্থে আমরা কম্যুনিষ্ট দেশ, অনুন্নত গরিব দেশ আর উন্নয়নশীল দেশগুলিকে অগ্রাধিকার দোবো৷ অবশ্য তথাকথিত উন্নত দেশগুলির মানুষকেও অবহেলা করা উচিত নয় কেন না সেখানেও অনেক ক্ষেত্রে খাদ্যাভাব আছে৷ এইভাবে বিস্তারিত ও ব্যাপক কর্মসূচী নিয়ে শুভৰুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ মিলিতভাবে নিপীড়িত মানবতার জন্যে কিছু করতে পারে৷ মনে রেখো পিছনে পড়ে আছে এমন মানুষ আর পিছনের দিকে যাচ্ছে যেসব মানুষ এ দু’য়েরই মানোন্নয়ন আমাদের করতে হবে৷ এইরকম পরিকল্পনা রচনা করে অনতিবিলম্বে তা রূপায়িত করতে হবে৷
মানসিক ক্ষেত্রে রোগ–ত্রুটি–বিকৃতির সবচেয়ে বড় কারণ হ’ল উপযুক্ত শিক্ষার অভাব৷ শিক্ষার অর্থ যথাযথ ৰৌদ্ধিক চর্চা ও অনুশীলন৷ এই শিক্ষার দেওয়ার কাজ প্রাথমিকভাবে করে শিক্ষক সমাজ৷ এর মানে ট্ট–চ্–ড্র, ক–খ–গ এই সব বর্ণমালা বা অক্ষরের সাহায্যে শিক্ষা দেওয়া৷ কিন্তু পদদলিত জনসমূহের এক বিরাট অংশের অক্ষরজ্ঞানই নেই৷ এই জন্যেই শিক্ষার ক্ষেত্রে তারা অনেক পিছিয়ে আছে৷ সব জায়গায় বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলিতে দেখবে জনসংখ্যার এক বড় অংশ অবদমিত৷ এই ধরনের মুসলিম দেশে বা অন্য দেশে হয়ত ধনসম্পদের অভাব নেই, কিন্তু সাধারণ মানুষ কষ্টের মধ্যে থাকে৷
তাই শিক্ষাকে আবশ্যিক ও বাধ্যতামূলক করতে হবে৷ পৃথিবীর সমস্ত গ্রামে এই শিক্ষাকে পৌঁছে দেবার জন্যে তোমাকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে৷ শিক্ষার ব্যাপারে তোমাকে সুস্পষ্ট ও বাস্তবসম্মত নীতি নিয়ে কাজ করতে হবে৷ উপযুক্ত শিক্ষা মানে অবজ্ঞাত মানবতার সত্যিকারের মানোন্নয়ন৷ (বিদেশাগত অনুগামীদের সামনে)