অর্থ ও পরমার্থ

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

শাস্ত্রে বলা  হয়েছে,

‘‘পার্শদ্ধো ভবেজ্জীবঃ পাশমুক্তো ভবেচ্ছিব৷’’

ব্যষ্টিসত্তা যখন মায়াজালে আবদ্ধ থাকে তখন তাকে বলে  জীব বা অণুমন, অর্থাৎ  জীবের বৈশিষ্ট্যই হ’ল ন্ধন৷ ব্রহ্মকৃপায়  সাধনার  দ্বারা  যাঁরা এই  বন্ধন ছিন্ন করে  যখন   নিজেকে  মুক্ত  করতে পারেন  তখন তাঁরা শিবত্বে  উন্নীত  হন৷  শিব হলেন বন্ধনমুক্ত আর জীব বন্ধনযুক্ত৷

ন্ধনের মধ্যে  কেউ  বা থাকতে চায়? কেউ না৷  সব মানুষই  চায় স্বাধীনতা  মুক্তি, সকল রকম বন্ধন থেকে মুক্তি৷  মানুষ সাময়িক ভাবে বিশেষ বিশেষ বন্ধন  থেকে মুক্ত হ’তে  পারে, কিন্তু  কিছুকাল পরে তার সেই বন্ধন দশা আবার ফিরে  আসে৷ সেই অবস্থাটাকে   পাখীর  অবস্থার সঙ্গে   তুলনা   করা যেতে  পারে৷  খাঁচায় আদ্ধ  একটা পাখীকে খাঁচার মধ্যেই  পুরে ফেলা হ’ল৷

অল্পক্ষণের  জন্যে এই যে মুক্তি  এতে জীবের লাভ হ’ল কি?  এই ধরনের সাময়িক ন্ধনমুক্তির উপায়কে বলা হয় অর্থ৷ যেমন ধর, একজনের খুব ক্ষিদে  পেয়েছে৷ ক্ষুধার তাগিদে সে খাদ্য সংগ্রহে  বাধ্য হবে৷ খাদ্য জোগাড় করতে  পারলে  সাময়িকভাবে ক্ষুধার  নিবৃত্তি হবে অর্থাৎ  ক্ষুধার  প্রভাব বা ন্ধন থেকে  সাময়িকভাবে  তার মুক্তি ঘটল৷ এখন এই খাদ্য এল কোথা থেকে? কী করে  ওই ব্যষ্টিটি খাদ্য সংগ্রহ  করল?--- না, টাকার সাহায্যে এই টাকারই অন্য  প্রতিশব্দ  হ’ল অর্থ৷

‘অর্থ’ শব্দটির মানে করলে দু’টি শব্দ পাওয়া যায়--- একটি হ’ল ‘মানে’ ŒMeaningŠ– অন্যটি ‘টাকা’৷ টাকা সাময়িকভাবে  বন্ধন মুক্তি এনে দেয়৷  আজ যে ব্যষ্টি ক্ষুধার্ত সে টাকার সাহায্যে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করল, কিন্তু  আগামীকাল আবার তার ক্ষুধার উদ্রেক হবে, ওই ব্যষ্টির আবার খাদ্যের প্রয়োজন হবে৷ সুতরাং  টাকার সাহায্যে যে মুক্তি তা’ কখনোই  স্থায়ী হতে পারে না৷ তবু এই ক্ষণস্থায়ী জগতে  ক্ষণস্থায়ী বস্তুরই আমাদের প্রয়োজন হয়৷ এই আপেক্ষিক জগতে  আপেক্ষিক  বস্তু  ও সত্তার  পরিবেশেই আমাদের বাস  করতে হয়,  আর সেই  কারণেই  আমাদের জিজ্ঞাস্য, জীবন  সম্পর্কে  আমাদের  দৃষ্টিভঙ্গী কী হওয়া উচিত? আপেক্ষিক  জগতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে  পরমসত্তার  দিকে অগ্রসর হওয়া৷ বহির্বিশ্বকে আমরা অস্বীকার  করতে পারি না৷ অর্থ বা টাকাকেও অস্বীকার করতে পারি না৷ সাময়িক  দুঃখ-যন্ত্রণার  হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্যে অর্থের প্রয়োজন  আছে ঠিকই, কিন্তু  দুঃখ যন্ত্রণার  হাত থেকে  স্থায়ী মুক্তি যার  সাহায্যে সম্ভব হয় তা হ’ল ‘পরমার্থ’৷ ‘অর্থ ও ‘পরমার্থে’র মধ্যে  এটাই  হ’ল তফাৎ৷ মানুষের  যোগ্যতা খুবই  সীমিত৷ এ কথাকে অস্বীকার  করা যায় না৷

মানুষের  ক্লেশ ত্রিবিধ --- (১) আধিভৌতিক, (২) আধিদৈবিক ও (৩) আধ্যাত্মিক৷ আধিভৌতিক দুঃখ হ’ল সেইগুলি যার কারণ  হ’ল বস্তুজগৎ৷ আধিদৈবিক দুঃখ হ’ল সেইগুলি  যার উৎস হ’ল অমূর্ত্ত জগৎ অর্থাৎ মানুষের  মনোরাজ্য৷ এমন দেশও আছে  যেখানে লোকেরা  ভাল খায়-দায়-পরে৷ কিন্তু তারা কি সুখী? --- না, তারা সুখী নয়৷ দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা-রোগ সবই তাদের আছে৷ প্রিয়জনকে হারিয়ে  তারা চোখের  জলে বুক ভাসায়৷ সুতরাং  দুঃখ তাদেরও আছে ৷ এই সব দুঃখ হ’ল আধিদৈবিক৷ এরপর হ’ল আধ্যাত্মিক দুঃখ৷

মানুষের মনের পরিধি খুবই ছোট৷  তাও  আবার সীমিত বিষয় নিয়ে  ব্যাপৃত  থাকে৷ এই সীমিত  অভাবগুলো থেকে মনকে ঊধের্ব ওঠাতে  হবে, সীমিত সুখ  থেকে  মনকে  অসীম  আনন্দময় সত্তায়  উন্নীত করতে হবে৷ সীমিত মানসিক  সম্পদই হ’ল আধ্যাত্মিক ক্লেশের  কারণ৷ সীমার  বন্ধন ছিন্ন হ’লে সেই অবস্থাকে বলা হয় আধ্যাত্মিক মুক্তি৷ আধ্যাত্মিক মুক্তি স্থায়ী হলে তাকে বলব মোক্ষ৷

মানুষের ক্ষমতা সীমিত৷ যে অর্থ মানুষকে ক্লেশ থেকে সাময়িক মুক্তির কাজে সহায়তা করে সেই অর্থও  সংসারে  সীমিত৷ যদি একজনের  হাতে কিয়ৎ পরিমাণ  অর্থ সঞ্চিত  হয় তবে  সমপরিমাণ  অর্থ থেকে অন্যজনকে বঞ্চিত হতে হয়৷ সুতরাং ইচ্ছামত প্রচুর অর্থ কারও হাতে সঞ্চিত হওয়া উচিত নয়৷  যাই হোক, মানুষের  ক্লেশকে দূর করার উপায়  অবশ্যই  খঁুজে বের করতে হবে৷ অন্যান্য ক্লেশের সঙ্গে  এই ক্লেশকে দূর করবার জন্যে আমাকে  এক নোতুন সামাজিক  অর্থনৈতিক  তত্ত্ব আবিষ্কার করতে হয়েছে৷ সেই সামাজিক-অর্থনৈতিক তত্ত্ব হ’ল ‘প্রাউট’৷ প্রাউট ছাড়া এই ক্লেশ দূর করে মানবতাকে রক্ষা করার অন্য কোন  উপায় নেই৷ অন্নহীনকে  পরমার্থের  কথা শুণিয়ে লাভ নেই৷  বাস্তব জগতে বাঁচতে  হ’লে  অর্থের দরকার৷ অস্তিত্ব রক্ষার  মাধ্যম  হ’ল অর্থ৷ আর সেই সঙ্গে দরকার হ’ল পরমার্থ৷      (ক্রমশঃ)