শাস্ত্রে বলা হয়েছে,
‘‘পার্শদ্ধো ভবেজ্জীবঃ পাশমুক্তো ভবেচ্ছিব৷’’
ব্যষ্টিসত্তা যখন মায়াজালে আবদ্ধ থাকে তখন তাকে বলে জীব বা অণুমন, অর্থাৎ জীবের বৈশিষ্ট্যই হ’ল ন্ধন৷ ব্রহ্মকৃপায় সাধনার দ্বারা যাঁরা এই বন্ধন ছিন্ন করে যখন নিজেকে মুক্ত করতে পারেন তখন তাঁরা শিবত্বে উন্নীত হন৷ শিব হলেন বন্ধনমুক্ত আর জীব বন্ধনযুক্ত৷
ন্ধনের মধ্যে কেউ বা থাকতে চায়? কেউ না৷ সব মানুষই চায় স্বাধীনতা মুক্তি, সকল রকম বন্ধন থেকে মুক্তি৷ মানুষ সাময়িক ভাবে বিশেষ বিশেষ বন্ধন থেকে মুক্ত হ’তে পারে, কিন্তু কিছুকাল পরে তার সেই বন্ধন দশা আবার ফিরে আসে৷ সেই অবস্থাটাকে পাখীর অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে৷ খাঁচায় আদ্ধ একটা পাখীকে খাঁচার মধ্যেই পুরে ফেলা হ’ল৷
অল্পক্ষণের জন্যে এই যে মুক্তি এতে জীবের লাভ হ’ল কি? এই ধরনের সাময়িক ন্ধনমুক্তির উপায়কে বলা হয় অর্থ৷ যেমন ধর, একজনের খুব ক্ষিদে পেয়েছে৷ ক্ষুধার তাগিদে সে খাদ্য সংগ্রহে বাধ্য হবে৷ খাদ্য জোগাড় করতে পারলে সাময়িকভাবে ক্ষুধার নিবৃত্তি হবে অর্থাৎ ক্ষুধার প্রভাব বা ন্ধন থেকে সাময়িকভাবে তার মুক্তি ঘটল৷ এখন এই খাদ্য এল কোথা থেকে? কী করে ওই ব্যষ্টিটি খাদ্য সংগ্রহ করল?--- না, টাকার সাহায্যে এই টাকারই অন্য প্রতিশব্দ হ’ল অর্থ৷
‘অর্থ’ শব্দটির মানে করলে দু’টি শব্দ পাওয়া যায়--- একটি হ’ল ‘মানে’ Meaning অন্যটি ‘টাকা’৷ টাকা সাময়িকভাবে বন্ধন মুক্তি এনে দেয়৷ আজ যে ব্যষ্টি ক্ষুধার্ত সে টাকার সাহায্যে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করল, কিন্তু আগামীকাল আবার তার ক্ষুধার উদ্রেক হবে, ওই ব্যষ্টির আবার খাদ্যের প্রয়োজন হবে৷ সুতরাং টাকার সাহায্যে যে মুক্তি তা’ কখনোই স্থায়ী হতে পারে না৷ তবু এই ক্ষণস্থায়ী জগতে ক্ষণস্থায়ী বস্তুরই আমাদের প্রয়োজন হয়৷ এই আপেক্ষিক জগতে আপেক্ষিক বস্তু ও সত্তার পরিবেশেই আমাদের বাস করতে হয়, আর সেই কারণেই আমাদের জিজ্ঞাস্য, জীবন সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী কী হওয়া উচিত? আপেক্ষিক জগতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরমসত্তার দিকে অগ্রসর হওয়া৷ বহির্বিশ্বকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না৷ অর্থ বা টাকাকেও অস্বীকার করতে পারি না৷ সাময়িক দুঃখ-যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্যে অর্থের প্রয়োজন আছে ঠিকই, কিন্তু দুঃখ যন্ত্রণার হাত থেকে স্থায়ী মুক্তি যার সাহায্যে সম্ভব হয় তা হ’ল ‘পরমার্থ’৷ ‘অর্থ ও ‘পরমার্থে’র মধ্যে এটাই হ’ল তফাৎ৷ মানুষের যোগ্যতা খুবই সীমিত৷ এ কথাকে অস্বীকার করা যায় না৷
মানুষের ক্লেশ ত্রিবিধ --- (১) আধিভৌতিক, (২) আধিদৈবিক ও (৩) আধ্যাত্মিক৷ আধিভৌতিক দুঃখ হ’ল সেইগুলি যার কারণ হ’ল বস্তুজগৎ৷ আধিদৈবিক দুঃখ হ’ল সেইগুলি যার উৎস হ’ল অমূর্ত্ত জগৎ অর্থাৎ মানুষের মনোরাজ্য৷ এমন দেশও আছে যেখানে লোকেরা ভাল খায়-দায়-পরে৷ কিন্তু তারা কি সুখী? --- না, তারা সুখী নয়৷ দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা-রোগ সবই তাদের আছে৷ প্রিয়জনকে হারিয়ে তারা চোখের জলে বুক ভাসায়৷ সুতরাং দুঃখ তাদেরও আছে ৷ এই সব দুঃখ হ’ল আধিদৈবিক৷ এরপর হ’ল আধ্যাত্মিক দুঃখ৷
মানুষের মনের পরিধি খুবই ছোট৷ তাও আবার সীমিত বিষয় নিয়ে ব্যাপৃত থাকে৷ এই সীমিত অভাবগুলো থেকে মনকে ঊধের্ব ওঠাতে হবে, সীমিত সুখ থেকে মনকে অসীম আনন্দময় সত্তায় উন্নীত করতে হবে৷ সীমিত মানসিক সম্পদই হ’ল আধ্যাত্মিক ক্লেশের কারণ৷ সীমার বন্ধন ছিন্ন হ’লে সেই অবস্থাকে বলা হয় আধ্যাত্মিক মুক্তি৷ আধ্যাত্মিক মুক্তি স্থায়ী হলে তাকে বলব মোক্ষ৷
মানুষের ক্ষমতা সীমিত৷ যে অর্থ মানুষকে ক্লেশ থেকে সাময়িক মুক্তির কাজে সহায়তা করে সেই অর্থও সংসারে সীমিত৷ যদি একজনের হাতে কিয়ৎ পরিমাণ অর্থ সঞ্চিত হয় তবে সমপরিমাণ অর্থ থেকে অন্যজনকে বঞ্চিত হতে হয়৷ সুতরাং ইচ্ছামত প্রচুর অর্থ কারও হাতে সঞ্চিত হওয়া উচিত নয়৷ যাই হোক, মানুষের ক্লেশকে দূর করার উপায় অবশ্যই খঁুজে বের করতে হবে৷ অন্যান্য ক্লেশের সঙ্গে এই ক্লেশকে দূর করবার জন্যে আমাকে এক নোতুন সামাজিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব আবিষ্কার করতে হয়েছে৷ সেই সামাজিক-অর্থনৈতিক তত্ত্ব হ’ল ‘প্রাউট’৷ প্রাউট ছাড়া এই ক্লেশ দূর করে মানবতাকে রক্ষা করার অন্য কোন উপায় নেই৷ অন্নহীনকে পরমার্থের কথা শুণিয়ে লাভ নেই৷ বাস্তব জগতে বাঁচতে হ’লে অর্থের দরকার৷ অস্তিত্ব রক্ষার মাধ্যম হ’ল অর্থ৷ আর সেই সঙ্গে দরকার হ’ল পরমার্থ৷ (ক্রমশঃ)