পূর্ব প্রকাশিতের পর
পরমার্থ হ’ল সেই তত্ত্ব যা আমাদের ত্রিবিধ দুঃখ-ক্লেশের স্থায়ী নিবৃত্তি সাধন করে৷ স্থায়ী নিবৃত্তি বলতে, যে দুঃখ-যন্ত্রণাগুলোর অবসান হয়েছে, আর ফিরে আসে না সেগুলোকেই বোঝেনো হয়েছে৷ যদি এমন হয়ে থাকে যে ক্ষুধা-ক্লেশের নিবৃত্তি হয়েছে, তারা আর ফিরে আসবে না তবে অর্থকে সেই নিবৃত্তির কারণ হিসাবে পরমার্থ বলব৷ এখানে পরমার্থ কথাটা তোমাদের বোঝানোর জন্যেই বললুম৷ আজ নোতুন এক তত্ত্বের প্রয়োজন যাকে বৈবহারিক ক্ষেত্রে এখনই প্রয়োগ করা দরকার ৷ নোতুন তত্ত্ব কোন সংকীর্ণপরিসর মন থেকে উদ্ভুত হতে পারে না, যিনি উন্নত প্রবুদ্ধ মন নিয়ে বিশ্বসংসারকে নিরীক্ষণ করছেন একমাত্র তিনিই নোতুন তত্ত্বের আবিষ্কর্তা হ’তে পারেন৷ অন্যের পক্ষে সম্ভব নয়৷ পরমার্থ হ’ল এক তত্ত্ব, এই পরমার্থ সম্পর্কেও এ কথা বলা চলে৷
একদিকে আছে মানুষের দোষ-ত্রুটি , অপূর্ণতা যার দরুণ সে নানাবিধ কষ্ট পাচ্ছে, অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে কাজ করছে শক্তিস্বরূপিনী মায়া৷ এই মায়া হলেন প্রচণ্ড শক্তিময়ী৷ প্রতিনিয়তই মানুষকে বহুমুখী প্রবৃত্তি ও স্বার্থপরতার অধীনে এনে মায়া তাঁর উদ্দেশ্যে চরিতার্থ করতে চাইছেন৷ যতদিন মানুষ অসহায়ভাবে বিশ্বমায়ার প্রভাবাধীন থাকে ততদিনই তার ওপর বিশ্বমায়ার জারিজুরি চলতে থাকে৷ আর যখন দেখেন তাঁর ন্ধন শিথিল হয়ে যাচ্ছে তখনই তাঁর বিভিন্ন শক্তির সাহায্যে তিনি সেই মানুষকে বিপথগামী করতে সচেষ্ট হয়ে ওঠেন যাতে সে তাঁর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে৷ এই দাসত্বের পরিবেশে মানুষ কখনও পরমার্থ লাভ করতে পারে না৷ স্বামী অথবা স্ত্রীর কাছ থেকে বাধা আসে৷ কোন কোন ক্ষেত্রে পিতা-মাতা, এমনকি সমাজের কাছ থেকে বাধা আসে৷ এইভাবে বিভিন্ন দিক থেকে বাধা আসতে থাকে৷ এই সব বাধাকে অতিক্রম করতে হবে৷ একন বিশ্বমায়া যদি অত্যন্ত ক্রদ্ধ ও ক্ষমতাশালিনী হয়ে ওঠেন তাহলে মানুষের পক্ষে করণীয় কী? মানুষের পক্ষে তার জন্যে দুশ্চিন্তার কারণ নেই, কারণ পরমপুরুষের আশীর্বাদ তার জন্যে আছে৷ দু’টি শ্লোক আছে---
‘‘দৈবী হেষ্যা গুণময়ী মম মায়া দূরত্যয়া৷
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে৷৷’’
‘‘ত্বং বৈষ্ণবী শক্তিরনন্তবীর্র্য্য বিশ্বস্য বীজং পরমাইসি মায়া৷
সম্মোহিতং দেবি সমস্তমেতদ্ ত্বং বৈ প্রসন্না ভুবি মুক্তিহেতুঃ৷৷’’
‘‘এই অসীম ক্ষমতাশালিনী মায়াা হ’ল ঐশী শক্তি৷ তবে এই শক্তি ও ক্ষমতা সবই আমার ৷ এখন যে ব্যষ্টি আমাতেই আশ্রয় করেছে, মায়া তার কোন ক্ষতি করতে পারে না কারণ মায়া তো আমারই অংশ’’৷ পরমপুরুষ হলেন মায়া শক্তির নিয়ন্ত্রক৷ সুতরাং যে ব্যষ্টি পরমপুরুষকে আশ্রয় করতে পেরেছে মায়া তার কিছুই করতে পারে না--- যতই তার শক্তি থাক না কেন৷ মানুষ কেবল সেই অবস্থাতেই মায়াকে প্রতিহত করতে পারে৷ সত্যি কথা বলতে কি, মায়াশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রয়োজন যে সর্বক্ষেত্রেই আছে তা নয়৷ অনেক মায়া নিজেই পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করেন৷
সুতরাং দ্ধিমান মানুষের কী করণীয়? গতদিন আমি বলেছিলুম, মানুষ মাত্রেরই --- পুরুষ অথবা স্ত্রী যেই হোক-না-কেন তাকে অহমিকা ত্যাগ করতে হবে৷ মানুষ শুধু ভাববে--- আমি শিশু, পরমপুরুষের কোলে বসে আছি ৷ মায়া আমার কী করতে পারে ? সত্যিই, মায়া তার কিছু করতে পারে না৷ দ্বিতীয় আরেকটা জিনিস সেই সঙ্গে মনে রাখা দরকার যেটা এর আগেও বলেছি ৷ অনেকে ভাবে--- আমি পাপী, আমি অন্যায় করেছি ইত্যাদি ইত্যাদি৷ এটাও ঠিক নয়৷ মানুষ যা চিন্তা করে সে তা-ই হয়৷ তাই যে মানুষ সর্বদাই চিন্তা করছে --- আমি পাপী, আমি পাপী, সে শেষ পর্যন্ত পাপীই হয়ে যায়, যদিও সে প্রকৃত পাপী নয় তবুও৷ সুতরাং ওই ধরনের চিন্তা করে লাভ কী? ওটা হ’ল বিকৃত চিন্তা৷
‘‘যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী৷’’
দস্যু, তস্কর ও দুষৃকতকারীদের মধ্যে বিভিন্ন স্তর আছে৷ যেমন একজন পকেটমার আর একজন সিঁধেল চোর৷ এদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব সমাজ ও বিশেষ ধরনের সামাজিক মান-মর্র্যদা আছে৷ যেমন, একজন পাকা চোর একজন পকেটমাারকে তেমন আমল দেবে না৷ সেইরকম পাপীদেরও বিভিন্ন স্তর আছে৷ পাপীরাও যে লোককে পাপী বলে উল্লেখ করে, দুষ্কৃতীরা যাকে তাদের চেয়ে ও অধিকতর দুষৃকতকারী মনে করে , সেই লোক হ’ল ওই সব পাপীদেরও চেয়েও পাপী৷ এই ধরনের পাপী যাকে অন্য পাপীরাও ঘৃণা করে, সেও যদি পরমপুরুষের কথা একাগ্রচিত্তে স্মরণ করে, যদি সে আমাতে আশ্রয় করে, ভাবে যে সে আমার কোলে বসে আছে আর বলে, ‘‘হে ঈশ্বর, আমি তোমার সন্তান, আমাকে রক্ষা কর’’, সেই পাপীকেও আমি সর্বপাপ থেকে উদ্ধার করব৷ এ ব্যাপারে কারোর মাথাব্যথার কোন কারণ নেই৷ এই ধরনের মানুষ --- তার অতীত জীীবন যতই অন্ধকারাচ্ছন্ন হোাক-না-কেন---যদি পরমপুরুষের আশ্রয়প্রার্থী হয় তবে অবশ্যই সে পাপমুক্ত হবে৷ এ বিষয়ে সংশয়ের কোন অবকাশ নেই৷
‘‘আমি পাপী, আমি পাপী’’ এই ধরনের চিন্তা তোমরা কখনই করবে না৷ এ ধরনের চিন্তাকে তোমরা কখনই প্রশ্রয় দেবে না ৷ এই প্রসঙ্গে তোমরা মদালসার গল্পটাও মনে রাখবে৷ (৪ নবেম্বর ১৯৭৮, কলিকাতা, সকালবেলা)