আর্থিক মুক্তির পথ অর্থনৈতিক গণতন্ত্র

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

লাগাম ছাড়া মূল্যবৃদ্ধি, বিশেষ করে খাদ্যপণ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ৷ মধ্যবিত্ত নিম্ন-মধ্যবিত্তের অবস্থা শোচনীয়৷ এদিকে জিডিপি জিডিপি (গ্রস ডোমেস্টিক প্রডাক্ট) করে উন্নয়নের ঢাক পেটাচ্ছেন নেতামন্ত্রীরা৷ কিন্তু জিডিপির সঙ্গে আমজনতার সম্পর্ক কতটুকু৷ জিডিপি কমা, বাড়ার সঙ্গে দেশের সার্বিক বিকাশ নির্ভর করে কি? পুঁজিবাদী দুনিয়ায় যেখানে সম্পদের সিংহভাগ দখল করে বসে থাকে মুষ্টিমেয় কয়েকজন সেখানে জিডিপি দেখিয়ে উন্নয়নের দাবী চরম মিথ্যাচারিতা৷

সাধারণ দেশবাসী জিডিপি বৃদ্ধির ঠিক মানেও বোঝেন না, শুধু এইটুকু বোঝানো হচ্ছে, দেশের অত্যন্ত দ্রুত উন্নয়ন হচ্ছে৷ জিডিপি বৃদ্ধি মানেই তো দেশের সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধি৷ দেশের কলকারখানা বাড়ছে, কৃষিজ সম্পদ বাড়ছে, খনিজ সম্পদ বাড়ছে, পরিষেবা বাড়ছে, দেশে আয় বাড়ছে৷ কিন্তু এতে কি সত্যি বোঝা যাচ্ছে, কাদের আয় বাড়ছে৷ জিডিপির উন্নতির সঙ্গে তাল রেখে দেশের দরিদ্র শ্রেণীর ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে কি? তাদের স্বাচ্ছন্দ বাড়ছে কি? তাদের ও তাদের ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নতি হচ্ছে কি?

অর্থাৎ দেশের উন্নতি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ধনীদের উন্নতি হচ্ছে, তাদের সম্পদ হু-হু করে বাড়ছে৷ তাতে গরীবের দুঃখ মোচন হচ্ছে কি?

বিভিন্ন আর্থিক সংস্থার সমীক্ষার প্রতিবেদনে আর্থিক উন্নতির যে চিত্র দেখা যাচ্ছে তার সঙ্গে নেতা মন্ত্রীদের দাবীর কোন সামঞ্জস্য নেই৷ দেশের ৭০ শতাংশের বেশী সম্পদ দখল করে আছে এক শতাংশ মানুষ৷ ওই এক শতাংশ মানুষের উন্নয়নকে হাতিয়ার করে সকার উন্নয়নের ঢাক পেটাচ্ছে৷

আসলে বর্তমান দেশের অর্থনীতি পুঁজিবাদী অর্থনীতি৷ বছরের পর বছর পুঁজিপতিদের সম্পদ ফুলে ফেঁপে ঢাক হচ্ছে৷ সাধারণ গরীবদের দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যা বেড়েই চলেছে৷ শুধু ভারতের কেন আমেরিকা, ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড-এর মত অর্থোন্নত দেশগুলিতেও প্রচণ্ড বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ মাঝে মাঝে বিক্ষোভ দেখা দেয়, কিন্তু জোর করে সেই বিক্ষোভকে দমন করা হয়৷

প্রাউট-প্রবক্তা পরম শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন, যতদিন না অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়, ততদিন দেশের প্রকৃত সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়৷ জিডিপি বা মাথা পিছু গড় আয় বৃদ্ধি এগুলো অর্থনীতির উন্নতির লক্ষণ নয়, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এতে ধনীদেরই সম্পদ বৃদ্ধি হয়, ধনীদের হাতে দেশের সম্পদের কেন্দ্রীকরণ হচ্ছে৷ তাতে ধনীদের হাতে শুধু দেশের অর্থনৈতিক চাবিকাঠিই নয়, রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক --- সমস্ত চাবিকাঠিই কুক্ষিগত হচ্ছে৷ তারা তো প্রধানতঃ মুনাফাটাই বোঝে৷ মুনাফার জোরেই তারা ধনী৷ তাই অর্থশক্তি দিয়ে তারা সারা দেশকে নিজেদের কুক্ষিগত করে৷ দেশের বৈশ্যশোষণ চরম হতে থাকে৷

আজ আমরা কথায় কথায় ‘গণতন্ত্র গণতন্ত্র’ বলে শ্লোগান তুলছি৷ গণতন্ত্রের জয়গান গাইছি৷ কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি, এই গণতন্ত্র বর্তমানে পুঁজিপতিদের হাতের পুতুল৷ ধনীরা টাকার জোরে গণতন্ত্রকে হাটে বাজারে বিক্রি করতে পারে৷ যেমন বস্তা বস্তা টাকা সহজে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়৷ কালোকে শাদা আর শাদাকে কালো করে দেয়৷

তাই অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্থহীন৷ অর্থনৈতিক গণতন্ত্র মানে দেশের প্রতিটি মানুষের নূ্যনতম চাহিদা পূরণের গ্যারান্টি৷ প্রতিটি মানুষের হাতে যুগোপযোগী ক্রয় ক্ষমতা দিতে হবে৷ আর স্থানীয় অর্থনৈতিক শক্তির নিয়মক হবে স্থানীয় মানুষেরা৷

জগতের সম্পদ সীমিত৷ প্রকৃতিদত্ত সম্পদে সমাজের সমস্ত মানুষেরই অধিকার আছে৷ তাই, কারুর জিম্বায় বিপ ল সম্পত্তি থাকবে , আর অঢেল বিলাসিতায় জীবন অতিবাহিত করবে, সম্পদের অপচয় করবে, আর অন্যদিকে না খেয়ে অভাবের তাড়নায় মানুষ শুকিয়ে মরবে, এ ব্যবস্থা কখনই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না৷

তাই এই সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চাই৷ আর সেই কারণেই প্রাউট প্রবক্তা দিয়েছেন, অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের আদর্শ৷ এই অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের আদর্শ ছাড়া সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়৷