আজ প্রশ্ণোত্তরের মাধ্যমে কিছু আলোচনা করব৷ অনেক সময় এমনি আলোচনার পরিবর্তে প্রশ্ণোত্তরের মাধ্যমে আলোচনা ভাল হয়৷
সংসৃক্তে একটা সূক্ত আছে৷ ঋক্বেদের শ্লোকগুলোকে শ্লোক না বলে বলা হয় ‘সূক্ত’৷ ‘সু’+ ‘উক্ত’= সূক্ত৷ ‘সু’ অর্থাৎ সুন্দর ভাবে, ‘বচ’ ধাতুর উত্তর ‘ক্ত’ প্রত্যয় যোগে নিষ্পন্ন হয় ‘উক্ত’ অর্থাৎ যা বলা হয়েছে৷ এমনি একটা সূক্ত হ’ল ঃ
‘‘অসতো মা সদ্গময়ো তমসো মা জ্যোতির্গময়ো
মৃত্যোর্মা অমৃতংগময়ো আবিরাবিঃ ময়ৈধি৷৷
রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখম্ তেন মাং পাহি নিতাম্৷৷’’
এখন এই সূক্তের প্রথমেই ‘অ–সদ্’ বলা হয়েছে কেন? ‘সৎ’ মানে যা অতীতে ছিল, বর্ত্তমানেও রয়েছে ও যা ভবিষ্যতেও থাকবে৷ আর যা আগে ছিল না, আজ রয়েছে কিন্তু কিছুদিন পর আবার থাকবে ন –– তা হ’ল ‘অসৎ’৷ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একমাত্র পরমপুরুষই সদ্বস্তু, বাকী সব কিছুই ‘অসৎ’৷ সংসৃক্ত ‘অস্’ ধাতুর উত্তর ‘শতৃ’ প্রত্যয় করে ‘সৎ’ শব্দ নিষ্পন্ন হয – That which exists, প্রথমা বিভক্তির বহুবচনে ‘সন্ত’ হয়৷ কবীরের গানে আছে –– ‘‘কহতো কবীর, শুণো ভাই সন্তেন্তা’’৷ ‘সন্তেন্তা’ বলার দরকার নেই৷ ‘সন্ত’ শব্দটাই বহুবচনান্ত৷
এই যে সদ্ বস্তু বা সৎ সত্তা, মানুষকে এঁরই খোঁজ করতে হবে, এঁরই সাধনা করতে হবে, এঁকেই জানতে হবে, অসৎকে নয়৷ তাই ঋষি এই বলে আকূতি বা প্রার্থনা জানাচ্ছে –– ‘‘হে পরমপুরুষ, তুমি আমাকে অসৎ থেকে সৎ–এর দিকে নিয়ে চল৷’’
মানুষের চারিদিকে অসংখ্য অসৎ–য়ের ভীড়, অগণিত জাগতিক বস্তু ছড়িয়ে রয়েছে৷ মানুষ এই জাগতিক বস্তুর ঝিলিক্ দেখে মুগ্ধ হয়৷ সেগুলোর বাহ্যিক রঙে মোহগ্রস্ত হয়৷ কিন্তু সেগুলো তো চিরকাল থাকে না, একদিন মানুষকে কাঁদিয়ে ভাসিয়ে দিয়ে চলে যাবেই৷ কিন্তু যা সৎ বস্তু, তা তো কোন দিন মানুষকে ছেড়ে চলে যায় না, তাকে হারানোর কোন ভয় নেই৷
এখন প্রশ্ণ হ’ল, মানুষ সৎকে অবলম্বন করবে কেন? জগতের এই যে অসৎ বস্তুগুলে –– সেগুলো তো মানুষের পক্ষে বন্ধনের কারণ৷ একমাত্র সৎ বস্তুই মানুষকে মোক্ষ দিতে পারে৷ এই সৎ–এর দিকে যে গতি তাকে বলে ‘শ্রেয়’ সাধনা, আর অসৎ–এর দিকে যে গতি তার নাম ‘প্রেয়’ সাধনা৷ বলা হয়েে–
‘শ্রেয়াত্মিকা যা ৰুদ্ধিঃ সা মোক্ষদায়িনী৷
প্রেয়াত্মিকা যা ৰুদ্ধিঃ সা প্রাণঘাতিনী৷৷’
মানুষ শ্রেয়কে অবলম্বন করে জীবন পথে চলতে চলতে সৎ–কে পায়, মোক্ষ লাভ করে৷ মুক্তি নয়, মোক্ষ লাভ করে৷ মুক্তির সাথে মোক্ষের একটা স্পষ্ট পার্থক্য আছে৷ মুক্তি হ’ল সাময়িক, মোক্ষ স্থায়ী৷ একবার সাময়িক মুক্তি লাভ করে মানুষ আবার বন্ধনে পড়তে পারে৷ যেমন ধর, একবার ক্ষিদে পেয়ে মানুষ কিছু খেয়ে নিল, ক্ষিদেটা সাময়িকভাবে দূর হ’ –– এটা মুক্তি৷ কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার তো ক্ষিদেটা ফিরে আসতে পারে, আসবেও৷ তাই ওটা মুক্তি, মোক্ষ নয়৷ দ্বিতীয়তঃ মুক্তির বেলায় মানুষ জাগতিক বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে, কিন্তু সেই ‘এক’ ও ‘অদ্বিতীয়’ অপরিণামী সত্তার সাথে অবিনাভাবিত্ব স্থাপন করতে পারে না৷ মোক্ষের অবস্থা হ’ল অপরিণামী সত্তার সাথে ‘এক’ হয়ে যাওয়া, অবিনাভাবিত্ব প্রতিষ্ঠা করা৷ তাই বলি, শ্রেয় সাধনা হ’ল মোক্ষের সাধনা৷
তোমরা এই যে আধ্যাত্মিক সাধনা করছ, মধুর সাধনা করছ, ধর্মৰুদ্ধিপ্রেষিত হয়ে জনসেবা কর –– এ সবই শ্রেয় সাধনা, জাগতিক কোন কিছুর জন্যে তোমরা এই সব করছ না৷ এই শ্রেয় সাধনা মানুষকে মোক্ষ দান করে আর যে মানুষ শ্রেয়াত্মিকা ৰুদ্ধির বদলে প্রেয়াত্মিকা ৰুদ্ধির দ্বারা প্রেষিত হয়ে জগতে কাজ করে, নিশ্চয় জেনো, সে আত্মহত্যার পথই বেছে নিয়েছে৷ সে পায়ে ফাঁস পরতে চলেছে৷ তাই প্রেয়াত্মিকা ৰুদ্ধির ফল এই যে বন্ধনের ক্ষীজগুলে –– ঈশ্বর সাধনার দ্বারা সেগুলো পুড়িয়ে ফেল৷ তাই মানুষকে দগ্ধক্ষীজ হতে হবে তোমাদের সাধনা হ’ল দগ্ধক্ষীজ হবার সাধনা৷