গড়পড়তা ৰৌদ্ধিক মাপের একজন মানুষের কাছে জল ও বরফ দু’টি পৃথক সত্তা কিন্তু যারা সত্য সম্পর্কে অল্পকিছু জানে তারা ৰোঝে জলের ঘনীভূত রূপই বরফ৷ একইভাবে সাধারণ মানের মানুষ যখন একটা পাত্র ও কুম্ভকারের ঙ্মযে পাত্রটি তৈরী করেছেৰ মধ্যে একটা বিরাট পার্থক্য দেখে, ব্রহ্মজ্ঞানী সেখানে দুই–কে একইভাবে দেখে৷ এই যে জগত আর ব্রহ্ম–এ দু’টো কি পৃথক সত্তা না তারা অবিভাজ্য, একটা সত্য আর অন্যটা কি মিথ্যা? এ দু’টো সত্তার মধ্যে যে পার্থক্য চোখে পড়ে তা কি সত্য না মায়া?–এ ধরনের প্রশ্ণ বা চিন্তা–ভাবনা ব্রহ্মজ্ঞদের মনে কখনও আসে না৷
এই যে জগত আর ব্রহ্ম দু’টো পৃথক সত্তা, না এরা একে অন্যের থেকে পৃথক নয়–এ ধরনের ভাবনা–চিন্তা করাই ভুল৷ ব্রহ্মজ্ঞ অনুভব করে যে এই জগতটা পরমপুরুষের নিজেরই অভিপ্রকাশ–ব্রহ্মজ্ঞ জানে সবকিছুই ‘তিনি’৷ ব্রাহ্মীদৃষ্টিতে এ ধরনের পার্থক্যটা কেমন দেখায় জান? এটা ইংরেজীতে ‘ব্যষ্টি’ ও ‘মানবীয় সত্তা’ বা ‘সাগর’ ও ‘ সমুদ্র’–এর মধ্যে যে পার্থক্য তার চেয়ে মোটেই বেশী নয়৷ এক সাধকের দৃষ্টিতে পার্থক্য মোটেই থাকে না৷
ক্রমোন্নত সত্তার ক্ষেত্রে ব্রহ্মই প্রভু৷ তিনিই তাদের প্রত্যেকের নিয়ন্ত্রক৷ এই ব্রহ্মই গর্ভাধারে ভ্রূণ হয়ে বিচরণ করেন আর জন্মের পর সেই ঘটনাটিকে বলা উচিত ব্রহ্মের জন্ম, কারণ সৃষ্টি মাত্রেই ব্রহ্মের বিকাশ৷
চাঁদ একটাই কিন্তু তার ছায়া যখন অসংখ্য জলাধারে পড়ে তখন অসংখ্য চাঁদ বলে মনে হয়, আসলে নোতুন কোন চাঁদের জন্ম হয় না৷ একই চাঁদ বিভিন্ন আধারে প্রতিবিম্বিত হয় বা জন্ম নেয়৷ সেইভাবে এক ও একই ব্রহ্ম অসংখ্য মানসভূমিতে অসংখ্য একক সত্তা হিসেবে অভিব্যক্ত হয়ে থাকেন৷
একজন সাধকের সঙ্গে ব্রহ্মের যে মিলন তার খুবই সুন্দর উদাহরণ আছে৷ একটা নদী তার নিজের নাম–গোত্র ত্যাগ করে সাগরে গিয়ে মেশে, তারপর সে আর তার নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে না৷ সেইভাবে একজন সাধক নিজেকে ব্রহ্মে মিলিয়ে দেওয়ার পর ব্রহ্ম ছাড়া আর নিজেকে কোনকিছু ভাবতেই পারে না৷
গঙ্গা নদীকে দেখে আমরা বলি এটা গঙ্গার জল বা এটা যমুনার জল বা এটা সরস্বতীর জল৷ কিন্তু সমুদ্রে মিশে যাওয়ার পর আমরা আর তাদের পৃথক করতে পারি না, তাদের পৃথকভাবে চিনতে পারি না৷ তারা সকলে তাদের আপন আপন নাম ও অস্তিত্ব সমুদ্রের অস্তিত্বে হারিয়ে ফেলে৷
সত্যদ্রষ্টা যখন নিজেকে পরমসত্তায় মিলিয়ে দেয়, তখন তার নিজের ক্ষুদ্র অস্তিত্বৰোধ লোপ পেয়ে যায় আর পরমসত্তায় এক হয়ে গিয়ে সে নিজেও বিরাট হয়ে যায়৷ আধ্যাত্মিক সাধনা আত্মিক বিকাশের পথ, ধ্বংসের পথ নয়৷ তাই সমাধি মানে আত্মহনন নয়, আত্মোপলব্ধি৷ ব্রহ্মকে যে দেখেছে সে নিজেই ব্রহ্ম হয়ে গেছে৷ কারণ ব্যষ্টিসত্তা ধ্যেয়বস্তুরই অবস্থা প্রাপ্ত হয়৷ আর ব্রহ্ম যার ধ্যেয় সে নিজেই ব্রহ্ম হয়ে যায়৷
একটা নুনের পুতুল যদি সমুদ্র মাপতে যায় তাহলে সে নিজে গলে গিয়ে সমুদ্র হয়ে যায়৷ সেইভাবে ব্রহ্মজ্ঞ যখন ব্রহ্মের গভীরতা মাপতে যায় তখন সে ব্রহ্মসমুদ্রে মিশে গিয়ে নিজেই ব্রহ্ম হয়ে যায়৷
নিজেকে অনবরত ব্রহ্মভাবে ডুবিয়ে রাখ, তুমিও ব্রহ্ম হয়ে যাবে৷
(১৯৭১ বা তার আগে৷)