বাঙালীর জাতিসত্ত্বা ভাষা, লিপি ও কৃষ্টি কি হারিয়ে যেতে  বসেছে

লেখক
জে.ডি. মণ্ডল

বাঙালী জাতিসত্ত্বা, ভাষা, লিপি ও কৃষ্টির প্রাচীনত্ব আজ পথে-ঘাটে ধ্যান-দরবারে জোরদার প্রশ্ণ উঠছে, ফলে জাগ্‌ছে ক্ষোভ-বিক্ষোভও৷ তাই বিভিন্ন গ্রন্থপাঠে যে ঐতিহাসিক তথ্য উঠে আসে তা হলঃ---

১৷ আজ থেকে আনুমানিক (কম/বেশী) সাড়ে তিন হাজার বছর আগে তারকব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হন ও কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ সংঘটিত করেন৷ কুরুক্ষেত্র রেলষ্টেশন তথা অঞ্চলটা রয়েছে দিল্লির উত্তরে হরিয়ানায়৷ বর্তমান বৃহত্তর দিল্লির আশপাশ অঞ্চলে---মাটির নীচে ইন্দ্রপ্রস্থ, হস্তিনাপুর ইত্যাদির ধবংসাবশেষ আবিষৃকত হয়েছে৷ সেই ঐতিহাসিক কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে তথা--- ‘‘কৌরব পাণ্ডবের যুদ্ধে বাঙলার রাজারা অংশ নেয়নি৷ তারা বলেছিল এতে বাঙলার কোন স্বার্থ নেই, শুধু শুধু আমরা লোকক্ষয়  কেন করবো, হাজার  হাজার লোক কেন মরবে? আমরা নিউট্রাল থাকবো৷ বাঙলার রাজা অংশ নেয়নি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে৷’’

এই কারণেই হিন্দু যুগ থেকে পাঠানযুগে, মোগল যুগে, সব যুগে দিল্লীর বাদ্‌শার সাথে বাংলার রাজাদের, ভূঁইয়াদের লড়াই চলে এসেছে৷ চিরকাল লড়াই চলে এসেছে, এটা আদর্শগত সংঘর্ষ৷

কথা প্রসঙ্গে বলতে হয়--- আজ সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে বাঙলার সাথে দিল্লীর বিমাতৃসুলভ আচরণ করে চলেছে৷ ধ্রুপদী ভাষার তালিকায় বাংলাকে এখনো গ্রহণ করা হয়নি৷ একি হাতে মারতে পারি না তো ভাতে মারি’’-এর কৌশল নয়? কথায় বলে না ---‘সেই ট্রেডিশন সমানে চলছে’!

২৷ বাঙলার এই পুরোনো মাটিটা হল ---‘‘মানভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুরের অধিকাংশ, বর্দ্ধমানের পশ্চিমাংশ ও বীরভূম৷ বাঙলার এটাই হল সবচেয়ে পুরানো মাটির দেশ৷ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন এই অংশেই পাওয়া যাবে--- যাচ্ছেও৷ বাঁকুড়া জেলার শুশুনিয়া পাহাড়ে লেখা যে শিলালিপি, তা-ই বাংলা ভাষায় লেখা সবচেয়ে পুরানো শিলালিপি৷ এই বাঁকুড়া জেলারই বড়জোড়া থানার বেলোতাড় গ্রামে বাংলা ভাসায় লেখা সবচেয়ে পুরাণো পুঁথি পাওয়া গেছে৷ বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’ এই রাঢ়েরই, বর্তমানে অবশ্য বিহারের কিন্তু বাংলা ভাষাভাষি অঞ্চল৷ আগেকার মানভূম জেলার চাণ্ডিল থানার জায়জা গ্রামে পুরানো শিলালিপি ‘অভিজ্ঞানপত্র’---বাংলা ভাষায় বাংলা অক্ষরে পাওয়া গেছে৷’’

‘‘সম্প্রতি সিংভূম জেলার পটমদা থানার ভুলা-পবনপুর গ্রামে ও তার পাশেই কমলপুর থানার বাঙ্গুরদা গ্রামে ও তার দক্ষিণ পশ্চিম দিকে চাণ্ডিল থানার জায়জা গ্রামে জৈনযুগের বেশ কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে৷ তার সঙ্গে পাওয়া গেছে সেই যুগের বাংলা লিপি৷ এই লিপি অবশ্যই ১৭০০ বছর বা তারচেয়েও অধিক পুরানো৷ যে লিপিমালা পাওয়া গেছে তা, শুশুনিয়া লিপির চেয়ে পুরানো তা বটেই, হর্ষবর্ধনের শিলমোহরে প্রাপ্ত শ্রীহর্ষ লিপির চেয়েও বেশ পুরানো৷

....এই লিপি পূর্বভারতের নিজস্ব লিপি৷’

‘‘....বাংলালিপি শ্রীহর্ষ লিপির স্বগোত্রিয় হলেও তারচেয়ে অনেক পুরানো৷ এই লিপিগুলোর সব কয়টিই পাওয়া গেছে পশ্চিম রাঢ়ের দালমা পাহাড় ঘেরা বিভিন্ন নদী উপত্যকায়৷ তাই এর নাম হওয়া উচিত ‘দলমা লিপি’৷ (প্রাউট প্রবক্তা পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বাঙুরদায় আবিস্কৃত বাংলা লিপির নামকরণ করেছেন দলমা লিপি) অর্থাৎ বাংলা ভাষায় লিখিত হয়েছে শ্রীহর্ষতে নয়, শ্রীহর্ষের স্বগোত্রিয় কিন্তু প্রাচীনতম দালমা লিপিতে৷’’

....বিশ্ববিদ্যালয়ে দেবনাগরী অক্ষরে সংস্কৃতের পঠন-পাঠন হলেও দেবনাগরী সংস্কৃতের প্রাচীনতম লিপিও নয়, নিজস্ব লিপিও নয়৷ প্রাচীনতম লিপি হলো বাংলা৷ আর সংস্কৃতের নিজস্বলিপি বলতে কোন লিপিই নেই৷

জানা যায়--- সংস্কৃত কম করে হলেও পনের হাজার বছরের পুরানো, ঋক্‌বেদের সময়কার৷ কিন্তু সে ছিল গুরুমুখী ভাষা, কোন লিপি ছিল না৷ শেষে, মহারাষ্ট্রের নাগর ব্রাহ্মণরা যে ভাষায় শাস্ত্র লিখতেন বা পড়তেন তাতে মাত্রা যোগ করে আজকের সংস্কৃতের দেবনাগরী লিপি তৈরী করা হয়৷ এখন লিপি প্রাচীনত্ব যদি ধ্রুপদী ভাষার অন্যতম প্রধান বিশেষতঃ হয় তবে বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দেওয়া হবে না কেন? (ক্রমশ)