ব্যবসায় ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা দিয়ে কেবল করধার্যের ক্ষেত্রে কঠোরতা করা যে সাফল্যজনক হয় না তা’ অধিকাংশ রাষ্ট্রেরই জানা আােছ৷ আজকের পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রেই বিক্রয়কর, ক্রয়কর, আয়কর, অতিলাভ কর প্রভৃতি ৰাৰদ সরকারের যা’ আয় হ’য়ে থাকে তা’ ন্যায্য–প্রাপ্যের এটি অতিক্ষুদ্র ভগ্ণাংশ মাত্র৷ কর আদায়কারী কর্মচারীদের চাইতে কর যারা ফাঁকি দেয় তারা অনেক ৰেশী ৰুদ্ধিমান, অনেক ৰেশী অভিজ্ঞ৷ সমস্বার্থের ভিত্তিতে তারা ৰেশ একতাৰদ্ধও ৰটে, কিন্তু কর আদায়কারীরা একতাৰদ্ধ নয়, তাদের মধ্যে ৰখরা নিয়ে সংষর্ঘ থাকে, তাদের মধ্যে নীতিগত ভেদ থাকে, তাদের মধ্যে বিশ্বাস–ঘাতকতা থাকে, তাই অতিরিক্ত কর–ধার্য করে’ বৈশ্যপ্রভাব খর্ব করা অসম্ভব না হ’লেও রীতিমত কষ্টসাধ্য আর কষ্ট করে’ যদি তাকে সম্ভবও করা যায় তবু তার থেকে জনসাধারণ তেমন ৰেশী উপকৃত হয় না৷
আমার মতে এই বৈশ্য–লোলুপতার হাত থেকে সমাজকে ৰাঁচাতে হ’লে একটি মধ্য–পন্থাই নিতে হৰে৷ মধ্যপন্থা ৰলতে আমি এমন কথা ৰলছি না যে বৈশ্যের লোভবৃত্তিকে কিছুদূর পর্যন্ত সহ্য ক’রে নিয়ে তাদের সাথে কোনও রকমের আপোষ রফা করতে হৰে৷ আমার বক্তব্য এই যে,যা’ কিছুই আমরা করি না কেন তা’ যেন সমাজের ভা’ যেন সমাজের ভারসাম্য যথাযথভাবে রক্ষা করে’ চলে৷ ঝোঁকের ৰশে বা বিদ্বেষের ংশে এমন কিছু করে’ বসা উচিত হবে না যার ফলে সমাজ–জীবনের কোনও কোনও ক্ষেতের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে অথবা সৎনীতির ভিত্তিতে যে ব্যবস্থাগুলো গড়ে’ উঠেছে সেগুলোয় ফাটল ধরে যেতে পারে৷
ব্যবসা–বাণিজ্য, কর–ব্যবস্থা ও ব্যাঙ্কিং–এর ক্ষেত্রেও প্রাউটের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে৷ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বণ্টন করতে হৰে উপভোক্তা সমবায়ের মাধ্যমে, সরকার, ব্যবসায়ী বা বিভিন্ন স্তরের দালালদের মাধ্যমে নয়৷ এটা করা হলে মুনাফাবাজরা কোন রকম কারসাজি করার সুযোগই পাবে না৷
সমবায়ের মাধ্যমেই এক সামাজিক–র্থনৈতিক অঞ্চল থেকে আর এক সামাজিক–র্থনৈতিক অঞ্চলে পণ্য রপ্তানি করতে হবে৷ কাঁচামাল রপ্তানি করা যাবে না৷ কেবল প্রস্তুত পণ্যই বিশেষ ক্ষেত্রে রপ্তানি করা যেতে পারে৷ বিশেষ সামাজিক–র্থনৈতিক অঞ্চলের চাহিদা মিটে যাবার পর অতিরিক্ত পণ্য অন্য সামাজিক–র্থনৈতিক অঞ্চলে রপ্তানি করা যেতে পারে–তবে সেই অঞ্চলেই রপ্তানি করতে হবে, যেখানকার জনগণের সেই পণ্যের চাহিদা মেটানোর সুযোগ বা উৎপাদন–ক্ষমতা অদূর ভবিষ্যতে নেই৷ আর আমদানি ও রপ্তানি সংক্রান্ত সমস্ত বাণিজ্য প্রত্যক্ষভাবে সমবায়ের মাধ্যমে করতে হবে, ও মুনাফার উদ্দেশ্যে পণ্য রপ্তানি করা চলবে না৷
জনগণের নূ্যনতম চাহিদা মেটানোর মত কাঁচামালের অভাব যদি থাকে, তাহলে অন্য সামাজিক–র্থনৈতিক অঞ্চল থেকে সেই কাঁচামাল প্রয়োজনীয় পরিমাণে আমদানি করা যেতে পারে–তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, যে অঞ্চল থেকে আমদানি করা হবে, সেখানে তার উদ্বৃত্ত উৎপাদন রয়েছে৷ স্বয়ম্ভরতা অর্জনের পর অবাধ বাণিজ্যকে উৎসাহিত করতে হবে৷ এর ফলে সামাজিক–র্থনৈতিক অঞ্চলগুলির মধ্যে অধিকতর সমৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সমতা আসবে৷১৯
পারস্পরিক বাণিজ্য যতদূর সম্ভব পণ্য বিনিময়ের ত্ব্ত্রব্জব্ধন্দ্বব্জ ব্দম্ভব্দব্ধন্দ্বপ্পগ্ মাধ্যমে করতে হবে৷৯ বৈদেশিক বাণিজ্য যেখানে অদল–বদল প্রথায় বা বিনিময় প্রথায় হয়, তাকে বলা হয় বাটার ট্রেড চ্ত্রব্জব্ধন্দ্বব্জ ব্জ্ত্রস্তুন্দ্ববু৷ যে সব দেশের বেচবার বেশী কিছু জিনিস নেই, কিন্তু কেনবার আছে অনেক কিছু, আর বেচবার জিনিসগুলি সংখ্যায় কম হলেও আয়তনে বেশী, তাদের পক্ষে বিনিময়–বাণিজ্য বেশী লাভজনক৷ অন্যথায় তাদের স্বর্ণবিত্তের ন্ধপ্সপ্তস্তু–ত্ব্ব্ভপ্ত্ সঞ্চয় অল্প সময়ে ফুরিয়ে যাবার সম্ভাবনা থেকে যায়৷২০
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীকে কর–মুক্ত করতে হবে৷ আয়কর থাকবে না৷ পরিবর্তে উৎপাদনের প্রারম্ভ–বিন্দুতেই কর ধার্য করতে হবে৷ ব্যাঙ্ক–ব্যবস্থা সমবায়ের মাধ্যমে পরিচালিত করতে হবে৷ কেন্দ্রীয় ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্ক অব্যবহিত সরকার বা স্থানীয় সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে৷৯
কৌশীদ (Bank)ঃ
কুশীদ–ব্যবস্থা বা কৌশীদ* রাখতেই হবে, নইলে অর্থের চলমানতা ব্যাহত হবে৷ ব্যষ্টিগত ভাবনা বা অন্য কোন ভাবনায় প্রেষিত হয়ে কেউ যদি কৌশীদ বা কুশীদ–ব্যবস্থার বিরোধিতা করে, তবে তাকে আর্থিক ব্যাপারে অন্ধকার যুগেই থেকে যেতে হবে৷ এমন অবস্থাটা কারো হোক তা ভাবতেও পারা যায় না৷ কৌশীদ বা কুশীদ–ব্যবস্থার মোদ্দা কথা হ’ল–টাকাকে ঘুরতে দাও, রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সচল করে’ তোল–চাল, ডাল, নুন, তেল টাকা দিয়ে কেনো–কেনো যত পার৷ টাকাটা যাক মুদীর দোকানে, সেখান থেকে যাক আখের গুড়ের শালে, সেখান থেকে যাক ময়রার দোকানে, সেখান থেকে যাক কারখানায়, সেখান থেকে যাক মজুরের হাতে, সেখান থেকে যাক হাটে শাড়ী–বেচা তাঁতীর কাছে৷ তাঁতীর কাছ থেকে সে যাক নববধূর রঙিন শাড়ীতে...রঙিন শাড়ী সমাজে এনে দিক বর্ণাঢ়্যতা৷
অর্থের মূল্য বেড়ে চলে তার চলমানতায় অর্থাৎ টাকা যত হাত ঘুরতে থাকে ততই তার মূল্য বাড়তে থাকে–এইটাই অর্থনীতির মৌলিক কথা৷ এই জনকল্যাণের কথা ভেবে কৌশীদ ব্যবস্থা রাখতে হয়, ও জনগণের সামগ্রিক আর্থিক উন্নতির কথা ভাবতে গেলে কৌশীদ ব্যবস্থা অপরিহার্র্য হয়ে যায়৷ ‘Keep the wagons moving’–এর ‘Keep coins (money) moving’Öকথাটা সমভাবে সত্য৷
কৌশিদ ব্যবস্থার ত্রুটি ঃ কৌশীদকে দু’টি (ত্রুটির) দিকে নজর রাখতে হবে৷ একটা হচ্ছে কৌশীদ ব্যবস্থা এমন যেন না হয় যার রাক্ষসী ক্ষুধায় সাধারণ মানুষের জীবন কুশীদ যোগাতেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে৷ কৌশীদ ব্যবস্থার দ্বিতীয় ত্রুটি হচ্ছে–অবিবেকী রাষ্ট্র–পরিচালকরা বা রাষ্ট্র–পরিচালন ব্যবস্থা অনেক সময় রাজকোষে বা কৌশীদে উপযুক্ত মূল্যের বিত্তকোষ (Bullion) না রেখে যথেচ্ছভাবে নোট ছাপিয়ে যায়৷
প্রথমোক্ত ত্রুটিটা কেবল মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র পরিবারকেই যে ধ্বংস করে তাই নয়, যারা ধনী পরিবার তাদেরও পথে বসায়৷ দ্বিতীয় ত্রুটিতে সমস্ত সমাজজীবন ধ্বস্ত–বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে৷ ব্যাপকভাবে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়–যা আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য–ব্যবস্থা ও বৈদেশিক বাণিজ্যিক আদান–প্রদান–দুইকেই বিপন্ন করে’ দেয়৷ শেষে দেশে উৎপাদন যত বেশী হোক না কেন সাধারণের ভোগে তা লাগে না৷ তাতে ধনী আরো স্ফীতোদর হয়, আরো নির্মমভাবে তাদের শোষণযন্ত্র চালাবার সুযোগ পেয়ে যায়৷ রাষ্ট্রীয় ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় (State capitalism) জনগণের ওপর রাষ্ট্র–শাসক শোষকের ভূমিকায় আরও দৃঢ়ভাবে জগদ্দল পাথরের মত বুকের ওপর চেপে বসে৷ এই রাষ্ট্রীয় ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা (State capitalism) নিজেকে ধনতান্ত্রিক (Capitalism), সমাজতান্ত্রিক (Socialism),, ধনসাম্যবাদী (Communism) যাই বলুক না কেন, জনসাধারণের কাছে তা রাক্ষুসী পিশাচের চেয়েও ভয়ানক ও রক্তমোক্ষক৷
* যোগারূঢ়ার্থে ‘কুশীদ’ বলতে ‘সুদ’–কে বোঝায়৷ ... ‘কৌশীদ’ শব্দের যোগারূঢ়ার্থ হচ্ছে যেখানে কুশীদ সম্বন্ধীয় কাজ–কারবার সংশাধিত হয়৷ বৈদিক যুগে কৌশীদ বা ব্যাঙ্ক ছিল কিনা তার কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই৷ বেদোত্তর যুগে কিন্তু জিনিসটা ছিল৷