অসম রাজ্যের সিংহভাগ বৃহত্তর সাবেক বাঙলারই খন্ডিত অংশ৷ আজও বাঙালীরাই অসমের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তার বাঁয়া হিন্দী সাম্রাজ্যবাদ ইতিহাসকে বিকৃত করে ভুল তথ্য দিয়ে বাঙলা থেকে কাটা অসমের ভূমিপুত্র বাঙালীদেরই গায়ে বিদেশী অনুপ্রবেশকারী দখলদার লেবেল সেঁটে দিয়েছে, ডি-ভোটার বানিয়েছে৷ এন.আর.সি ইস্যু তৈরী করে বাঙালীদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে৷ বিপন্নতা বাঙালীদের গ্রাস করেছে৷ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আতঙ্কে চলছে আত্মহত্যা, চলছে খুন , ধর্ষণ, অপহরণ, ‘বাঙালী খেদানো’রহুমকি৷ জঙ্গী অহোমরা পাঁচ নিরীহ নিরাপরাধ অসহায় বাঙালীকে কুকুর -ছাগলের মতো গুলি করে মারল৷ অসম উপতক্যায় চলছে বাঙালীর মৃত্যুর প্রদর্শনী৷ ভূমির নাম পালটালেই তো ভূমিপুত্রদের পরিচয়, অধিকার পালটে যায় না৷ এ অধিকার প্রকৃতিগত অধিকার৷
রক্ত-সূত্রের অধিকার৷ কলমের খোঁচায় সে অধিকার চলে গেল? বাঙালী হল বিদেশী! নিজভূমে পরবাসী! ‘‘সত্য সেলুকাস, কী-বিচিত্র এই দেশ !’’
অসমের বাঙালীদের হয়ে অনেক বাঙালী প্রতিষ্ঠান ও দলই ভাবছে৷ কিন্তু ভাবনাগুলো একত্রে দানা বাঁধছে না৷ সে সব নিজের গন্ডীর মধ্যেই আবদ্ধ ৷ কানার হাতি দেখার মতো এক দল এক এক মত জাহির করে চলেছে৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে একসঙ্গে পথে নামলেও লক্ষ্যে সবাই একলব্য নয়৷ কেবল মত পার্থক্য, সহমতের অভাবই নয়, ইগোর লড়াই ও কর্তৃত্ব হারানোর আতঙ্কে দলগুলির কন্ঠস্বর এক সুরে বাজছে না৷ ফলে আ-সমুদ্র হিমাচল বাঙালীদের এক বলিষ্ঠ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে উঠছে না৷ অদ্ভুত ব্যাপার হল--- সবাই বলছে --- তারা লড়াই করছে, হাত পা ছঁূড়ছে , কিন্তু শত্রু কে ? কার বিরুদ্ধে লড়াই ? কিসের জন্যে সংগ্রাম ? আসলে বাঙালীর সর্বনাশের কারণটাই বা কী? কেবল কেরামতির বাহার আর অস্পষ্টতা! শত্রুকে আড়াল করে মূল কারণটাকে চাপা দিয়ে মানুষের দৃষ্টিটাকে অন্যদিকে চালিয়ে দেয়া ! বাঙালীর এ এক অদ্ভুত আত্মপ্রবঞ্চনা৷ এই প্রসঙ্গে ‘আগ-বাঙালীদের কথা না বললেই নয়৷ এই আগ-বাঙালীদের একটু পরিচয় নেওয়া যাক৷ এরা কারা? যারা আগবাড়িয়ে নিজের মাতৃভাষা বাঙলাকে অছ্যুৎ মনে করে, অন্য বিভাষীর ভাষায় কথা বলে, হাম বড়া ভাব দেখায--- তারা কত ভাষা জানে! যারা নিজেদের সবচেয়ে বেশী বুদ্ধিমান মনে করে অন্যদের ভাবে বোকা, যারা নিজেদের নাক কান কেটে বুক চিরে পেটে কিল মেরে ভিন্দেশী ও বিভাষীদের পিন্ডি গেলানোকে ভাবে উদারতা, যারা লড়াইকে এড়িয়ে প্রতিবাদ -প্রতিরোধকে ঘোমটা চাপা দিয়ে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে শান্তির জল ছিটিয়ে ভাবে মহানুভবতা৷ ‘বাঙালী পদ্মাপাড়ে মার খেলো, গঙ্গাপাড়ে মার খেলে, বৈতরণীর পাড়ে মার খেলো, গোমতী- ব্রহ্মপুত্রের জলে রক্তে ভেসে গেল অথচ যারা এটা বলে বলে শ্লাঘা অনুভব করে --- যে ওটা বাঙালীদেরই দোষ--- বাঙালী দখলদার, যারা দ্বিজাতি তত্ত্বভিত্তিক বাঙলা ভাষাকে মনে করে এতেই বাঙালীর কল্যাণ৷ ওপারে থাকবে না হিন্দু এপারে থাকবে না মুসলমান৷ এপারে হিন্দী-হিন্দু -হিন্দুস্তান শ্লোগান৷ পাঁঠা কাটার মতো বাঙলাকে টুকরো টুকরো করে ওড়িশা, বিহার, অসম , মেঘালয় , মণিপুর, প্রভৃতি এলাকাতে হিন্দী সাম্রাজ্যবাদীদের দান -খয়রাতি করাকে বলে আমাদের অনেক আছে - ওরা কিছু পাক না ক্ষতি কী!--- বাঙলার বুকে হোকনা গোর্র্খদের জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠা --- হোক না মাড়োয়ারী ল্যান্ড , বাঙলার বেকার যুবকদের ঠেকে গ্যারেজ করে অবাঙালীদের দিয়ে কলকারখানা ভরানো হোক না ! ক্ষতি কী? শিল্পাঞ্চল অবাঙালীদের দখলে যাক না! আমরা সবাই মিলে বাস করি! ক্ষতি কী! এখানে বঙ্গ সংস্কৃতিতে হিন্দী-বিদেশী সংস্কৃতি চোলাই করে বলি এখানে সবার জন্যে অবারিত দ্বার৷ কেবল পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বাঙালীদের জায়গা নেই---ওরা বিদেশী অনুপ্রবেশকারী, দখলদার---বাঙলাদেশী! সত্য সেলুকাস কী বিচিত্র উদারতা মহানুভবতা সহনশীলতা আতিথেয়তা !!! সেই ভাব বাঙালীরাই হল দল আগবাঙালী৷ এই আগবাঙালীই বাঙালীর---বাঙলার---বাংলা ভাষা -সংস্কৃতির প্রধান শত্রু৷ এদের ভীম-উদ্গারই বাঙালীর সুদৃঢ় ঐক্যের মহা-মহা- অন্তরায়৷ হাজার হোক এরা বঙ্গবাসী-বঙ্গভাষী তো---যদিও অন্তরে-বাহিরে খাঁটি ভারতীয় ---আন্তর্জাতীয়, এদের কাছে বাঙালী হওয়াটা সংকীর্ণতা প্রাদেশিকতা!
বাঙলাকে রাহুমুক্ত হতে দলে এদের শোধন দরকার৷ এ ধরণের ক্ষেত্রে তিনটি পদ্ধতি জগতে চলেছে ৷ (এক) মহাচীনের মাওসেতুং-এর সাংসৃকতিক বিপ্লব পদ্ধতি, (দুই) কমিউনিষ্টদের বুর্জুয়াদের খতম অভিযান, (তিন) কনসাস কনসাসনেস মেথোড ৷ চীনের সাংসৃকতিক বিপ্লব সাময়িক একটা ধাক্কা দিলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি ৷ মাঝখান থেকে লক্ষ লক্ষ চীনাবাসীর প্রাণ গেল কেননা শোষণ অত্যাচার বঞ্চনার রোগটাতো মনে---সেটা শোধরানোর কোনো পথ ছিল না৷ বাহুবলে সেটা হয় না৷ দ্বিতীয় -খতম অভিযানে বুর্জুয়াদের খতম করলে তো আর বুর্জুয়াতন্ত্র শেষ হয় যায় না৷ আগ বাঙালীদের শোধন করা দরকার ‘কনসাস কনসাসনেস মেথোডে৷ অর্র্থৎ সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধ-গণতন্ত্র প্রতিরোধ ও জন-জাগরণ বা নবজাগরণ-এর মাধ্যমে৷ বাঙলার বুকে আর একটা ‘রেনেসাঁ দরকার৷ চাই বৈজ্ঞানিক ভাবনাঋদ্ধ মুক্তচিন্তার মানুষের অগ্রপথিকত্ব৷
বাঙালীর দ্বিতীয় প্রবল বহিঃশত্রু হল বাঙলাকে টুকরো টুকরো করা ও করে রাখার রীতি ---যার নাম ‘ডিভাইন্ড এ্যান্ড রুল’ পলিসি৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ শুরু করেছিল৷ হিন্দী সাম্রাজ্যবাদ তাঁর ষোলকলায় পূর্ণ করেছে৷ এই নীতির ফলে বাঙলার হাজার হাজার বছরের মূল ভূখণ্ডটাই কেবল টুকরো টুকরো হয়নি, জাতিসত্তার আবেগটাও ভেঙে খান খান৷ বাংলার বলিষ্ঠ সুপ্রাচীন অর্থনৈতিক বনিয়াদটাও ধবংস হয়ে গেছে ৷ বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি ও সামাজিক ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার পথে৷
কথায় বলে --- সম্পত্তি বাপের না দাপের৷ বাঙলীর ক্ষাত্রশক্তিটা শেষ করে দেয়া হয়েছে বাঙলা-বিচূর্ণীকরণের সঙ্গে সঙ্গে ৷ বাঙালীর ক্ষমতায়ণ, ভাষা-সংস্কৃতির উজ্জীবন ও সুরক্ষা, অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন, বাঙালীর ওপর থেকে ‘বিদেশী’, ‘বাঙালীদেশী’, ‘অনুপ্রবেশকারী’ এই কাল তকমাগুলো চিরতরে মুছে ফেলা, বেকার সমস্যার সমাধান তথা বাঙালীর সার্বিক মুক্তি, সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্যে সমস্ত বাঙালী অধ্যুষিত স্থান নিয়ে অখন্ড বাঙলা বা বাঙালীদের নিজস্ব বাসভূমি বা ‘বাঙালিস্তান’ গড়ে তোলা আজ একান্ত জরুরী৷ এসব ক্ষেত্রে অনীহা, উন্নাসিকতা, ও বাঙালী জাগরণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রই হল বাঙালীর প্রকৃত শত্রু৷ অসমিয়ারা বাঙালীর শত্রু নয়৷ অসমে ঢুকিয়ে দেওয়া আদি বাঙলার অঞ্চলগুলো নিয়ে বাঙলা পুনর্ঘটিত হলে অসম সমস্যাই থাকবে না৷ কাজেই বাঙলার স্বার্থে আন্দোলন করতে হলে আগে শত্রুকে সনাক্ত করতে হবে৷ সমস্যা তৈরী করে ও তাকে জিইয়ে রেখে বাঙালীর স্বার্থে আন্দোলন? নৈব নৈব চ৷
- Log in to post comments