বাঙালীস্তানের অন্তর্গত রাঢ়ের শিলাস্তরে আমরা সব রকমের শিলা বৈচিত্র্য পাই৷ যেমন–
(১) প্রাচীন কঠিন শিলা–যেখানে পাচ্ছি সোণা–রূপা–তাঁবা–পার্ প্রভৃতি৷
(২) আগ্ণেয় শিলা–যেখানে পাচ্ছি কোয়ার্জ ও কিছু কিছু বিশেষ ধরণের প্রস্তর৷
(৩) প্রাচীন পাললিক শিলা বা মৃত প্রস্তর–যেখানে পাচ্ছি কয়লা ও উন্নতমানের বালি৷
পূর্ব রাঢ় সমুদ্রত্থিত, তাই কয়লা হবার মত অরান্যানী পূর্ব রাঢ়ে ছিল না৷ তবে পূর্ব রাঢ়ে যে সকল স্থানে সারগাসো সমুদ্র (sargasso sea) ছিল সেখানে খনিজ তেল পাবার সম্ভাবনা আছে৷
পশ্চিম রাঢ় যেমন সমৃদ্ধ মাটির তলাতে পূর্ব রাঢ় তেমনি সমৃদ্ধ মাটির ওপরে৷ সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে বর্দ্ধমান–হুগলী–হা মেদিনীপুর–কান্দি মহকুমার মত উর্বর জমি বিরল৷ এর কারণ হচ্ছে রাড়ীয় নদীগুলির উজানে ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য প্রচুর খনিজ সমৃদ্ধ প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় পাললিক শিলা৷ আর নদীগুলির বালি–পলি জমির ওপর যাই পড়ুক না কেন, প্রায় সবক্ষেত্রেই জমির কিছুটা নীচে রয়েছে জলধারণ সামর্থ্যযুক্ত এটেঁল মাটি৷
পশ্চিমরাঢ়ের ওপরকার মাটি রক্ত মৃত্তিকা (laterite)৷ এই লাল মাটিও একেবারে বন্ধ্যা নয়৷ ক্যালসিয়াম–সমৃদ্ধ (পাথুরে চুন ও ঘুটিং) পশ্চিম রাঢ়ের মাটিতে কিছুটা চেষ্টা করলেই প্রচুর পরিমানে ও উৎকৃষ্ট মানের আপেল–ন্যাসপাতি–কম প্রভতি ফলতে পারে, ও বিভিন্ন ধরণের সেচ ব্যবস্থা (ক্ষুদ্র নদীসেচ, পুষ্করিণী সেচ ও তোলা সেচ বা লিফট ইরিগেশন) প্রবর্ত্তন করে’ উদ্যান শিল্প ও বছরে তিনটি ধানের (আউশ–আমন–বোরো) ফলনের চেষ্টা করা যেতে পারে৷ কৃষির সবরকম সম্ভাবনাই পূর্ব রাঢ়ে রয়েছে৷
শাল, পিয়াশাল (পিয়াল), হিজল, পলাশ, অশোক, কুসুম, গর্জন, কুড়চী, বকুল, বেলফুল, কুন্দফুল, কূটরাজ, নাগেশ্বর চাঁপা, নাগকেশর (নাগ চাঁপা বা দীঘল চাঁপা), শ্বেত পদ্ম, জাম, কাঁটাল, কেন্দু (ছোট গাব), অর্জুন, কৃষ্ণবট, জহুরী চাঁপা প্রভৃতি গাছপালার আদি পিতৃভূমি রাঢ় দেশ৷
সমগ্র বাঙালীস্তানকে আর্থিক দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে’ তুলতে হ’লে দু’টি বিষয়েরর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে–জীবনযাপনের জন্যে নূন্যতম প্রয়োজনগুলির উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, ও ব্যাপকভাবে অর্থকরী ফসল ও অ–কৃষি শিল্পের উৎপাদন৷ বাঙালীস্তানকে সমৃদ্ধ করতে এই দুটি বিষয়ের গুরুত্ব অপরিসীম৷
নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্ত্তির উৎপাদনের মধ্যে পড়বে পর্যাপ্ত খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা৷ এক এক করে’ দেখা যাক কীভাবে এ সংক্রান্ত উৎপাদন বাঙালীস্তানকে সমৃদ্ধ করতে পারে৷
খাদ্য উৎপাদন
খাদ্য উৎপাদনে বাঙালীস্তানের স্বয়ং সম্পূর্ণতার সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে শীতকালের বৃষ্টিপাতের স্বল্পতা, ও বর্ষাকালে জলনিকাশের সমস্যা৷ বর্ষাকালে বাঙলায় যথেষ্ট বৃষ্টি হয় ঠিকই, কিন্তু সেটা শুধু বছরের ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ স্থায়ী হয়৷ ব্যাপক হারে বন ধ্বংস করায় প্রয়োজনের তুলনায় বাঙলার বৃষ্টিপাত কমে গেছে৷ আর তার ফলে ফসলের উৎপাদনও কমে গেছে৷ নদীতেও জল খুব কমে যাওয়ায় সেচ ব্যবস্থাও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে৷ শীতকালে বৃষ্টি না হওয়ায় শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন ফসল মার খাচ্ছে৷ জল নিকাশী ব্যবস্থার ত্রুটির জন্যে নদীর জলকে ফসল উৎপাদনের কাজে ঠিকমত লাগানো হচ্ছে না৷ এই ধরণের সমস্যার মোকাবিলা করতে সেচ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে৷ বাঙলার যে সব অঞ্চলে বৃষ্টি কম হয়, বিশেষ করে রাঢ় অঞ্চলে সেচ ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দিয়ে নালা সেচ, তোলা সেচ, সায়র ও নদীতে ছোট ছোট বাঁধের ব্যবস্থা করতে হবে৷ এভাবেই নদী–নালার জলের সর্বাধিক উপযোগ নিতে হবে, ও জল নিকাশী ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে হবে৷ ময়ূরাক্ষী, কোপাই, অজয়, বক্রেশ্বর, দ্বারকা, বরাকর, কাঁসাই, কুমারী, দুলুং, কেলেঘাই, ছোটকী গুয়াই, বড়কী গুয়াই, সুবর্ণরেখা প্রভৃতি রাঢ়ের নদীগুলিতে ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের কাজ করতে হবে৷
দামোদরের গর্ভদেশ বর্ধমান জেলার অববাহিকার চেয়ে কোথাও কোথাও উঁচু হয়ে গেছে৷ কোথাও বা তা হতে চলেছে৷ এ অবস্থায় দামোদর থেকে কোথাও যদি বিপুল পরিমাণে জলের ঢল নেমে আসে তাহলে বর্দ্ধমান, হুগলী ও হাওড়া জেলা যে প্লাবিত হবে তাতে সন্দেহই নেই৷ এ অবস্থায় কার্যকরী পন্থা হচ্ছে ড্রেজারে করে’ দামোদরের গর্ভদেশ থেকে বালি–পলি সরিয়ে দিয়ে পাশের জমির চেয়ে নদীর খাতকে অনেকখানি গভীর করে’ দেওয়া৷ আর খরচ এড়াবার জন্যে তা যদি না করা হয় তাহলে দামোদরের পাশে সুউচ্চ বাঁধ দিতেই হবে৷ অজয় নদীর গর্ভদেশে পলি জমে ক্রমশঃ তা উঁচু হয়ে উঠেছে৷ দক্ষিণ বীরভূমে অজয় অববাহিকার কিছু অংশের মাটিতে বালির ভাগ অত্যন্ত বেড়ে গেছে৷ তবে এখনো সে জমিতে বেলেমাটির ফসল, শীতের কন্দ ও আখের চাষের সুযোগ রয়েছে৷ আর দেরী করলে সেই সুযোগ নাও থাকতে পারে৷ তখন যন্ত্রের সাহায্যে ওপরের বালি সরিয়ে তবে চাষের জমি কেটে বার করতে হবে৷ অজয়ের দক্ষিণাংশের বর্দ্ধমান জেলার ঠিক সেই অবস্থা এখনই না এলেও এর গর্ভদেশ এরই উপনদী কুনুরের চেয়ে উঁচু৷ যার ফলে কুনুরের জল অজয়ে না ঢুকে অজয়ের জল সময়ে সময়ে কুনুরে ঢুকে যায়৷ এই অবস্থাটা বাঞ্ছনীয় নয়৷ কেবল ডাইক * দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না৷
কলকাতা বন্দরকে বাঁচাতে ভাগীরথী নদীর নাব্যতা যে কোন মূল্যে রাখতেই হবে৷ ভারত সরকার এই জন্যে ফারাক্কা ব্যারাজ করেছিল৷ কিন্তু বাঙলাদেশের নদীগুলো যাতে শুকিয়ে না যায়, আর অর্থনীতি যাতে ধ্বংস না হয়ে যায় সেই জন্যেই ফারাক্কা ব্যারেজ থেকে ভারত যতটা জল নেবে, বাঙলাদেশকেও ততটা জল দেওয়া উচিত৷ ভারতের অংশের জলের ঘাটতিটা পূরণ করতে হবে ব্রহ্মপু– থেকে জল এনে৷ এতে বাঙলাদেশের কোন ক্ষতি হবে না৷ ধুবড়ী থেকে রামপুর, দীনাজপুর হয়ে মালদার মাণিকচক হয়ে ব্রহ্মপুত্রের জল যাতে গঙ্গায় পড়ে তার সুব্যবস্থা করলে মালদা–নদীয়ার চাষীকে অগভীর বা গভীর নলকূপের ব্যবহার করতে হবে না৷ (ক্রমশঃ)