আজকাল অনেক জায়গাতেই গভীর নলকূপের সাহায্যে জল তুলে চাষ করা হয়, এটা বিজ্ঞান সম্মত নয়, কারণ যত পরিমাণ জল তোলা হয়, তত পরিমাণ জল ওই গভীরতায় ফিরে যেতে পারে না৷ রোদের তাপে অনেকটা বাষ্প হয়ে যায়, আর কিছুটা গাছপালারা টেনে নেয়৷ এর ফলে জল–তল হু হু করে নেবে যায়৷ মালদা, নদীয়া ও অন্যান্য জেলায় যেভাবে গভীর নলকূপ ব্যবহার করা হচ্ছে তা যদি বন্ধ না করা হয়, তাহলে জল–তল এত নেবে যাবে যে ভবিষ্যতে সেচের জলের অভাবে সমস্ত ফসল ও গাছপালা মরে যাবে৷ চাষীদের এই সমস্যা সম্বন্ধে সচেতন হতে হবে৷ নদীর জলকে সেচের কাজে লাগানোটাই সর্বোত্তম উপায়৷
তিলাবনী পাহাড়ের পাশ দিয়ে ধলকিশোর নামে একটি ছোট নদী বেরিয়ে আসছে বাঁকুড়ার দিকে৷ আর শুশুনিয়ার উত্তর দিক থেকে আর একটি ছোট নদী বেরিয়ে আসছে–নাম গন্ধেশ্বরী৷ বাঁকুড়া শহরের কাছে দু’য়ে মিলে নাম হ’ল দ্বারকেশ্বর৷ দ্বারকেশ্বর যাচ্ছে আরও পূর্ব দিকে হুগলী জেলার আরামবাগে৷ বাঁকুড়া–মেদিনীপুর সীমান্তে শীলাবতী ও জয়পাণ্ডা নদী দুটো মিলে শিলাই নদী নাম নিয়ে মেদিনীপুর–হাওড়া–বাঁ সীমান্তে দ্বারকেশ্বরে মিশছে৷ মেশার পর দ্বারকেশ্বরের নাম হয়ে যাচ্ছে রূপনারায়ণ৷ সে তমলুকের কাছে গিয়ে ভাগীরথীতে মিশছে৷ এই যে নদী জল নিয়ে আসছে তিলাবনী পাহাড় থেকে, শুশুনিয়া পাহাড় থেকে, সেই জল সমুদ্রে গিয়ে মিশছে৷ সেই জলকে যদি আমরা বাঁকুড়া সদর মহকুমা, আরামবাগ মহকুমা, মেদিনীপুর, ঘাটাল, আর তমলুক মহকুমায় চাষের কাজে লাগাতে পারতুম তবে তা কৃষিতে সুন্দরভাবে ব্যবহূত হত৷ জমি বন্ধ্যা হয়ে পড়ে থাকতো না৷ এখন জলটা অযথা সমুদ্রের লোনা জলে গিয়ে মিশছে৷
সেচের সমস্যার সমাধান ঠিকভাবে করতে পারলে বছরে চারবার চাষ করে’ প্রচুর ফসল ফলানো যাবে৷ উদাহরণস্বরূপ একই জমিতে আমন, বোরো ও আউশ ধান ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সারা বছর ধরে চাষ করা যাবে৷ এক–একটা ফসলের জন্যে ৯০ দিনই যথেষ্ট৷ ভাদ্রমাসে আউস ধান ওঠে, তারপর কার্ত্তিক অগ্রহায়ণ পর্যন্ত আমন ধানের সময়৷ শীতের শেষ থেকে গরমকাল পর্যন্ত বোরো চাষ চলতে পারে৷ এইভাবে সারা বছর ধরেই নানারকমের ধানচাষ চলতে পারে৷
রাঢ়ের এঁটেল মাটি বেশীক্ষণ জল ধরে’ রাখতে পারে৷ সায়র, জলাধার, বাঁধ ইত্যাদি তৈরীর ক্ষেত্রে এই এঁটেল মাটিই আদর্শ৷ এই ধরণের মাটিতে মাছের চাষও হতে পারে কারণ এই ধরণের মাটি জল ধরে’ রাখতে সক্ষম৷ আমন ধানের জন্যেও এই এঁটেল মাটি খুবই ভাল৷ উত্তর বঙ্গে কিছু জায়গায় এঁটেল মাটি থাকলেও অন্যান্য জায়গার মাটি দোঁয়াশ মাটি৷ উত্তরবঙ্গের মধ্যে (অবিভক্ত) দীনাজপুর জেলা আমন ধানের উৎপাদনের আদর্শ জায়গা৷ বাঙলাদেশের মাটি মূলতঃ বেলেমাটি হওয়ায় আউস ধানের উপযুক্ত৷ দোঁয়াশ মাটিতে আউশ ভাল হবে৷ ত্রিপুরার মাটিতে আউশ, আলু ও গ্রীষ্মকালীন ফসল ভালো হবে৷ ত্রিপুরায় এত লঙ্কার চাষ হতে পারে যে তা বাঙলাদেশের বাজারেও পাঠানো যাবে৷ রাঢ়ের সরষের উৎপাদন, ও বাঙলার অন্যত্র তিলের উৎপাদন ভালো হবে৷ তিল থেকে নানাধরণের জিনিস তৈরী হতে পারে৷ তিল একটা অর্থকরী ফসল৷ আখ চাষে যেহেতু এক বছর ধরে’ জমি আটকে থাকে সেহেতু আখ চাষের বদলে বীট চাষ করার ওপর জোর দেওয়া উচিত৷ পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় আর বাঁকুড়ার শুশুনিয়া পাহাড় অঞ্চলে বীটের চাষ খুবই লাভজনক হবে৷ বীট আর শাঁখ আলু থেকে চিনি তৈরী করা যেতে পারে৷ রাঢ়ের ডাল ও আলুর চাষ ভালো হবে৷ বীরভূম জেলা তার নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে উত্তরবঙ্গ ও অসমে আলু সরবরাহ করে, ঠিক একইভাবে হুগলী জেলা কলকাতায়, বর্দ্ধমান জেলা (বর্তমানের ঝাড়খণ্ড সহ) বিহারে, আর মেদিনীপুর মধ্যপ্রদেশে আলু সরবরাহ করে৷ পূর্বরাঢ়ের আলুর চাষ খুবই ভালো হয়৷ ত্রিপুরায় উৎপাদিত সরষেও বাঙলাদেশে পাঠানো যাবে৷ ত্রিপুরার মাটি আনারস ও কলার পক্ষেও খুবই ভালো৷ ত্রিপুরায় চায়ের চাষ হতে পারে, কিন্তু চায়ের গুণমান ভালো হবে না৷ কাঁটাল* উৎপাদনের জন্যে যেহেতু তেমন কোন বিশেষ গুণসম্পন্ন মাটির দরকার পড়ে না তাই সারা বাঙলাতেই কাঁটালের চাষ হতে পারে৷ কাঁটালের রস ও কাঁটালের বীজ স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ভালো৷ কাঁটালের রসকে টিনজাত করতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রাও আসবে৷
ত্রিপুরায় বুনো প্রজাতির কচুর ফলন হতে পারে৷ সব্জি চাষের জন্যে বৃষ্টির জলের প্রয়োজন না হলেও মাঝেমাঝেই জলের প্রয়োজন হয়৷ সেদিক থেকে দেখলে নদীয়া আর কুষ্ঠিয়া জেলায় প্রচুর সব্জির চাষ হতে পারে৷
নারকেল গাছের জন্যে যেহেতু লবণাক্ত জলের দরকার সেহেতু দক্ষিণবঙ্গের সমুদ্র তীরবর্ত্তী অঞ্চলে নারকেলের চাষ খুবই ভালো হবে৷ অর্থাৎ (অবিভক্ত) ২৪ পরগণা, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাকে প্রচুর পরিমাণে নারকেলের চাষ হতে পারে৷ অপরদিকে শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার থেকে শুরু করে কাছাড়, করিমগঞ্জ পর্যন্ত অঞ্চল সুপুরি চাষের আদর্শ জায়গা৷ সুপুরি চাষের জমিতেই গোলমরিচ চাষ লাভজনক হবে৷ নোনামাটিতে পান চাষ ভালো হয়, সেই জন্যেই মেদিনীপুর জেলার তমলুক মহকুমা পান চাষের আদর্শ জায়গা৷ আর এখানকার পানই সারা ভারতের বাজারে যায়৷ অবশ্য সমগ্র দক্ষিণবঙ্গেই পান চাষ চলবে৷
তিল তিন প্রজাতির–শীতকালে হয় লাল তিল, গরমকালে সাদা তিল, আর বর্ষাকালে কালো তিল৷ তিলের খোসা খুবই উন্নতমানের সার৷ তিলের খোল গোরুর খাদ্য ও সার দুই কাজেই লাগে৷ তিলের গুঁড়ো বিসুক্ট, পাঁউরুটি, পুডিং ও পরিজ তৈরীর কাজে লাগতে পারে৷ উত্তরবঙ্গ, বাঙলাদেশ ও অসমের মাটি তিল চাষের পক্ষে খুবই ভালো৷
যে সমস্ত জমি ধান চাষের উপযুক্ত নয় বা লাঙ্গল দেওয়া সম্ভব নয় সেই সমস্ত জমিতে পায়রা ফসল হতে পারে৷ অর্থাৎ একই জমি থেকে একই সময়ে চাল, ডাল ও মাছের ব্যবস্থা হতে পারে৷
(এর পরের অংশ আগামী সংখ্যায়)