শিরোনামে লিখিত বিষয়ের ওপর প্রাউট প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর বিভিন্ন পুস্তকে যা বলেছেন, সেগুলিকে সংকলিত করে’ তুলে ধরেছেন বিশিষ্ট প্রাউটিষ্ট আচার্য ত্র্যম্বকেশ্বরানন্দ অবধূত৷
(চার)
বস্ত্র উৎপাদন
আঁশ তৈরীর যেখানে যে ধরণের কাঁচামাল পাওয়া যায়, ও যেখানে যে ধরণের জলবায়ু সেখানে সেই ধরণের পোষাক মানুষ পরে থাকে৷ বাঙালীস্তানের পটভূমিতে এই ব্যাপারটা দেখা যেতে পারে৷
বাঙালীস্তানে মূলতঃ চার ধরণের কাঁচামাল পাওয়া যায়–তুলো, তুঁতজাত রেশম, তুঁতজাত নয় এমন রেশম ও অন্যান্য৷
তুলো
রাঢ় ও ত্রিপুরায় গাছ–কাপাসের উৎপাদন ভালই হয়৷ অধিক ফলনের ধান কাটার পর, সেই খালি জমিতে নভেম্বর থেকে ফেব্রয়ারী মাস পর্যন্ত গাছ কাপাসের ও তার সাথী ফসল হিসেবে শাঁখআলুর চাষ হতে পারে৷ শাঁখ আলু থেকে আমরা চার ধরণের উপ–উৎপাদন পেতে পারি–অপরিশুদ্ধ চিনি, গুড়, ইস্ট ও এ্যালকোহল৷ উত্তরবঙ্গ আর বাঙলাদেশে কেবল চাষ–কাপাসের চাষই হতে পারে৷ নদীয়া ও কুষ্টিয়া জেলায় গাছ–কাপাস ও চাষ–কাপাসের প্রচুর ফলন হবে৷ রাঢ়ের যে অংশে ভূ–স্তরের ওপরে ব্ল্যাক কটন সয়েল বা কৃষ্ণমৃত্তিকা আছে প্রাচীনকাল থেকেই সেই সকল অঞ্চলে বিশ্বের সেরা কার্পাস উৎপন্ন হ’ত৷ বর্ধমান ও বাঁকুড়া জেলার অংশবিশেষে মোগল যুগের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভাল জাতের তুলো জন্মাতো৷ এই তুলো থেকে তৈরী হ’ত ঢ়াকাই মসলিন, মুর্শিদাবাদী মসলিন, বিষ্ণুপুরী মসলিন ও সোণামুখীর মসলিন৷২৩
তুঁতজাত রেশম
বাঙলার আবহাওয়া রেশম চাষের অনুকূল৷ চেষ্টা করলে বাঙলায় তুঁত রেশমের চাষের বিস্তার করা যেতে পারে, ও সমবায় ভিত্তিতে রেশম চাষ, সুতা কাটা ও বস্ত্রবয়ন ব্যবস্থার প্রচলন করা যেতে পারে৷ তাতে সেই সব জায়গার আর্থিক কাঠামোয় পরিবর্তন দেখা দেবে৷২৩
বীরভূমের বসোয়া–বিষ্ণুপুরের রেশমের এককালে জগৎজোড়া খ্যাতি ছিল৷ ফরাসীরা ও অন্যান্য বিদেশীরা বীরভূমে নানান স্থানে রেশম উৎপাদনের নানারকম কুঠী তৈরী করেছিলেন, ও বহির্ভারতে রেশম রপ্তানিও করতেন৷ এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল লাবপুর ও ময়ুরেশ্বর থানা দুটির সীমান্তে অবস্থিত গুণুটিয়া (গণোটিয়া) কুঠি৷ বাঁকুড়া–বিষ্ণুপুরেও এই তুঁত রেশমের প্রভূত উৎপাদন হ’ত৷ এখন বাঙলায় রেশমের বেশীরভাগটাই বয়ন করা হয় মুর্শিদাবাদ জেলায়৷ যদিও কাঁচা রেশম উৎপাদনে প্রথম স্থান মালদহ৷ বস্ত্রবয়ন বেশীরভাগ মুর্শিদাবাদ জেলায় হয় বলে এই রেশম ‘মুর্শিদাবাদ সিল্ক’ নামে বাজারে সমধিক প্রসিদ্ধ৷২৩
মধ্যবঙ্গের কিছু জায়গায়, উত্তরবঙ্গে, রাঢ়ে ও ত্রিপুরায় তুঁতজাত রেশমের (সিল্ক) চাষ ভালো হবে৷ তুঁতজাত রেশম থেকে ত্রিপুরায় প্রচুর অর্থাগম হতে পারে৷ বাঙলাদেশের রাজশাহী, রঙপুর, দীনাজপুর, যশোর ও কুষ্ঠিয়া জেলায় সহজেই তুঁতজাত রেশমের চাষ হতে পারে৷ তুঁত জাত রেশম থেকে গরদ ও মটকা * দু’ধরণের কাপড়ই হতে পারে৷ মটকা দিয়ে কোট প্যাণ্ট হতে পারে৷ মুর্শিদাবাদের সুজাগঞ্জে, আর জঙ্গীপুর ও লালবাগ মহকুমায় বীরভূম জেলার বসোয়া–বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমা ও মালদা জেলায় সিল্কের বয়ন শিল্প হতে পারে৷
অ–তুঁত রেশমের মধ্যে মুখ্যতঃ তিন ধরণের রেশম পাওয়া যায়–(১) তসর, (২) মুগা ও (৩) এণ্ডি৷ যে সকল রেশমকীট শালগাছে, কুলগাছে, জামগাছে, আকন্দগাছে আপনা থেকেই এসে ভিঁড় জমায় সেই সকল গুটি থেকে যে অ–তুঁত রেশম পাওয়া যায় তাকে বলা হয় ‘তসর’৷ বাঙলার পশ্চিম রাঢ় অঞ্চলে এককালে তসরের ব্যাপক উৎপাদন ছিল৷ কাটোয়া, রাণীগঞ্জ, বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, সোণামুখী, পুরুলিয়া ও বীরভূমের তাঁতিপাড়া ছিল রেশম উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র৷ বর্হিভারতে স্যুটিঙের জন্যে এই তসরের খুবই চাহিদা ছিল৷ তসরের ক্ষেত্রেও গুটি কেটে কীট যদি পালিয়ে যায় তখন সেই নিকৃষ্ট মানের তসরকে বাংলায় ‘কেটে’ বলা হয়৷ কেটের বস্ত্র দেখতে তেমন লোভনীয় না হলেও পবিত্র বস্ত্র বলে গণ্য হয়ে থাকে৷ বীরভূমের তাঁতি পাড়ায় (রাজনগর থানা) এককালে সর্বভারতীয় বণিকদের এই তসর ক্রয়ের জন্যে আনাগোনা ছিল৷ আজ তাঁতি পাড়ার তসর শিল্প ধ্বংসপ্রায়৷ ধ্বংসের কারণগুলি হ’ল–প্রথমতঃ বাজার তৈরীর ব্যাপক চেষ্টা করা হয়নি, দ্বিতীয়তঃ প্রয়োজনীয় কাঁচা তসর সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা হয়নি৷ ফলে সমগ্র তসর শিল্প আজ ধুঁকছে৷
শোজনেকে কোন কোন জায়গায় ‘মুংগা’ বা ‘মুগা’ বলা হয়ে থাকে৷ এই শোজনে পাতা খেয়ে যে রেশম কীট বর্ধিত হয় ও গুটি তৈরী করে তাদের রেশমকেও তাই মুগা রেশম বলা হয়ে থাকে৷ যেখানে শোজনে গাছ জন্মায় সেখানেই মুগা রেশম তৈরী করা যেতে পারে৷ গরদ–তসরের মত এই মুগা রেশমও বেশ মজবুত ও টেঁকসই৷
উত্তরবঙ্গ, বাঙলাদেশ ও ত্রিপুরায় এই তসর, এণ্ডি ও মুগার চাষ হতে পারে৷
কৃত্রিম রেশম ও অন্যান্য
নাইলন, রেয়ন ও পাটমিশ্রিত পশম এই পর্যায়ে পড়ে৷ নারকেলের আঁশ, ধানের তুষ ও পাট থেকে নাইলনের আঁশ তৈরী হতে পারে৷ পাট গাছের ছাল, আনারসের পাতা ও কলা গাছের খোলা থেকে রেয়ন হতে পারে৷ ত্রিপুরার জলবায়ু এদিক থেকে খুবই সহায়ক৷ নাইলন ও রেয়ন শিল্প থেকে প্রচুর অর্থাগম হতে পারে৷ রাঢ় ও ত্রিপুরায় উন্নত মানের পশমের উৎপাদন হতে পারে, কারণ ওখানে ভেড়া চরার বিস্তৃত জায়গা আছে৷ ত্রিপুরা ও রাঢ়ের উৎপাদিত পশমের সঙ্গে মধ্যবঙ্গের পাট থেকে উৎপাদিত আঁশ মিশিয়ে ‘পাট–পশম’ ন্দব্ভব্ধন্দ্ব’ব্দ–ভ্রপ্সপ্সপ্তগ্গ তৈরী করা যেতে পারে, আর তা দিয়ে গরম–পোষাক হবে খুবই উন্নত মানের৷ শীতে বাঙলার মানুষের পক্ষে এই পাট–পশমের পোষাক খুবই তৃপ্তিদায়ক হবে৷
মোটা আঁশের পাট থেকে আমরা চার ধরণের উপ–উৎপাদন পেতে পারি– চট, কার্পেট, স্যুটিং ও সার্টিং৷ স্যুটিং–সার্টিং এর জন্যে পাট–সুতা কল বসাতে হবে৷ বাঙলার প্রতিটি মহকুমায় অন্ততঃ একটা করে পাট–সুতা কল খুললে প্রত্যেক বাড়ীতে কুঠির শিল্পের মাধ্যমে সেই পাট–সুতা–জাত কাপড় হতে পারে৷ বাড়ীর মেয়েরা ও অল্প বয়সীরাও এই কাজে টাকা আয় করতে পারবে৷ পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্রই প্রচুর লিনেনের কাপড় তৈরী হতে পারে৷ পাট চাষের জন্যে যেহেতু উর্বর জমি ও প্রচুর বৃষ্টিপাতের দরকার হয়, সেহেতু ত্রিপুরা থেকে ও বাঙলাদেশের ময়মনসিং জেলায় ভাল ফলন হবে৷ পাট থেকে কাগজ, রেয়ন, ও সিল্কের নানা ধরণের শিল্প গড়ে’ উঠতে পারে৷