সরস্বতী কোন বৈদিক দেবী নন। বেদেতে ‘সরস্বতী’ শব্দের উল্লেখ আছে কিন্তু সে সরস্বতী দেবী সরস্বতী নন। আগে ‘সরস্বতী’ শব্দটার মানে ৰলে দিই। সংস্কৃত ভাষায় ‘সরস্’ শব্দটার মানে হ’ল বড় জলাশয় অথবা শাদা রঙের আলো, শুভ্র জ্যোতিঃ। আর এই ‘সরস্’ যার আছে ইত্যর্থে ‘সরস্’ শব্দের উত্তর ‘মতুপ্’ প্রত্যয় করে ‘সর্স্বৎ’ শব্দ নিষ্পন্ন হচ্ছে যার স্ত্রীলিঙ্গের রূপ ‘সরস্বতী’। সরস্বতী মানে যার মধ্যে শাদা রঙের জ্যোতিঃ আছে অথবা যার অধীনে একটা বৃহৎ জলাশয় আছে। বেদে যে ‘সরস্বতী’ শব্দের উল্লেখ আছে : “অম্বিত মে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী”। এই সরস্বতী হ’ল একটা নদীর নাম। ‘নদী’ শব্দটাতেই ধরা পড়ে যাচ্ছে যে নদীটা এতই ভাল, এতই মানুষের উপকারে আসে,এতই কল্যাণে আসে যে এঁকে ‘দেবীতমা’ মানে শ্রেষ্ঠ দেবী ৰলে মানুষ সম্মান করছে। সুতরাং এই যে দেবী সরস্বতী, তার সঙ্গে এর কোন সম্পর্কই থাকতে পারে না। আসলে ব্যাপারটা হয়েছিল কি? প্রাচীন ভারতে চর্মণ্বতী আর দৃষদ্বতী ৰলে দুটো নদী ছিল মধ্যভারতে। চর্মণ্বতী নামটার ইতিহাস হচ্ছে : আর্যরা যখন পশ্চিম ভারতে রাজস্থান অঞ্চলে বসবাস শুরু করেছিলেন, তাঁরা তখন সেদেশে খুৰ ৰেশী পশুর সন্ধান পেয়েছিলেন। কারণ, সেখানে বৃষ্টি ছিল, অরণ্য ছিল, পশুর অভাব ছিল না। তাঁরা প্রচুর পশু হত্যা করে যজ্ঞ করতেন। সেই গল্পটা হচ্ছে :একবার তাঁরা লাখ লাখ পশু হত্যা করে যজ্ঞ করেছিলেন। আর সেই পশুচর্মের স্তুপ হয়ে গিয়েছিল পাহাড়ের মত উঁচু। আর সেই চর্মের স্তূপ চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্তধারা নেৰে আসছিল। সেই রক্তধারা ছোট্ট একটা নদীর মত হয়ে বয়ে চলেছিল। অনেক দূরে গিয়ে গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হ’ল। চর্মের ভেতর দিয়ে এই রক্তধারা শেষ পর্যন্ত নদীর রূপ নিয়েছিল ৰলে এই নদীটার সংস্কৃত ভাষায় নাম দেওয়া হয়েছিল ‘চর্মণ্বতী’। এই চর্মণ্বতী নদীর বর্তমান নাম হ’ল ‘চম্বল'।
আর ছিল আরেকটা নদী—দৃষদ্বতী। দৃষদ্বতী নদীটা বাঘেলখণ্ড এলাকায় বিন্ধ্য পর্বতে উদ্ভূত হয়ে উত্তর দিকে যেত গঙ্গার দিকে। ‘দূষৎ' শব্দটার মানে হচ্ছে নুড়িপাথর। নদীটা ৰড় বড় নুড়িতে ভর্তি ছিল, তাই বলা হচ্ছে ‘দূষদ্বতী’। এই দূষদ্বতী নদীটা উত্তর দিকে চলত গঙ্গার দিকে আর চর্মণ্বতী যেত পূর্ব দিকে। দুই নদী প্রয়াগের কিঞ্চিৎ দক্ষিণে মিলিত হ’ত। তার পরে কৌশাম্ৰীর পাশ দিয়ে গিয়ে প্রয়াগে গঙ্গায় মিলিত হ’ত। এই যুক্ত ধারাটার নাম ছিল সরস্বতী। চর্মণ্বতী আর
দৃষদ্বতী দুয়ে মিলে হ’ল সরস্বতী। এই কৌশাম্ৰীতে তোমরা জান অনেক ভগ্নাবশেষ, ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। স্থানীশ্বরের রাজবংশের হর্ষবর্ধনের সময়কার অনেক কিছু পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে কৌশাম্ৰীতে। ৰাংলা অক্ষরে (শ্রীহর্ষ লিপি) প্রথম সীলমোহর, হর্ষবর্দ্ধনের যে সীলটা শ্রীহর্ষলিপিতে লেখা, সেটাও ওই কৌশাম্ৰীতে পাওয়া গেছল। তা সেই পশ্চিম দিক দিয়ে এসেছিল চর্মণ্বতী আর দৃষদ্বতীর মিলিত ধারা সরস্বতী নদী নামে। একবার এক বিরাট ভূমিকম্প হয় মধ্য ভারতে, যার ফলে চর্মণ্বতী নদী আর পূর্ব দিকে না আসতে পেরে যমুনায় মিশেছে। এই চন্দ্ৰল আজকাল সোজা যমুনায় মিশছে। আর দূষদ্বতী নদীও চম্বলের সঙ্গে আর মিলিত হতে পারছে না উত্তর দিকে। তাই সে উত্তর-পূর্ব দিকে গিয়ে শোণ নদীর সঙ্গে মিলিত হচ্ছে।তাই চর্মণ্বতী আর দূষদ্বতীর মিলিত ধারা সরস্বতী আজ অবলুপ্ত। আজ প্রয়াগে ত্রিবেণী নয়—দ্বিবেণী। তা যাই হোক্, এই দৃষদ্বতীর বর্ত্তমান নাম ঘাঘর বা ঘাঘরা।
তোমরা যদি কেউ রেওয়া শহরে যাও, ওই শহরে এই দৃষদ্বতী নদীটা আছে। দূষদ্বতী নদীটার পরবর্ত্তী লৌকিক সংস্কৃত নাম ‘ঘর্ঘরা’; মানে নদীর জলে দারুণ শব্দ হয়, কারণ ৰড় বড় পাথর আছে, নুড়ি আছে, দৃষৎ আছে। যাই হোক, এই সরস্বতী নদী ঊষর মধ্যপ্রদেশে জলধারা সিঞ্চন করেছিল যার ফলে ওই অংশ— বাঘেলখণ্ডের উত্তরাংশ উর্বর হয়ে উঠেছিল। তাই মানুষ শ্রদ্ধায় তাকে ‘দেবী’ ৰলে সম্বোধন করত। এই হ’ল বৈদিক সরস্বতী। এ কোন নারী নয় বা কোন দেবী নয় বা শিবকন্যা নয়। ‘অম্বিতমে’ : ওগো আমার মা; ‘নদীতমে' : ওগো শ্রেষ্ঠ নদী; ‘দেবীতমে’ : ওগো শ্রেষ্ঠা দেবী, হে সরস্বতী। এই হ’ল কথাটার মানে। অর্থাৎ বেদে দেবী সরস্বতীর উল্লেখ আছে এমন কথা ৰলা সঙ্গত হবে না। তাহলে তোমরা ৰুঝছ, সরস্বতী বৈদিক দেবী নন এটাই সিদ্ধ হল।