পূর্ব প্রকাশিতের পর,
ৰজ্রযানী তন্ত্রের যুগে তিন ধরণের তারা ছিলেন৷ ভারতে পূজিতা হতেন উগ্রতারা আর চীনে ভ্রামরী তারা৷ ভ্রামরী তারা বলা হ’ত কেননা রঙটা ভ্রমরের মত কালো৷ আর কিংপুরুষবর্ষে (সংস্কৃতে তিববতকে কিংপুরুষবর্ষ বলা হয়)৷ কেন ৰলা হয় তাও জেনে রাখো৷ তিববতে পুরুষ আর মেয়েদের পোষাক- পরিচ্ছদ অনেকটা এক রকমই-ঢিলাঢালা আলখাল্লা৷
তাই দূর থেকে ৰোঝা যায় না কে পুরুষ আর কে নারী৷ তাই ‘কিংপুরুষঃ’ মানে---ও কি পুরুষ? এটা বুঝতে গোলমাল হচ্ছে৷ তাই ‘কিং পুরুষঃ’---ও কি পুরুষ? আর ‘বর্ষ’ মানে দেশ৷ তাই ‘কিংপুরুষবর্ষ’ মানে যে দেশে পুরুষদের দেখে ৰোঝা যায় না ওরা পুরুষ কি না৷
যাই হোক, এই যে কিংপুরুষবর্ষ সেখানে পূজো হ’ত ৰজ্রতারার৷ এই বজ্রতারার অপর নাম নীল সরস্বতী৷ এই মন্ত্রেও দেখলে নীল সরস্বতীঃ
‘‘গর্বিতদানবগর্ব-খর্বাকৃতিঃ খড় গখর্পরা নীলসরস্বতী৷’’
এই নীল সরস্বতীর মূর্ত্তি তোমরা পাবে ৰুদ্ধগয়ার মন্দিরেতেও৷ নীলরঙের তারা৷ এখানে ৰলা একটু অপ্রাসঙ্গিক হবে যে মহর্ষি বশিষ্ঠ সেই ৰৌদ্ধতন্ত্রের যুগের লোক ছিলেন৷ তাঁর রচিত ‘যোগবশিষ্ঠ বা অধ্যাত্ম রামায়ণ নামে যা খ্যাত তার সঙ্গে রামায়ণের সম্পর্ক নেই৷ সেটাও একটা ৰৌদ্ধতন্ত্রের বই---সংস্কৃত ভাষায় লেখা৷ মহর্ষি বশিষ্ঠ চীনে গিয়েছিলেন তন্ত্রের চীনাচার শিখতে আর সেখান থেকে তিনি তারা মূর্ত্তি এনে প্রতিষ্ঠিত করেন বীরভূমের তারাপীঠে অর্থাৎ ওই তারাও হলেন ৰৌদ্ধতান্ত্রিক দেবী৷ পৌরাণিক দেবী নন---ৰৌদ্ধ৷
যাই হোক, এই নীলসরস্বতী পরবর্ত্তীকালে পৌরাণিক শাক্তাচারে, পৌরাণিক যুগে সর্বশুভ্রা সরস্বতীরূপে গৃহীতা হলেন অর্থাৎ নীল রইলেন না, হয়ে গেলেন শাদা৷
এ আজ থেকে তের শ’ বছর আগেকার কথা ---শিবের সময়ের অনেক অনেক পরে৷ তাই তোমরা মাটির তলা থেকে প্রাচীন ধবংসাবশেষ থেকে যদি কোন এই সর্বশুভ্রা সরস্বতীর মূর্ত্তি পাও-গোটা বা ভাঙ্গা, তো দেখবে ওগুলো কোনটাই তেরশ’ বছরের চেয়ে বেশী পুরোণো নয়৷ কিন্তু এই যে সর্বশুক্লা সরস্বতী পৌরাণিক দেবী, এঁর পূজোও কিন্তু ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল না৷ এমনকি পাঠান যুগেও ছিল না, এমনকি মোগল যুগেও ছিল না৷ মোগল যুগে, পাঠান যুগে লোকে এই সর্বশুক্লা সরস্বতীর পূজো করতে গেলে বইয়ের পূজো করত, পুস্তকের পূজো করত৷ এখন ইংরেজ আমালের গোড়ার দিকে সাহেবরা বললে---‘‘টোমাডের এ্যাটো ডেৰী আছে, আর টোমরা সরস্বতীর পূজা বই দিয়ে কেন করো? ‘why books, why not a Devi, why not a godess’’? এখন ওই ইংরেজ আমলে ওই সর্বশুভ্রা সরস্বতীর মূর্ত্তি গড়ে পূজো করবার রীবাজ শুরু হল এই কলকাতা শহরেই৷ একেবারে অতি আধুনিক পূজো৷ এই সরস্বতীর সঙ্গে শিবের কোন সম্পর্ক নেই৷ এই দেবীর কল্পনাটাই হয়েছে, তেরশ বছর আগে-শিবের সময়ের চেয়ে পাঁচ হাজার সাতশ বছর পরে৷ বৌদ্ধতন্ত্রের যে তারা দেবী তার বীজমন্ত্র ছিল ‘ত্রৈং’৷ পৌরাণিক যে সরস্বতীদেবী, এর ৰীজমন্ত্র হচ্ছে বাগভব ৰীজ অর্থাৎ ‘ঐং’৷ লিখে একটা অনুস্বার,‘‘ঐংসরস্বত্যৈ নমঃ৷ কেউ কেউ ভাবেন, মহাযানী ৰৌদ্ধ প্রজ্ঞাপারমিতার বিবর্ত্তিত রূপ হচ্ছে সরস্বতী৷ এ ধারণাটা ঠিক নয় কারণ উভয়েই প্রজ্ঞা বা বিদ্যার দেবতা হলেও তাঁদের দুয়ের মধ্যে মৌলিকত্বে পার্থক্য এত বেশী যে একে অন্যের বিবর্তিত রূপ হতে পারে না৷ তাহলে, আমরা দেখছি যে লক্ষ্মী শিবের কন্যা নন, শিবের সঙ্গে তাঁর কোন সম্পর্ক নেই পার্বতীর সঙ্গেও কোন সম্পর্ক নেই আর পৌরাণিক যে দেবী দুর্র্গ তাঁর সঙ্গেও সম্পর্ক নেই৷ ঠিক তেমনি ব্যাপারটা সরস্বতীর৷ শিবের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, শিবের কন্যা নন, আর বেদের সরস্বতী হ’ল নদী সরস্বতী, তন্ত্রের সরস্বতী হ’ল নীলসরস্বতী অর্থাৎ তারা দেবী৷ আর পৌরাণিক সরস্বতী, তারও মূর্ত্তি গড়ে পূজো করছে লোকে এই ইংরেজ যুগ থেকে৷ তার আগে এ পূজোটা ছিলও না৷