বিচার

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

 ‘বিচার’ শব্দটার ভাবগত অর্থ হ’ল সত্য নির্ধারণের জন্যে বিশেষ প্রকারের মনঃ সঞ্চালন৷ যদিও মানুষের আপেক্ষিকতাকে নিয়েই কারবার, তবুও এই আপেক্ষিক জগতে যা সত্য ৰলে প্রতীত হয়, সমাজ দেহে তাকেই ৰলৰ ‘বিচার’৷ বিচারের সব চাইতে ৰড় লাভ এই যে এর সম্যক প্রয়োগের ফলে সমাজ দেহে শুভ-অশুভ, শিব-অশিবের মধ্যে একটা অশেষ যুধ্যমান ভাব স্থায়ী ভাবে থেকে যায় যার ফলে মানব মনীষা শিবত্বের পথ বেছে নিতে অধিকতর সুযোগ পেয়ে যায়৷ অনেকেই ৰলেন, ‘মানুষের বুদ্ধি কতটুকু যে মানুষ মানুষের বিচার করবে, মানুষের বিচার করবার কৌন অধিকার মানুষের নেই৷’ কথাটা আমি মোটেই অস্বীকার করছি না, তবু ৰলৰ আপেক্ষিক জগতে মানুষ যে পরিমাণ বৌদ্ধিক পুঁজি নিয়ে এসেছে তার উচিত ব্যবহার না করাটাও কি অন্যায় নয়? বিচার হয়তো সব সময় ঠিক হয় না, বিচারের মাপকাঠি নির্র্ধরণেও অনেক সময় ত্রুটি থেকে যায় অথবা বিচারকের চিন্তাধারা বা মনোবৃত্তি হয়তো অনেক সময়ে তাকে আর পাঁচ জনের কাছে আর্দশ মানুষ রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে না৷ তবু বা তাই ৰলে কি বিচার-ব্যবস্থাকেও রহিত করে দিতে হবে? না, নিশ্চয়ই না৷ মনীষার প্রগতিতে কোন কিছুরই মান বা স্ট্যাণ্ডার্ড কোন কালেই শাশ্বত ৰলে গৃহীত হয় নি বা হবে না৷ তবু সব কিছুতেই ‘ইম্‌পারফেকসন’ (imperfection) থেকে ‘পারফেকসন’ (perfection)-এ পৌছুৰার একটা প্রচেষ্টা রাখতেই হবে, আর এই প্রচেষ্টাই পরোক্ষভাবে মানুষ জাতির সর্বাত্মক কল্যাণের জয়যাত্রার পথ সুগম করে দেৰে৷

কোন কিছুর সম্বন্ধে কোন একটা সিদ্ধান্তে পৌছুবার সঙ্গে সঙ্গে বিচারের কার্য শেষ হয়ে যায়৷ তাই বিচার নিজে কোন একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ জিনিস নয়৷ বিচারের সিদ্ধান্তকে কার্যে রূপ দেওয়া হ’লে তবেই একটা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হয়, অর্থাৎ গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যষ্টি বা সমষ্টির সম্বন্ধে শাস্তিমূলক---আরও ঠিক ভাবে ৰলতে গেলে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হ’লে তবেই সমাজ জীবনে বিচারের সার্থকতাটুকু অনুভূত হয়! বিচারের মাপকাঠিটা যখন কোন অবস্থাতেই সন্দেহাতীত ভাবে সত্য নয় তখন তার উপর ভিত্তি করে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাউকে শাস্তি দিতে হ’লে খুব বেশী রকমের সতর্কতার যে প্রয়োজন এ কথা কেউই অস্বীকার করতে পারৰে না৷

ব্যষ্টিগতভাবে আমি মনে করি যে বিচারের পদ্ধতি যতই ভাল হোক না কেন, ভূল-ত্রুটি যখন কিছুটা থেকে যাবেই যাৰে তখন এটাই ৰলতে হয় যে মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাটা নিক---এটা প্রকৃতির অভিপ্রেত নয়৷ খুব নিবিষ্টভাবে ভাবলে পরে দেখতে পাই যে কাউকে শাস্তি দেৰার উদ্দেশ্যে নিয়ে যখনই কোন ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয় সে সময় শাস্তিদাতার মনে বিচারকের ভাবের চাইতে প্রতিশোধ নেবার ভাব অর্থাৎ একটা হিংসামূলক ভাবই জেগে ওঠে৷ তাই আমি বলি যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কথাটাই মানুষের সমাজ জীবন থেকে রহিত হয়ে যাওয়া উচিত৷ কারো বিরুদ্ধে কেউ (তিনি বিচারকই হোন অথবা সাধারণ মানুষই হোন) যখন কোন ব্যবস্থা নেবে তখন সেটা শাস্তিমূলক না হয়ে সংশোধনমুলক হওয়া উচিত৷ সংশোধনমূলক ব্যবস্থাতে অপরাধী---তা সে যে রকমের হীন অপরাধেই লিপ্ত হোক না কেন, কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মত কোন কিছু খুঁজে পাৰে না৷ বিচারের ত্রুটি থেকে গেলেও সেক্ষেত্রে তার কোন ক্ষতি হবে না৷ যদি সে সত্যি করে অপরাধী হয় সেক্ষেত্রেও তার কোন ক্ষতি হবে না৷ যদি সে সত্যি করে অপরাধী হয় সে ক্ষেত্রেও সংশোধন মূলক ব্যবস্থায় সে যেমন উপকৃত হবে, সে যদি অপরাধী না হয় তা হলেও সংশোধনমূলক ব্যবস্থারতার উপকার ছাড়া অপকার হবে না৷ আমার আসল বক্তব্য এই যে বিচারপদ্ধতির ত্রুটির জন্যে কোন নিরীহ লোক যেন ৰলবার বা ভাববার সুযোগ না পায় যে অর্থাভাবে আমি ভাল উকিল রাখতে পারিনি ৰলে বিনা দোষে আমার শাস্তি হয়েছে৷ প্রকৃত অপরাধী যদি আইন-কানুনের জাল ছিঁড়ে বাইরে পালিয়েও যায় অথবা পুলিশের অযোগ্যতার দরুন ধরা না পড়ে, তাতে সমাজের ক্ষতি হবে সত্যি, কিন্তু তার চাইতেও ৰড় ক্ষতি হবে যদি বিচার-পদ্ধতির দোষে নিরীহ ব্যষ্টিকে শাস্তি ভোগ করতে হয়৷

সামাজিক অথবা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সবার বিরুদ্ধে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেবার অধিকার সবারই আছে৷ এটা মানুষ-মাত্রেরই একটা জন্মগত অধিকারের কথা৷ যাকেই কোন না কোন কারণে মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয় তারই ত্রুটি শোধরাৰার অধিকার সমাজের অন্যান্য মানুষের যে আছে এ কথা কোন তার্কিকই অস্বীকার করতে পারবেন না৷ সমাজের সুস্থতা রক্ষার কার্যে এ অধিকারের স্বীকৃতি অপরিহার্য৷ তাহলে দেখতে পাচ্ছি, বিচারের অনুপূরক হিসাৰে যেটা দরকাব সেটা হচ্ছে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা৷ এতে চণ্ডনীতি, দণ্ডনীতি, জনসাধারণের উপর সরকারের দৌর্দণ্ড প্রতাপ বা দাপট দেখাৰার কোন অবকাশ নেই৷ শাসন-ব্যবস্থার সঙ্গে সংশোধনমূলক ব্যবস্থার মূলগত পার্থক্যটাও এইখানেই৷ শাসন-ব্যবস্থায় সামাজিক বা রাষ্ট্রিক কাঠামোটাকে মজবুৎ রাখবার জন্যে যে বিশেষ একটা কঠোরতার প্রয়োজন বিচারের ক্ষেত্রে সে কঠোরতার প্রয়োজন তো নেই-ই, বরং এর পছনে রয়েছে একটা কল্যাণমূলক কোমল মানবিক চিন্তাধারার মধুর স্পর্শ৷ শাসনব্যবস্থার সঙ্গে তাই বিচার ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রে একমত হ’য়ে চলতে পারে না৷ শাসনের কঠোরতাকে অনেক সময় বিচারক তার মানবিক যুক্তি দিয়ে নস্যাৎ করে দিতে পারেন ও দেবেনও, ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থার কাছে সেক্ষেত্রে শাসন কর্ত্তৃপক্ষের রায়ের চাইতে বিচারকের রায়ই শ্রেষ্ঠ ৰলে গৃহীত হবে৷ যদি তা না হয় বা যেখানে তা না হয় সেক্ষেত্রে ৰুঝতে হৰে যে রাষ্ট্রিক ক্ষেত্রে ব্যষ্টি বা দলবিশেষের স্বেচ্ছাচার চলছে৷