বর্তমানে ছোট ছোট রাষ্ট্র অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে সংগ্রাম করে’ চলেছে৷ মানুষ ছোট ছোট রাষ্ট্র অপেক্ষা বড় বড় সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে’ তুলে সকলের কল্যাণ নিশ্চিত করতে আগ্রহী৷ সংকীর্ণ সেণ্টিমেণ্ট ধীরে ধীরে সরে’ যাচ্ছে৷ মানুষের মনে বিশ্বৈকতাবাদী ভাবধারার উদয় হচ্ছে৷ যে সমস্ত অন্ধ বিশ্বাস ও ভাবজড়তা এতদিন সমাজের অনেকের শ্বাসরুদ্ধ করে’ রেখেছিল আজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার বিকাশ তাদের মুখোশ খুলে দিয়েছে৷ যুক্তি–বিচার ও ‘সর্বজনহিতায়’ ভাবনাকে মানবতা এখন গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে৷ তাই প্রাউট বর্তমান পৃথিবীর সামাজিক–অর্থনৈতিক প্রবণতা অনুসারে সর্বত্র স্বয়ং–সম্পূর্ণ অঞ্চল ব্ভুন্ব্ধগ্গ গড়ে’ তোলার নীতিতে বিশ্বাসী৷ এই সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলি আপন আপন এলাকায় জনসাধারণের সার্বিক কল্যাণকে ত্বরান্বিত করবে, ও এক সাধারণ ভাবাদর্শের ভিত্তিতে সর্বমানবকে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করবে৷ এই সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলি যতই শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ হবে ততই ধীরে ধীরে এগুলি পরস্পরের সঙ্গে মিলে যাবে৷ বিশ্বরাষ্ট্র তৈরী হবার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিতভাবে পৃথিবীর সকল মানুষের ও সকল নেশনের স্বার্থ রক্ষিত হবে, সবাই যথার্থ স্বীকৃতি পাবে৷ এইভাবে প্রাউট সর্বমানবের সার্বিক কল্যাণকে সুনিশ্চিত করবে৷
স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল
আমরা দেখতে পাই যখন কোনো নিপীড়িত গোষ্ঠী বা শ্রেণী কিছুটা স্বাধীনতা পেয়েছে, তখন তারাও আবার অন্য গোষ্ঠী বা শ্রেণীর ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে৷
সামূহিক জীবনের মুক্তি তখনই সুনিশ্চিত হয়, যখন জীবনের সর্বক্ষেত্রে মানুষ অবাধে সার্বিক অভিব্যক্তি ঘটাতে পারে৷ এই সর্বস্তরের মুক্তিকে প্রতিটি মানুষের স্বাভাবিক অধিকার হিসেবে গণ্য করা উচিত৷ মানুষের এই স্বাভাবিক অধিকারের সুষ্ঠু বিকাশের জন্যে আমাদের কর্তব্য উপযুক্ত বাতাবরণ–উপযুক্ত সামাজিক অর্থনৈতিক পরিবেশ গড়ে’ তোলা–যা আজকে নেই৷
বর্তমানে একই রাজনৈতিক প্রদেশের মধ্যে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যাবহুল স্থান রয়েছে৷ তাই অর্থনৈতিক কাজকর্মের সুবিধার জন্যে, দেশের অর্থনৈতিক প্রগতির জন্যে, অর্থনৈতিক প্রদেশ ন্দ্বন্তুপ্সুপ্সপ্পন্ন্তু ম্ভ্রপ্সুন্দ্বগ্গ অপরিহার্য৷
সামাজিক–অর্থনৈতিক আন্দোলন গড়ে’ তোলার সময় অনেক বিষয় বিবেচনা করা উচিত৷ এগুলি হ’ল ঃ–
* একই অর্থনৈতিক সমস্যা
* একই ধরণের সম্পদ ও সম্ভাবনা
* জাতিগত সাদৃশ্য
* সাধারণ ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য
* একই সাধারণ (common) সামাজিক–সাংস্কৃতিক বন্ধন যেমন ভাষা, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য প্রভৃতির ভিত্তিতে গড়ে’ ওঠা সেণ্টিমেণ্টাল লিগ্যাসি (সাংবেদনিক উত্তরাধিকার)৷
একই অর্থনৈতিক সমস্যা
একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে একই ধরণের অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে৷ এই সমস্যার মধ্যে রয়েছে স্থানীয় উৎপাদিত পণ্যের উপযুক্ত বাজারের অভাব, উদ্বৃত্ত বা ঘাটতি–শ্রম সমস্যা, যোগাযোগ ও পরিবহন–সমস্যা, সেচের জন্যে জল–সমস্যা ইত্যাদি৷ একটি সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে’ তুলবার সময় ওই অঞ্চলে প্রথমেই উপরিউক্ত সমস্যাদি আছে কিনা সেটা বিশ্লেষণ করতে হবে৷ অর্থনৈতিক সমস্যাগুলি ও তার সমাধানের উপায়ও ভাল করে’ বুঝে নিতে হবে৷
একই ধরণের সম্পদ ও সম্ভাবনা
কোন এক সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলে একই ধরণের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা থাকা উচিত৷ যদিও এটা স্বাভাবিক যে, একই সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিভিন্ন স্থানের মধ্যে পার্থক্য থাকবেই, তবে পুরো এলাকার জনসাধারণের অর্থনৈতিক বিকাশের একই ধরণের সুযোগ আছে কিনা দেখে নিতে হবে৷
জাতিগত সাদৃশ্য
একই ভৌগোলিক পরিবেশ, একই ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক আবেষ্টনীর মধ্যে যাদের জন্ম ও লালন–পালন, সেই জনগোষ্ঠী অপর জনগোষ্ঠী থেকে ভিন্নতর গোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্য অর্জন করে৷ পরবর্ত্তীকালে এই গোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্যগুলোই সমগ্র জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ ভাবধারার সঙ্গে এমনভাবে মিশে যায় যে, এতে করে’ একটা জাতীয় (national) স্বভাব তৈরী হয়৷ তা দিয়েই একটা গোটা জাতির (nation) মানস–প্রবণতা, বাহ্যিক আচরণ, জীবন ও সমাজের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গী–এককথায়, একটা বিশেষ জাতীয় (national) দৃষ্টিকোণ গড়ে’ ওঠে–যা সেই জাতিকে (nation) অন্য জাতি (nation) থেকে এক পৃথক বৈশিষ্ট্য দান করে৷
একটি সামাজিক–অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে গোষ্ঠীগত মিল (Ethnic similarities) থাকা উচিত৷ অতীতে বহু জাতি ও উপজাতি শক্তিশালী ও প্রভাবশালী জাতির দ্বারা অবদমিত ও শোষিত হয়েছে৷ এই প্রভাবশালী জাতি সমাজকে খণ্ড–বিখণ্ড করে’ নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যে জাতিবাদের প্রচার করেছে৷ এই সমস্ত ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর সংকীর্ণ সেণ্টিমেণ্ট থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হবে৷ আর এটা সম্ভব হবে যদি প্রতিটি জনগোষ্ঠী তাদের অভিব্যক্তি ও বিকাশের পর্যাপ্ত সুযোগ পায়৷ নানান বর্ণের পুষ্পে রচিত মানবতার মাল্যখানি সৌন্দর্যের পরম আকরে পরিণত হবে তখনই যখন নানান্ জনগোষ্ঠী ভয় ও বাধ্যবাধকতায় একত্রিত হতে বাধ্য না হয়ে আপন শক্তি ও স্বাধীনতার মর্যাদাপূর্ণ আসন থেকে প্রকৃত ভাই–বোনের ভালোবাসা নিয়ে প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হবে৷ (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
সাধারণ ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য
ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীকে বর্ণনা করতে গেলে বলতে হয় এখানে আছে বরফাচ্ছন্ন মেরু প্রদেশ, আছে ঊষর ধূসর জ্বলন্ত খাঁ খাঁ মরুভূমি, আছে দিগ্দিগন্ত বিস্তৃত গর্জনমুখর অশান্ত নীলসমুদ্র, আর আছে নীরব নিথর বিপুল পাহাড়–পর্বতের দুর্ভেদ্য প্রাচীর৷ কোথাও নদী বইছে–তাদের দুই ধারে জেগে উঠেছে নদীবিধৌত বিশাল সমতল ক্ষেত্র, কোথাও ভূ–ভাগ বেষ্টিত জল–বলয় কলকল ছলছল শব্দে লীলায়িত হচ্ছে৷ এমনি ধরণের বিপরীতমুখী প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষকে পড়তে হয়েছে৷ এই বিপরীত পরিবেশে থেকে মানুষকে বিশেষ বিশেষ ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে৷১০
সম–ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য (অর্থাৎ ভূমি–সংস্থান, নদী–ব্যবস্থা, বৃষ্টিপাত, সেচের জল–এগুলিও) সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরীর জন্যে বিশেষভাবে বিবেচ্য৷
সাংবেদনিক উত্তরাধিকার
সাংবেদনিক উত্তরাধিকারের মধ্যে এসে যাচ্ছে ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সাধারণ প্রথা, সংস্কৃতি প্রভৃতি৷ এ হ’ল এক বিশেষ জনগোষ্ঠীর সামূহিক মনস্তত্ত্বের সাধারণ সূত্র যা ওই জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে অভিন্নতা ও আত্মীয়তা–বোধ সৃষ্টি করেছে
মানুষের সমস্ত ধরণের অভিপ্রকাশই সংস্কৃতি৷ মাতৃভাষার ব্যবহারই অভিপ্রকাশের স্বাভাবিক ও সহজতম উপায়৷ মাতৃভাষার মাধ্যমে জনগণের যে স্বাভাবিক অভিব্যক্তি, তা যদি ব্যাহত হয় তাহলে তাদের মনে হীনম্মন্যতা বাসা বাঁধে৷ এর ফলে তাদের মধ্যে গেড়ে বসে পরাজিতের মনোভাব, ও শেষপর্যন্ত তাদের ওপর চলে মানস–অর্থনৈতিক শোষণ৷ জনগণের সাংবেদনিক উত্তরাধিকারের উপযোগিতা নিতে হলে তাদের চেতনা বাড়িয়ে তুলতে হবে, জানতে হবে শোষক কারা, বুঝতে হবে মানস–অর্থনৈতিক শোষণের কৌশল, আর উদ্বুদ্ধ হতে হবে সংগ্রামী চেতনায়৷ ভাষাটা নিজে কোন বিচার্য বিষয় নয়, বিচার্য বিষয় হচ্ছে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভাষা–সাম্রাজ্যবাদের ফলশ্রুতি৷
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে দেশকে কতকগুলি সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিভক্ত করতে হবে৷ যদি রাজনীতি ও ভাষার দৃষ্টিকোণ থেকে রাজ্যের সীমানা নির্দ্ধারণ করা হয় তাহলে যথাযথ সামাজিক–অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কখনই রচনা করা যাবে না, ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যার প্রতি যথাযথভাবে মনোযোগ দান করা সম্ভব হবে না৷ সুতরাং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল অপরিহার্য৷
প্রশাসনিক প্রয়োজনে ভিন্ন ভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলিকে এখনই একই অর্থনৈতিক অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত করলে জটিলতা দেখা দিতে পারে৷ তাই একটি অথনৈতিক অঞ্চলকে প্রয়োজনে দুটি রাজনৈতিক অঞ্চলে বিভক্ত করা যেতে পারে, আবার একই রাজনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল থাকতে পারে৷
রয়্যালসীমা, শ্রীকাকুলাম ও তেলেঙ্গানা–একই রাজনৈতিক প্রদেশ অর্থাৎ অন্ধ্রপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের প্রত্যেকের অর্থনৈতিক সমস্যা ভিন্ন৷ এগুলির ভিন্ন ভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যার কথা বিবেচনা করে’ ওই অঞ্চলগুলিকে নিয়ে জনসাধারণের স্বার্থে পৃথক পৃথক সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে’ তোলা উচিত৷
বিহার রাজ্যে ৫টি সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে’ উঠতে পারে৷ যথা–অঙ্গিকা, মগহী, মৈথিলী, ভোজপুরী ও নাগপুরী৷
উপরি–উক্ত নীতিতে সম্পূর্ণ ভারতবর্ষকে প্রায় ৪৫টি সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিভক্ত করা যায়৷ এই অঞ্চলগুলিকে তাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও কর্মপন্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধমে পুরোপুরি অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করার পূর্ণ স্বাধীনতার গ্যারাণ্টী থাকা উচিত৷
সমগ্র সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্যে ও সুষ্ঠু ৰ্লক ভিত্তিক পরিকল্পনা রচনা করতে হবে৷
প্রতিটি সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলের উচিত অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা অর্জনের জন্যে আপন আপন উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা রচনা করে’ তার বাস্তবায়নে সচেষ্ট হওয়া৷ স্থানীয় অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ বিরাট বিরাট পরিকল্পনা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া চলবে না৷ ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর সমস্ত দেশের কেন্দ্রিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে৷ প্রাউটের বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার নীতি অনুসারে ৰ্লক ভিত্তিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে প্রতিটি সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্যে একটি সুসংগ্রথিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ড্রপ্স–প্সব্জস্তুনুত্র্ হ্মপ্ত্ত্রুগ্গ রচনা করার প্রয়োজন৷